৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ৯:০৮

গঙ্গানির্ভর নদ-নদী মৃত্যুমুখে

মিজানুর রহমান তোতা : নদীই জীবন। নদী বাঁচলে মানুষ বাঁচবে। উন্নয়ন ঘটবে কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, জীব-বৈচিত্র, বনজ ও মৎস্যসম্পদ এবং পরিবেশের। কিন্তু গঙ্গানির্ভর দক্ষিণ-পশ্চিমের সব নদ-নদী এখন মৃত্যুমুখে। নদ-নদী বাঁচানোর কোন উদ্যোগ নেই। মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার পানি প্রাপ্তি নিয়ে দেখা দিচ্ছে অনিশ্চয়তা। ভারতীয় আগ্রাসনে নদীদেহের অন্যতম হৃদপিন্ড পদ্মা এখন স্পন্দনহীন প্রায়। পদ্মার বুকে চলছে হাহাকার। সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, পদ্মার শাখা-প্রশাখা গড়াই, কুমার, কপোতাক্ষ, বুড়িভদ্রা, ভৈরব, চিত্রা, নবগঙ্গা, মুক্তেশ্বরী ও মধুমতি গত ৪০ বছরের ব্যবধানে খালে পরিণত হয়েছে। যার কারণে দিনে দিনে সমুদ্রে পানির উচ্চতা বাড়ছে। জলবায়ু ও ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তনে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা বাড়ছে।

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার ২২ হাজার ৭শ’৩৭ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাড়ছে খরা ও মরুকরণ প্রবনতা। পরিবেশ হচ্ছে বিপর্যস্ত। নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট মহল থেকে বহুমুখী আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ায় জীবন-জীবিকার উপর প্রচন্ড আঘাত পড়ছে। সুত্রমতে, শুধু নদ-নদী নয়, এ অঞ্চলের মোট ১শ’১০টি শাখা প্রশাখা নদ-নদী, ১ হাজার ৭শ’ ৮১টি খাল-বিল ও ৯৫ হাজার ৮শ’৭৯টি পুকুর দীঘির সিংহভাগই প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিএডিসি, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও হাইড্রোলজি বিভাগ সুত্র বলেছে, প্রতিটি শুষ্ক মৌসুমে ভয়াবহ পানি সংকট দেখা দেয় গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমে। ভূপৃষ্টে পানি পাওয়া হয় কঠিন। এবারও তার ব্যতয় ঘটেনি। সেচনির্ভর বোরো আবাদ শুরু হয়েছে। আগের মতো নদ-নদী, খাল-বিলের পানি দোনা ও সেউতি পদ্ধতিতে জমিতে সেচ দিয়ে আবাদ করার উপায় নেই। এখন সম্পুর্ণ নির্ভর করতে হচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটারের উপর। সুত্রমতে, ফারাক্কা আর মিনি ফারাক্কার ধাক্কায় সব নদী শুকিয়ে গেছে। গঙ্গানির্ভর নদ-নদীর অবস্থা এতটাই সঙ্গীন যে একসময়ের ¯্রােতসিনি ছিল অথচ এখন খালে পরিণত। মাথাভাঙ্গা, আপার ভৈরব, ইছামতি, কোদলা ও বেতাইসহ প্রায় সব ক’টি অভিন্ন নদ-নদীর উজানে বাঁধ, গ্রোয়েন ও পাথর ফেলে পানি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে বহুদিন ধরে। এর কোন সুরাহা হয়নি, নেই কোন বাদ-প্রতিবাদও। এতে ভাটি অঞ্চলের দেশ বাংলাদেশের জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে দ্রæত। বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া। ষঢ়ঋতুর পরিবর্তন ঘটছে। গড়পড়তা তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণে পরিবেশবিদগণ উদ্বিগ্ন। সুত্র জানায়, নদ-নদীর প্রবাহ বিঘœতা ও সমুদ্রের পানির উচ্চতা জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটায়।

ক্রমাগত পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে পৃথিবীর অনন্য সুন্দর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন মারাত্মক হুমকির মুখে। দেশের বৃহত্তম গঙ্গা কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের (জিকে প্রজেক্ট) অস্তিত্ব¡ বিপন্ন। জিকের ক্যানেলগুলো খাঁ খাঁ করছে। মংলা সমুদ্রবন্দর ও নওয়াপাড়া নদী বন্দর চরম সংকটে। নাব্যতার অভাবে নৌ যোগাযোগ সংকুচিত হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীর অবস্থা হচ্ছে, কোথাও স্রোতহীন, কোথাও পানিশূন্য। নদ-নদীর পানি বঙ্গোপসাগরে পড়ার স্বাভাবিক ধারা হয়েছে অস্বাভাবিক।

সরেজমিনে যশোর, ঝিনাইদহ ও খুলনার ভৈরব নদ, ঝিনাইদহের নবগঙ্গা, শৈলকুপার কুমার, কালীগঞ্জের চিত্রা, চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙ্গা, ও কুষ্টিয়ার গড়াই পানির অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূলত পদ্মার শাখা-প্রশাখা নদ-নদীতে পানি একেবারেই কমে গেছে। এ অঞ্চলের ইছামতি, সোনাই, বেতনা ও কোদলাসহ অভিন্ন নদ-নদীর অবস্থাও করুণ। মূল কথা ফারাক্কা আর মিনি ফারাক্কার কারণে নদ-নদী শুকিয়ে গেছে। তাছাড়া বহুকাল যাবত দক্ষিণ-পশ্চিমের সিংহভাগ নদ-নদী সংস্কার করা হয়নি। এতে নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমের পানি ধারণ ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে নদীগুলো। নদ-নদীর কোন কোন অংশে যতটুকু প্রবাহ আছে তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অপরিকল্পিত ব্রিজ নির্মাণ, বাঁধ ও পাটাতন দিয়ে মাছ চাষ, অবৈধ দখল, স্লুইস গেট ও পোল্ডার এবং ভেড়িবাঁধ নির্মাণের কারণে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী বাঁচাও আন্দোলন কমিটির নেতৃবৃন্দের কথা, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় সব নদ-নদী এখন মৃতমুখে। যে কারণে পরিবেশের উপর নেমে এসেছে মারাত্মক বিপর্যয়। সময় থাকতে জীবন মরণের সমস্যার সমাধানের উপায় খুঁজে বের করার জোর তাগিদ দিয়েছেন সচেতন পর্যবেক্ষক মহল।

https://www.dailyinqilab.com/article/116347