২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, শুক্রবার, ৮:৩১

মিয়ানমার সেনাবাহিনী গণহত্যা চালিয়েছে : জাতিসঙ্ঘের বিশেষ রেপোর্টিয়ার

মিয়ানমার সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসঙ্ঘের বিশেষ রেপোর্টিয়ার ইয়াঙ্গি লি। মিয়ানমারে নিষিদ্ধ ঘোষিত ইয়াঙ্গি লি সম্প্রতি বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড সফর শেষে গতকাল দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে এক সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ এনে বলেন, গ্রহণযোগ্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল বা আদালত ছাড়া রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নৃশংসতাকে গণহত্যা হিসেবে নিশ্চিতভাবে ঘোষণা দেয়া যায় না। তবে গণহত্যার চিহ্নগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি। এর ওপর ভিত্তি করে মিয়ানমারে গণহত্যা চালানো হয়েছেÑ এই উপসংহারে পৌঁছা যায়।

এ দিকে মার্কিন বার্তা সংস্থা এপির অনুসন্ধানে মিয়ানমারে নতুন পাঁচটি গণকবর চিহ্নিত হয়েছে। রাখাইনের গু দার পাইন এলাকায় এ পাঁচ গণকবরে চার শতাধিক মানুষের লাশ রয়েছে বলে আশঙ্কা তাদের। সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ২৪ জনেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাাৎকারের ভিত্তিতে নতুন গণকবরগুলোর সম্পর্কে নিশ্চিত হয় এপি। নিপীড়নের অভিযোগকারীদের কেউ কেউ নিজেদের দাবির পে সময়-চিহ্নিত ভিডিও সরবরাহ করেছে। পরে নির্দিষ্ট ওই অঞ্চলে গিয়ে অনুসন্ধানের চেষ্টা করলেও প্রবেশাধিকার সংরতি পাননি এপির সংবাদ কর্মীরা।
স্থানীয় কর্তৃপ অবশ্য গণকবর থাকার কথা অস্বীকার করেছে। সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পায়নি এপি। তবে প্রত্যদর্শীদের সাাৎকারের সাথে মিলিয়ে নির্ধারিত গ্রামগুলোর স্যাটেলাইট ইমেজ সংগ্রহ করেছে তারা। সংগৃহীত ছবির সাথে প্রত্যদর্শীদের বর্ণনার মিল পাওয়া যায়। সবমিলিয়ে গণকবরের ব্যাপারে নিশ্চিত হয় এপি।
এপিকে যারা সাাৎকার দিয়েছেন, তারা প্রত্যেকেই গু দার পাইনের উত্তরাঞ্চলীয় প্রবেশ পথের মূল রাস্তায় তিনটি গণকবর দেখেছেন। বেশ কয়েকজন প্রত্যদর্শী নিশ্চিত করেছেন, গ্রামের পার্বত্য এলাকার কবরস্থানের কাছে আরো বড় দু’টি গণকবর রয়েছে। এপির প্রতিবেদককে সরবরাহকৃত ভিডিওতে তারা ওই অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান নিশ্চিত করেছেন। প্রত্যদর্শীরা বলছেন, সৈন্যরা সেখানে রোহিঙ্গাদের একত্র করে হত্যা করেছে। এ ছাড়া গ্রামজুড়ে বেশ কিছু ছোট ছোট গণকবর থাকার কথাও জানিয়েছেন তারা।
এপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গু দার পাইনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় কতজন মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে গ্রামটি ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে স্থানীয় সম্প্রদায়ের নেতারা এখন পর্যন্ত ৭৫ জনের মৃত্যুর তথ্য সংগ্রহ করেছেন। অবশ্য গ্রামবাসীর আত্মীয়দের সাাৎকার এবং গণকবর ও আশেপাশে তাদের দেখতে পাওয়া মৃতদেহের সংখ্যা বিচার করে নিহতের সংখ্যা চার শ’র বেশি হতে পারে বলে দাবি করা হচ্ছে।

প্রত্যদর্শীরা জানিয়েছেন, গত বছর ২৭ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের একটি এলাকায় ঝড়ের মতো প্রবেশ করে অন্তত ২০০ সেনা। মোহাম্মদ শাহ নামে এক কৃষক ও দোকানদার জানান, তিনি একটি নারকেল গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন। তার চোখের সামনেই সেনাসদস্যরা রোহিঙ্গাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিতে থাকে। যারা পালানোর চেষ্টা করছিল তাদের গুলি করা হয়। তাদের তাণ্ডবে ধ্বংস হয় বৌদ্ধদের বাড়িও। সেনাদের অনেকের মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা ছিল।
গত মাসে প্রথমবারের মতো রাখাইনের ইনদিন গ্রামে দশ রোহিঙ্গাকে হত্যার স্বীকারোক্তি দেয় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। কিন্তু গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার গু দার পাইনের এসব গণকবর নিয়ে তাদের মন্তব্য জানতে এপির প থেকে কয়েক দফা যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। স্থানীয় পৌরসভা বুথিডংয়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তা তুন নাইন এপিকে বলেছেন, গণকবর থাকার বিষয়ে কিছু জানেন না তারা। আর মিয়ানমার সরকার সবসময়ই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিধনযজ্ঞের কথা অস্বীকার করে আসছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার মতে, গত বছর আগস্টের সহিংসতার পর বাংলাদেশে ছয় লাখ ৫৫ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে। গত বছর ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস জানিয়েছিল, সেনাবাহিনীর নিধনযজ্ঞে এক মাসেই ছয় হাজার ৭০০ রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছেন। রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়কে বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী বলে বিবেচনা করা হয়।

গত ২৫ আগস্টের পর রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। জাতিসঙ্ঘ এই ঘটনাকে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞের পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। একে নিধনযজ্ঞ বলেছে যুক্তরাষ্ট্রও। এই ঘটনার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনার মুখে পড়েন দেশটির নেত্রী অং সান সু চি।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ফিল রবার্টসন বলেন, বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের এখনই কঠোর হওয়া উচিত এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তিনি বলেন, এপি প্রতিবেদন দেখে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/290394