নিপীড়ন বন্ধ করে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বান * এক দশকে কঠোরতম বিবৃতি * স্বাগত জানাল বাংলাদেশ
৮ নভেম্বর ২০১৭, বুধবার, ১০:২৬

মিয়ানমারকে সর্বসম্মত বার্তা নিরাপত্তা পরিষদের

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। এ জন্য বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের সঙ্গে কাজ করতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। সোমবার নিরাপত্তা পরিষদের এক সর্বসম্মত বিবৃতিতে এ আহ্বান জানানো হয়। এ ছাড়া রাখাইনে সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানিয়ে সামরিক বাহিনী যেন আর বাড়াবাড়ি না করে সে জন্য সতর্ক করে দেয়া হয়।

বিবৃতিতে রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে শক্তি প্রয়োগ করে ভীতিকর অবস্থা তৈরি করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে নারী-পুরুষ-শিশুদের। নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা চালানো হচ্ছে এবং ঘরবাড়ি ধ্বংস ও জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে।

তবে চীন ও রাশিয়ার বিরোধিতার কারণে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব (রেজল্যুশন) পাসের পরিকল্পনা বাতিল করতে হয়েছে পরিষদকে। প্রস্তাব পাসের পরিবর্তে একটি সর্বসম্মত বিবৃতি দেয় নিরাপত্তা পরিষদের চেয়ারম্যান সেবাস্তিয়ানো কারডি। এটাকে গত এক দশকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদের সবচেয়ে কঠোর বিবৃতি বলে মন্তব্য করেছে বার্তা সংস্থা এপি। ব্রিটেন ও ফ্রান্স গত মাসে প্রস্তাবটির খসড়া তৈরি করেছিল। এতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশিরভাগ সদস্য দেশের সম্মতি ছিল। তবে প্রস্তাবে যেসব বিষয় ছিল সেগুলো প্রায় অবিকলভাবেই বিবৃতিতে এসেছে। বিবৃতি হচ্ছে একটি আহ্বান। সেটা মানা বা না-মানা সংশ্লিষ্ট দেশের (এ ক্ষেত্রে মিয়ানমার) মর্জির ওপর নির্ভর করে। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের কোনো প্রস্তাব পালন করা সাধারণত বাধ্যতামূলক মনে করা হয়।

মূল খসড়াতেও অবশ্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কোনো হুমকি ছিল না, যেটি অনেক মানবাধিকার সংগঠন দাবি করে আসছে।

এএফপি জানায়, নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতার অধিকারী চীন বলছে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাস সংকটের জবাবে কোনো উপযুক্ত পদক্ষেপ নয়। বহু বছর ধরেই মিয়ানমারের বড় আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষক চীন। তবে শেষ পর্যন্ত চীন বিবৃতিতে সমর্থন দেয়ায় খুশি প্রস্তাব উত্থাপনকারীরা। জাতিসংঘে নিযুক্ত ব্রিটিশ উপ-রাষ্ট্রদূত জোনাথন অ্যালেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিষয়বস্তু। আমার মনে হয় অত্যন্ত কঠোর ও সর্বসম্মত বিবৃতি এখানে একটি আসল পুরস্কার।’

ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত ফ্রাঁসোয়া দেলাতেঁ বলেন, রাখাইনে জাতিগত নিধন বন্ধে এটা একটি ‘শক্তিশালী ও সর্বসম্মত বার্তা’। তিনি বলেন, এটা আমাদের সময়কালে সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকট।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রাখাইন রাজ্যে যাতে সেনাবাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ বন্ধ করা হয়, মিয়ানমার সরকারের প্রতি সেই আহ্বান জানাচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদ। সেই সঙ্গে রাখাইনে বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে এবং মানবাধিকার রক্ষার অঙ্গীকার ও দায় পূরণে মিয়ানমার সরকারকে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানানো হয়েছে। আইনের শাসন ও মানবাধিকার নিশ্চিত করে সব নাগরিককে রক্ষা করা যে রাষ্ট্রের দায়িত্ব, সে কথাও মিয়ানমার সরকারকে মনে করিয়ে দিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদ। সেই সঙ্গে রাখাইনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানানো হয়েছে মিয়ানমার সরকারের প্রতি।
অন্যদিকে রাখাইনে মানবিক সংকট এবং বাংলাদেশমুখী শরণার্থীর স্রোত বাড়তে থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করে নিরাপত্তা পরিষদ বলেছে, এ পরিস্থিতি পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। রাখাইনে অবিলম্বে নির্বিঘেœ মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর এবং সাংবাদিকদের সেখানে যাওয়ার সুযোগ দিতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের এ সংস্থা। পাশাপাশি জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসকে ৩০ দিন পর মিয়ানমারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতিকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এতে রোহিঙ্গারা ভরসা পাবেন যে, তাদের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগে নিরাপত্তা পরিষদ চোখ বুঝে নেই। তবে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত হাউ দো সুয়ান দাবি করেন, মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিবৃতিটি দেয়া হয়েছে। এতে মিয়ানমারের ওপর অযাচিত রাজনৈতিক চাপ দেয়া হয়েছে।

নিরাপত্তা পরিষদ এমন সময় এ বিবৃতিতে একমত হল যখন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে ম্যানিলায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। চলতি সপ্তাহের এ সম্মেলনে রোহিঙ্গা সংকট সবচেয়ে গুরুত্ব পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। জোট নেতাদের পাশাপাশি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এতে অংশ নেবেন। বৈঠক শেষে তিনি তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য মিয়ানমার পাঠাচ্ছেন।

রোহিঙ্গা সংকটের ২ মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও নিরাপত্তা পরিষদ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অস্ত্র অবরোধ ও রোহিঙ্গা নিপীড়নকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানাচ্ছে তারা।

শুক্রবার হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে বলেছে, নিরাপত্তা পরিষদের উচিত রাখাইনে অগ্নিসংযোগ, খুন, ধর্ষণ, লুটপাট ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সোপর্দ করা। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের পদক্ষেপে চীনের সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

স্বাগত জানালেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী : রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সর্বসম্মত বিবৃতিকে স্বাগত জানিয়েছে ব্রিটেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন। তিনি এ নিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিটি প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটিশ সরকারের ওয়েবসাইটে। এতে বরিস জনসন বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে তার বিরুদ্ধে এককণ্ঠে কথা বলেছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। আমি এতে সন্তোষ প্রকাশ করছি। ওই সহিংসতায় অবর্ণনীয় মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়ে কমপক্ষে ৬ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এখনও পরিস্থিতি হতাশাজনক।

বরিস জনসন বলেন, সব বেসামরিক মানুষকে সুরক্ষা দিতে, তাৎক্ষণিকভাবে সহিংসতা বন্ধ করতে ও দুর্গতদের কাছে জরুরি মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেয়ার অনুমতি দিতে মিয়ানমারের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি বারবার আহ্বান জানিয়েছে ব্রিটেন। আমাদের সেই আহ্বানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। তারই পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা পরিষদ ঐতিহাসিক ‘প্রেসিডেন্সিয়াল স্টেটমেন্ট অন বার্মা’ নামের বিবৃতি দিয়েছে। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি সামনে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেবেন- এ জন্য আমি তাকে উৎসাহিত করি।

বরিস জনসন আরও বলেন, বাংলাদেশ সরকারের কাজের ভূয়সী প্রশংসা করি আমি। শরণার্থীরা যাতে জরুরি সহায়তা পান তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্প্রতি যে চুক্তি হয়েছে তাকে স্বাগত জানায় ব্রিটেন। আমি আশা করি শরণার্থীদের স্বেচ্ছা, নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারে ফেরাকে এখন তারা দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে পারবেন। শরণার্থীদের ফেরার জন্য যথাযথ পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে মিয়ানমারের নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের।

 

https://www.jugantor.com/online/international/2017/11/08/62899/