৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, রবিবার, ১১:৪৫

লাশের সংখ্যা বাড়ছে

অভিবাসী মৃত কর্মীর ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না স্বজনরা

অভিবাসী মৃত কর্মীর লাশের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিদেশে কর্মস্থলে দুর্ঘটনা ও হৃদরোগে আক্রান্তসহ নানাভাবে অভিবাসী কর্মীরা মারা যাচ্ছেন। বিদেশে বাংলাদেশি মিশনগুলোর সংশ্লিষ্ট ইউংগুলো নিজ নিজ দেশের আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে মৃত অভিবাসী কর্মীদের লাশ দেশে পাঠাতে হিমশিম খাচ্ছে। আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দীর্ঘদিন বিলম্ব হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশের হাসপাতালগুলোর হিমাগারে মৃত অভিবাসীর লাশ পড়ে রয়েছে। মৃত অভিবাসী কর্মীদের অসহায় পরিবার পরিজনরা অনেকেই বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও ক্ষতিপূরণের অর্থ পাচ্ছেন না। ২০১৭ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মৃত অভিবাসী কর্মীর তিন হাজার ৩৮৭টি লাশ দেশে আনা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় হজরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুই হাজার ৯৭৩টি লাশ, চট্টগ্রাম শাহআমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৩৬৩টি লাশ এবং সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৫১ জন অভিবাসী কর্মীর লাশ এসেছে। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের নির্ভরযোগ্য সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। তবে বিদেশে কর্মরত অবস্থান কি পরিমাণ অভিবাসী কর্মী আহত, পঙ্গু বা অসুস্থ হয়ে দেশে ফিরছেন তার কোনো পরিসংখ্যান কেউ দিতে পারেনি। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি কমিউনিটি ও প্রবাসী রাজনৈতিক দল ও অংঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং হিতাকাক্সিক্ষরা নিজেদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতি বছর বেশ কিছু মৃত অভিবাসী কর্মীর লাশ, কর্মস্থলে আহত, পঙ্গু ও অসুস্থ্য অভিবাসী কর্মীদের চাঁদা তুলে এবং পকেটের অর্থ দিয়ে বিনা খরচে দেশে পাঠাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার চাপ, বিদেশে গিয়ে উচ্চ অভিবাসী ব্যয়ের টাকা তুলতে না পেরে দুশ্চিন্তায় পড়া, অভিবাসী কর্মীদের উপর অতিরিক্ত ট্যাক্স আরোপ, বিভিন্ন ক্যাটাগরির কাজের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি, বিভিন্ন দেশে সারাধণ ক্ষমায় অবৈধ কর্মীদের দেশে ফেরার চিন্তা, ভিসা পরিবর্তনের খরচ জোগাতে হিমশিম খাওয়া, কোম্পানি বন্ধ হয়ে দেশে ফেরার ভয় ও নিদ্রাহীনতা; এসব কারণে প্রবাসীরা হৃদরোগের ঝুঁঁকিতে থাকেন। পারিবারিক নানা দুশ্চিন্তাও তাদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মাধ্যমে মৃত অভিবাসী কর্মীর লাশ দেশের তিনটি বিমানবন্দরে পৌঁছার সাথে সাথে দাফন-কাফনের জন্য তাৎক্ষণিক ৩৫ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে মৃত অভিবাসী কর্মীর পরিবারের ওয়ারিশকেও দুই লাখ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে। একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তিরা বিদেশে গিয়ে মারা যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে নেমে আসছে দুর্বিসহ জীবন। ভিটেমাটি বিক্রি, চড়া সুদে ঋণ এবং গৃহপালিত গবাদিপশু বিক্রি করে পরিবারে সচ্ছলতা আনতে বিদেশে গিয়ে যারা লাশ হয়ে দেশে ফিরছেন তাদের নিঃস্ব পরিবারের সামাজিক নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিতকরণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরো বাস্তবমুখী উদ্যোগ নিতে হবে। যেসব সোনার ছেলেরা বহির্বিশ্বে গিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রেমিট্যান্স আয় করছেন, তাদের মধ্যে যারাই অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন সেসব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ভরণ-পোষণ এবং সন্তানদের বিনা খরচে পড়ালেখার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। এ ব্যাপারে যথাযথ কর্মসূচি গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে। জনশক্তি রফতানির সাথে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ মহল এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে, ২০০৫ সাল থেকে ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৩৩ হাজার ৩৪৫ জন মৃত অভিবাসী কর্মীর লাশ দেশে এসেছে। এর মধ্যে ঢাকা হজরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২৯ হাজার ৮৫৭ মৃত অভিবাসী কর্মীর লাশ, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তিন হাজার ৪৫ মৃত অভিবাসী কর্মীর লাশ এবং সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৪৪৩ জন মৃত অভিবাসী কর্মীর লাশ দেশে এসেছে। সূত্র মতে, ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মৃত অভিবাসী কর্মীদের অসহায় পরিবারের ওয়ারিশদের মাঝে ক্ষতিপূরণের, আর্থিক সহায়তা হিসেবে ৮৭ কোটি আট লাখ ৯৩ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। বিভিন্ন কারণে ২০১৭ সালে ২১৭ জন প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মী কুয়েতে মারা গেছেন। হৃদরোগে ও জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা বেশি হলেও কয়েকজন বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মারা যান। এর মধ্যে ২১৬ জনের লাশ দেশে পাঠানো হয়। নিহতের পরিবারের সম্মতিতে একজনকে কুয়েতে দাফন করা হয়। কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলর আবদুল লতিফ খান বলেন, গত বছর কুয়েতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অনেক বেশি বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বর্তমানে বেশির ভাগ লাশ বিনা ভাড়ায় দেশে পৌঁছে দিচ্ছে। কুয়েত সরকার দেশটিতে অবৈধ অভিবাসী কর্মীদের বিনা শাস্তিতে দেশে ফেরার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে। এতে কুয়েতে হাজার হাজার অবৈধ বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় দেশে ফেরার লক্ষ্যে আউট পাসের জন্য কুয়েতস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে জড়ো হচ্ছেন। এতে অনেক বাংলাদেশি কুয়েতে চরম হতাশায় ভুগছেন। কুয়েতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গত সপ্তাহে চার বাংলাদেশি প্রবাসীর মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে তাদের লাশ কুয়েতের স্থানীয় হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে এসব লাশ দেশে পাঠানো হবে। এদের মধ্যে ফেনীর দাগনভূঁইয়া উপজেলার উত্তর কৈখালী গ্রামের মকবুল মিয়ার ছেলে কালা মিয়া গত ২৭ জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা যান। একই উপজেলার ২ নং আজাদপুর ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামের বাসিন্দা কালাম গত ৩০ জানুয়ারি রাতে খাওয়া শেষে রুমে ফেরার সময় কুয়েতের হাসাবিয়া সবজি গলিতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। অপরদিকে, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার ঘোড়াদি গ্রামের সোনামিয়ার ছেলে মাঈন উদ্দিন গত ৩১ জানুয়ারি দুপুরে ডিউটি থেকে বাসায় ফিরে বিকেলে ঘুমাতে গেলে ঘুমের মধ্যে স্ট্রোক করেন। এ ছাড়া সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার চরখাই মান্দার গ্রামের ফখরুল ইসলামের ছেলে তুহেল আহম্মেদ একই দিন দিবাগত রাতে ঘুমের মধ্যে স্ট্রোক করে মারা যান। জাতীয় শ্রমিক লীগ মালয়েশিয়া শাখার সভাপতি নাজমুল ইসলাম ও সহ-সভাপতি শাহ আলম হাওলাদার গতকাল কুয়ালালামপুর থেকে জানান, ২০১৭ সালে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে কর্মরত সাত শতাধিক বাংলাদেশি কর্মী বিভিন্ন কারণে মারা যান। কুয়ালালামপুরস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের উদ্যোগে গত জানুয়ারি মাসে ৭১ জন মৃত কর্মীর লাশ, ফেব্রুয়ারিতে ৫৪ জন মৃত কর্মীর লাশ, মার্চে ৪৭ জন কর্মীর লাশ, এপ্রিলে ৬৩ জন মৃত কর্মীর লাশ, মে মাসে ৫৫ জন মৃত কর্মীর লাশ, জুনে ৫৩ জন মৃত কর্মীর লাশ, জুলাইয়ে ৬৭ জন মৃত কর্মীর লাশ, আগস্টে ৪৮ জন মৃত কর্মীর লাশ, সেপ্টেম্বরে ৫৪ জন মৃত কর্মীর লাশ, অক্টোবরে ৫৪ জন মৃত কর্মীর লাশ, নভেম্বরে ৭৭ জন মৃত কর্মীর লাশ ও ডিসেম্বরে ৭২ জন মৃত কর্মীর লাশ বিমান যোগে বিনা খরচে দেশে পাঠিয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় শ্রমিক লীগ মালয়েশিয়া শাখার উদ্যোগেও অবৈধ মৃত কর্মীর লাশ এবং অসহায় অসুস্থ্য ও কর্মস্থলে আহত, পঙ্গু কর্মীদের বিনা খরচে দেশে পাঠাতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে শ্রমিক লীগ নেতা শাহ আলম হাওলাদার উল্লেখ করেন। তিনি বিদেশে মৃত কর্মীদের অসহায় পরিবারকে আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির জন্য প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন। বায়রার সাবেক যুগ্ম মহাসচিব-১ আলহাজ আবুল বাশার অভিবাসী মৃত কর্মীর লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ইনকিলাবকে বলেন, বিদেশে গিয়ে কর্মীরা নানা দুশ্চিন্তায় ভোগায় অনেকেই হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। সউদী সরকার অভিবাসী কর্মীদের উপর নতুন করে উচ্চহারে ট্যাক্স আরোপ এবং দেশটিতে ১০-১২টি ক্যাটাগরিতে অভিবাসী কর্মীদের কাজ করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এতে করেও অনেক কর্মী প্রতিনিয়ত টেনশনে ভুগছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দূতাবাসগুলোর দুর্বলতার কারণে বিদেশে মৃত কর্মীদের অনেক অসহায় পরিবার তাদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ পেতে বছরের পর বছর দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। বায়রার সাবেক নেতা আলহাজ আবুল বাশার মৃত অভিবাসী কর্মীদের অসহায় পরিবার ও ওয়ারিশগণের ভরণপোষণ এবং এতিম
স¤প্রতি বাংলাদেশ বিমানের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক শাকিল মেরাজ এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সম্পূর্ণ বিনা ভাড়ায় ৮৬১ জন প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীর লাশ বহন করেছে বাংলাদেশ বিমান। এর মধ্যে কুয়েত থেকে ৯১ প্রবাসীর লাশ বিনা ভাড়ায় দেশে এনেছে বিমান।

https://www.dailyinqilab.com/article/115796/