২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৮:৪৮

উদ্বিগ্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা

অস্থিরতায় নানামুখী শঙ্কা

আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবারো ঘূর্ণিপাকের আবর্তে বাংলাদেশের অস্থির রাজনীতি!! নানা ধরনের অজানা আশঙ্কা সাধারণ মানুষের মনে দানা বাঁধছে বর্তমান এই অস্থির রাজনীতিকে ঘিরে। দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথ নিয়ে। রাজনীতির গতিপথ তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় থাকবে একথাটি বিশ্বাস করতে পারছেন না কেউই। ইতোমধ্যেই টেলিভিশনের টক শোতে এবং বিভিন্ন সভা সেমিনারে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন যথাযতভাবে অনুষ্ঠানের বিষয়ে নানা ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আশঙ্কা প্রকাশ করে চলেছেন।

আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী। বাস্তবতা হচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো একতরফা নির্বাচন আয়োজন করাটা এবার অনেক কারণেই সম্ভব হবে না বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এর অন্যতম প্রধান কারণ, দেশের প্রধানবিরোধী দল বিএনপি গত নির্বাচন বর্জন করে যে রাজনৈতিক ভুল করেছিল সেটা পরবর্তীতে গভীরভাবে উপলব্ধি করে তারা সেই অবস্থান থেকে সরে এসে যে কোন মূল্যে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, যদি শেষ পর্যন্ত বিএনপির প্রস্তাবিত সহায়ক সরকারের দাবি সরকার মেনে নাও নেয় তাহলেও বিএনপি প্রয়োজনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে হলেও নির্বাচনে যাবে এবং কোনভাবেই নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেবে না। মূলত বিএনপির এই যে কোন মূল্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটিই শাসক দল আওয়ামী লীগের জন্য রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে গিয়ে যদি সরকার বড় ধরনের কোন ভুল করে বসে এবং রাজনীতিতে লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরি করা না হয় তাহলে অতীতের বিভিন্ন সময়ের মতো আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত ও অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে ঘটনাপ্রবাহে সেটা নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।
অনেকেই আশঙ্কা করছেন রাজনীতিবিদরা যদি দেশের স্বার্থে অতিদ্রুত একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হন তাহলে রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতায় দেশে ভয়াবহ তৃতীয় শক্তির উত্থান হতে পারে, যেটা হলে সবচাইতে বেশী বিপদে পড়বেন রাজনীতিবিদরাই এবং অতিষ্ট দেশের সাধারণ জনগণও তখন সেই তৃতীয় শক্তিকেই স্বাগত জানাবে। স¤প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত একটি সেমিনারে বক্তব্য প্রদানকালে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এই ভয়াবহ তৃতীয় শক্তির উত্থানের আশঙ্কাটি করেছেন বেশ উদ্বেগের সঙ্গে। উক্ত সেমিনারে বদিউল আলম মজুমদার তার বক্তৃতায় বলেন, “আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা জনগণের চোখের ভাষা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন। মুখে গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও দেশের সার্বিক রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও সুশাসন এই দুটিরই অভাব অত্যন্ত প্রকট। একটি জাতীয় নির্বাচনের আগে সব দলের জন্য সমান অধিকার অর্থাৎ লেভেল প্লেইং ফিল্ড তৈরির প্রধান দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু বর্তমান সরকার সেই পথে হাঁটছে না। সরকারের আচরণে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে আমরা অশনিসঙ্কেত দেখতে পাচ্ছি। যদি সরকার যথাসময়ে যথাযথ ভূমিকা না নেয় এবং রাজনীতি যদি সহিংস হয়ে উঠে তাহলে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে ভয়াবহ তৃতীয় শক্তির উত্থান ঘটতে পারে এবং সেই তৃতীয় শক্তি মোটেও কাক্সিক্ষত রাজনৈতিক তৃতীয় শক্তি হবে না। আর এই ভয়াবহ তৃতীয় শক্তির উত্থান হলে সবার আগে সবচাইতে ভয়াবহ বিপদে পড়তে হবে দেশের রাজনীতিবিদদেরকেই যারা এই তৃতীয় শক্তিকে ক্ষমতায় আসার সুযোগ করে দিচ্ছেন”। ইনকিলাবের পক্ষ থেকে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের এই বক্তব্য ও আশঙ্কার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বদিউল আলম মজুমদার ইনকিলাবকে বলেন, “আমাদের রাজনীতির সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হচ্ছে ইতিহাস থেকে আমাদের রাজনীতিবিদরা কেউ কোন শিক্ষা নেন না। ওয়ান ইলেভেনের মতো একটি ভয়াবহ ঘটনার পরও আমাদের দেশের কোন রাজনীতিবিদই কোন শিক্ষা নেননি এবং সবাই অতীতের মতো একই ভূমিকায় অবতীর্ণ। আমাদের দেশে বর্তমানে যে রাজনীতি চলছে সেটা তো রাজনীতি নয় শুধুই ক্ষমতানীতি। একদলকে ক্ষমতায় থাকতেই হবে আরেক দলকে ক্ষমতায় যেতেই হবে। এই যদি হয় দেশের রাজনীতি তাহলে জনগণ কোথায় যাবে? আমি আশা করবো আমাদের রাজনীতিবিদরা নিজেদের স্বার্থ বাদ দিয়ে দেশ ও জনগণের কথা চিন্তা করে সঠিক ও গণতান্ত্রিক পথে রাজনীতিকে নিয়ে আসবেন। আর যদি সেটা তারা না করেন তাহলে ভয়াবহ একটা পরিস্থিতির মুখে তাদের পড়তে হতে পারে যেটা হয়তো তাদের চিন্তাচেতনায়ও নেই।”

ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন
খ্যাতিমান রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও তত্ত¡বাধয়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের কাছে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের ভয়াবহ তৃতীয় শক্তির উত্থানের আশঙ্কার ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, “বদিউল আলম সাহেব কোন পরিস্থিতির আঁচ করতে পেরে এই আশঙ্কার কথা বলেছেন সেটা তিনি নিজেই ভালো বলতে পারবেন। তবে এটা তো বেশ সহজেই অনুমান করা যায় রাজনীতিবিদরা যখন ব্যর্থ হবেন এবং যখন কোন সমস্যার সমাধান না করতে পারবেন তখন তো কাউকে না কাউকে কিছু একটা করতেই হবে। দেশ তো আর রাজনীতিবিদদের জন্য বসে থাকবে না। চল্লিশ বছর যাবৎই তো আমরা দেশটাকে নিয়ে এই ধরনের বিপদেই আছি শুধুমাত্র রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কারণে। যার ফলে ঘন ঘন মার্শাল ল’ এসেছে। আমরা কেউ মার্শাল ল’ চাই না। কিন্তু রাজনীতিবিদরা তো সেটা বুঝেন না। তারা মনে করেন শুধু তারাই সবকিছু বুঝেন আর শুধু তারাই দেশটির মালিক। আর আমরা সাধারণ জনগণ সবাই মূর্খ আর অবুঝ। আমরা যদি কেউ তাদেরকে ভালো কোন পরামর্শও দিতে চাই তাহলেও আমাদেরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলা হয় গাধা আর ক্ষমতালোভী। আসলে আমরা রাজনীতিবিদদেরকে এত বেশি প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছি যে, তারা আর কাউকে এখন মানুষই মনে করেন না। বর্তমানে দেশে যে রাজনীতি চলছে সেটা তো কোন রাজনীতিই না। প্রধান দুই দলের নেত্রী কেউ কারো সাথে কথা বলেন না। কেউ কারো সাথে সংলাপ করবেন না, কেউ কারো চেহারা দেখবেন না। এটা তো কোন রাজনীতিই হতে পারে না। রাজনীতি হচ্ছে সমস্যা সমাধানের একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। অথচ আমাদের বড় বড় নেতারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বলেন আর আচরণ করেন পুরোটাই অগণতান্ত্রিক। এর চেয়ে হাস্যকর আর দুর্ভাগ্যের বিষয় আমাদের দেশের জনগণের জন্য আর কিছু হতে পারে না। আমি যদি একজন আইজীবী হয়ে বলি যে, আমি কোন দিন আদালতেই যাব না তাহলে কি হবে? সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক নেতাদেরকে এক শ্রেণির দলীয় চাটুকার ও স্বার্থন্বেষী মহল এমনভাবে ঘিরে রেখেছে যে সেখান থেকে তারা চাইলেও আর বের হতে পারবেন না। এই কারণেই রাজনীতি বার বার ব্যর্থ হচ্ছে, গণতন্ত্র বিপদের মুখে পড়ছে এবং অরাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় আসার সুযোগ পাচ্ছে। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনিতি ইতোমধ্যেই যে সাংঘর্ষিক অবস্থার দিকে যাচ্ছে তাতে অনেকের মত আমি নিজেও গভীরভারে উদ্বিগ্ন এবং আমিও নানা ধরনের বিপদের আশঙ্কা করছি। তবে অতীতের মত আগামীতেও যদি রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কারণে কোন নতুন শক্তি ক্ষমতায় আসে তাহলে আমি সেই শক্তিকে তৃতীয় শক্তি হিসেবে না দেখে সম্মিলিত শক্তি হিসেবেই দেখব।”
ব্রিগেডিয়ার (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নানা ধরনের গুঞ্জন ও তৃতীয় শক্তির উত্থানের আশঙ্কা সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেনের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি ইনকিলাবকে বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অস্থির ও অসহিষ্ণু পরিবেশ বিরাজ করছে তাতে যে কোন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে তৃতীয় কোন শক্তির উত্থানের একটি আশঙ্কা সাধারণ মানুষের মনে সবসময়ই থাকে। অতীতেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিন্তু এই ধরনের ঘটনা একাধিকবার ঘটেছে এবং দেখা গেছে এই ধরনের ঘটনায় যে শক্তি ক্ষমতায় আসে তাদেরকে সাধারণ জনগণ ব্যাপকভাবে সমর্থনও জানায়। এর কারণ হচ্ছে দেশের রাজনীতি যখন সংঘাতপূর্ণ থাকে তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের সাধারণ জনগণ। এমন অবস্থায় হঠাৎ করে নতুন কোন শক্তি ক্ষমতায় আসলে জনগণ তাদেরকে সমর্থন দেয় এই ভেবে যে সংঘাতময় ও অনিশ্চয়তার রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে অন্তত তারা নিস্তার পেয়েছে। বিগত সময়ে ওয়ান ইলেভেন সরকার ক্ষমতায় আসার পর শুরুতেই দেশের জনগণ কিন্তু তাদেরকে দারুণভাবে সমর্থন করেছিল এবং স্বাগত জানিয়েছিল। শুরুর অবস্থা দেখে তো মনে হয়েছিল যেন ওয়ান ইলেভেন সরকারই ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সরকার। আসলে রাজনীতির ওপর যখন সাধারণ মানুষ খুব বেশি হতাশ হয়ে যায় এবং রাজনীতিবিদরাও জনগণ ও দেশের স্বার্থের বিষয়টি উপেক্ষা করে নিজেরা অতিমাত্রায় আত্মকলহ বিবাদ ও সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন ঐ ধরনের পরিস্থিতিতেই সাধারণত অস্বাভাবিক বা তৃতীয় শক্তির সরকারগুলো ক্ষমতায় চলে আসে। আর এই ধরনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শুধু অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রেই নয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সংস্থা ও শক্তি নেপত্থে ভূমিকা রাখে। অতীতে আমরা এই ধরনের অনেক ভূমিকা দেখেছি। তবে একথাটি মানতেই হবে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতবারই এই ধরনের অস্বাভাবিক বা তৃতীয় শক্তি ক্ষমতায় এসেছে তার প্রতিটারই সুযোগ করে দিয়েছেন শুধু এদেশের রাজনীতিবিদরাই। সাধারণ জনগণ কখনোই তাদেরকে ডেকে আনেননি। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ ও অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে তাতে রাজনীতিবিদরা যদি ভুল করেন তাহলে অতীতের মতো আগামীতেও তৃতীয় শক্তির উত্থানের আশঙ্কা থাকতেই পারে এবং এই ধরনের কিছু হলে সেটা মোটেও অস্বাভাবিক হবে না।”

https://www.dailyinqilab.com/article/115547