৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, বুধবার, ৯:৫২

ওভারটাইমের নামে দেড়শ’ কোটি টাকা অপচয়

ঢাকা ওয়াসায় আইনের তোয়াক্কা করছে না কর্তৃপক্ষ

ওভারটাইমের নামে বছরে ঢাকা ওয়াসায় প্রায় ১৫০ কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। কাজ না করেই ওয়াসার প্রায় তিন হাজার কর্মচারী ওভারটাইমের বিল হিসেবে মাসে বেতনের তিন-চারগুণ টাকা তুলে নিচ্ছে। আভ্যন্তরীণ তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, সব কর্মচারীর ওভারটাইমের পরিমাণ সমান দেখানো হয়। অনেক কর্মচারীকে ২৪ ঘণ্টাও ডিউটিরত দেখানো হচ্ছে। ঢাকা ওয়াসায় ওভারটাইমের বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে স্পষ্ট অনিয়ম ঘটলেও বছরের পর বছর তা চলছেই। কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারণে অনিয়মের সমাধান করছে না। সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, শূন্য পদগুলোয় নিয়োগ চূড়ান্ত করে অপ্রয়োজনীয় ওভারটাইম বন্ধ করলে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হবে। আর এ টাকা সংস্থার পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনের উন্নয়নে ব্যবহার করলে প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হবে। পাশাপাশি নগরবাসীকে কম মূল্যে ঢাকা ওয়াসার সেবা নিশ্চিত করা যাবে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) সভাপতি এবং শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি মো. হাফিজ উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ‘কর্মচারী সংকটের কারণে ঢাকা ওয়াসার পাম্পগুলো চালু রাখতে কর্মচারীদের ওভারটাইম করাতে হয়। সরকারি বেতন বৃদ্ধির আগে ঢাকা ওয়াসার কর্মচারীদের বছরে ওভারটাইমের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬০ কোটি টাকা। বেতন বৃদ্ধির পর কর্মচারীদের ওভারটাইমের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড়শ’ কোটি টাকা। তবে কিছুদিন ধরে কর্মচারীদের ওভারটাইম পরিশোধে কর্তৃপক্ষ গড়িমসি করছে। এটা অন্যায় হচ্ছে। একজন কর্মচারী ওভারটাইম করবে আর সে পারিশ্রমিক পাবে না, সেটাতো হতে পারে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসার শূন্য পদগুলো পূরণ করা হলে এ সংক্রান্ত ঝামেলার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু দীর্ঘদিন ঢাকা ওয়াসা কর্মচারীদের শূন্যপদ পূরণ করছে না। ঢাকা ওয়াসায় কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো বাধা নেই।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার বোর্ড চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. হাবিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসায় কর্মচারীদের ওভারটাইম দেয়া হয়। এটা অনেকের বেতনের চেয়ে তিনগুণ-চারগুণ হয় বলেও শুনেছি। এখানে কোনো অনিয়ম হচ্ছে কিনা, সেটা জানি না। তবে যদি কখনও এ সংক্রান্ত প্রস্তাব ওয়াসা বোর্ডে উপস্থাপন করা হয়, তখন আইনসঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।’

জানা যায়, ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান রহমতউল্লাহর সময়ে ঢাকা ওয়াসার কর্মচারীদের ওভারটাইমের অনিয়ম বন্ধে ২৫০তম বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওই বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত হয়, এ তুঘলকি ওভারটাইম বন্ধ করতে হবে। বছরের পর বছর এটা চলতে দেয়া হবে না। আর এসব বন্ধ করতে হলে শূন্য পদগুলোয় জনবল নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর দীর্ঘসময় পার হলেও ঢাকা ওয়াসার ওভারটাইম সমস্যার সমাধান হয়নি।
ঢাকা ওয়াসার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘একজন কর্মচারীর মাসিক বেতন ২২ হাজার টাকা। তিনি যদি মাসে ওভারটাইমসহ মাসে ৮৮ হাজার টাকা উঠান, এটা তো হতে পারে না। এটা অনেক কর্মকর্তার বেতনের চেয়েও বেশি। এমন নিয়ম বাংলাদেশের কোথাও নেই, কর্মকর্তার চেয়ে কর্মচারীরা বেশি টাকা বেতন পান।’
ঢাকা ওয়াসার আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘কর্মচারীদের এই ওভারটাইম ঢাকা ওয়াসার ঘাড়ে বিষফোড়ার মতো জেঁকে বসেছে। এমনও ঘটনা আছে, প্রতিদিন ডিউটি ৮ ঘণ্টা। কিন্তু ওই দিনই একজনের নামে ১৪ ঘণ্টা ওভারটাইমের বিল যোগ হয়েছে। এ নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলেই তোপের মুখে পড়তে হয়। হিসাব বিভাগের কর্মকর্তারা শ্রমিক নেতাদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে এ ব্যাপারে চুপ থাকেন।’
তিনি আরও জানান, ‘শ্রম আইন অনুযায়ী একজনের ওভারটাইম প্রতিদিন ৬ ঘণ্টার বেশি হতে পারে না। এছাড়া প্রতি ঘণ্টায় মূল বেতন স্কেলের আট ভাগের দেড়গুণ অর্থ ওভারটাইম হিসেবে একজন কর্মচারী পেতে পারেন। অথচ ঢাকা ওয়াসায় এ নিয়ম মানা হয় না। ওভারটাইমের ক্ষেত্রে দ্বিগুণ অর্থ নির্ধারণ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ফলে একজন কর্মচারীর দৈনিক কর্মঘণ্টার চেয়ে ওভারটাইম বেশি হয়।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৭০ সালের একটি বিশেষ চুক্তির ওপর ভর করে দীর্ঘদিন কর্মচারীদের ওই ওভারটাইম দিয়ে আসছে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। যদিও সামান?্য চুক্তির অজুহাতে ওয়াসায় মানা হয়নি অনেক নিয়মনীতি। এমন অনেক অভিযোগের সত্যতা মিলেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত একটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। ২০১৬ সালে এসব অভিযোগের সত্যতা পায়। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৯৭০ সালে ওয়াসাকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করাতে সাময়িক ওই ব?্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে এর গুরুত্ব থাকা উচিত নয়। আর ১৯৭০ সালে সংস্থার কাজের স্বার্থে দ্বিগুণ হারে ওভারটাইম দেয়ার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। কিন্তু অনেক কর্মচারীকে তিনগুণ বা তার অধিক হারে ওভারটাইম দেয়া হয়েছে, যা শ্রম আইন তো বটেই, ওই চুক্তিও ভঙ্গ করা হয়েছে। তাছাড়া ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের সভায় দ্বিগুণ হারে ওভারটাইম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হলেও তা আজও কার্যকর হয়নি। তাই এ মুহূর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের গোচরে এনে সরকারি অনুমোদন নেয়ার জন্য প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে তদন্ত কমিটি। আরও বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালের চুক্তি অনুসারে ঢাকা ওয়াসায় ২ হাজার ৫৫০ কর্মচারী ওভারটাইম ভাতা পান, কিন্তু গাড়িচালকদের জন্য একই বিধান প্রযোজ্য নয়। তাদের জন্য ১৯৮০ সালের সরকারি আদেশানুযায়ী ২৫০ ঘণ্টা ওভারটাইমের বিধান থাকা সত্ত্বেও তা মানে না ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার সাবেক এমডি (১৯৯৬-২০০৩) আজহারুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসায় জনবল কম হওয়ায় ওভারটাইম দিতে হয়। কিন্তু প্রশাসন থেকে জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নিলে সেটা বাস্তবায়নে শ্রমিক নেতারা বাধা দেন। এ কারণে ঢাকা ওয়াসায় ওভারটাইম বন্ধ করা সম্ভব নয়। আমার সময়ে একযোগে ৩ হাজার কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছিলাম, এরপরও অনেক পদ শূন্য ছিল। সেসব পদে লোকবল নিয়োগ করতে দেয়নি শ্রমিক নেতারা। কেননা তাদের নিজস্ব একটা হিসাব থাকে, কতজন জনবল ঘাটতি থাকলে তাদের ওভারটাইম ঠিক থাকবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘শ্রম আইন অনুযায়ী একজন শ্রমিক ১৬ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে পারবে না। ঢাকা ওয়াসায় শ্রমিকদের ওভারটাইম প্রদানের ক্ষেত্রে সেটা বাস্তবায়ন করলে কোনো কর্মচারী বিনা বেতনে কাজ করবেন না। তখন কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে শ্রমিক নেতাদের বাধাগুলো দূর হয়ে যাবে। এছাড়া সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে সব সরকারি সংস্থার জন্য এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করা হলে ঢাকা ওয়াসার ওভারটাইম বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার সময়ে ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলীর বেতনের সমান ওভারটাইম পেতেন তার গাড়িচালক। এখনকার চিত্র আরও খারাপ। একটি সরকারি সংস্থার এমন নিয়ম চলতে পারে না, এটা বন্ধে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ নেয়া দরকার।’

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/15013