২৮ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৯:১৭

চালের মূল্য আরো বৃদ্ধির শঙ্কা

বন্যায় বোরো ফসলের পর এবার অকাল বৃষ্টিতে সারাদেশে আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নিম্ন চাপের প্রভাবে হঠাৎ বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ার ফলে ৪৮ জেলার ২ লক্ষাধিক হেক্টর জমির ধান নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার মধ্যে শতকরা প্রায় ১৫ ভাগ সম্পূর্ণ ও ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ আংশিক ক্ষতি হয়েছে। বাস্তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি বলে কৃষক ও মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে। অবশ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ গোলাম মারুফ মুঠোফোনে দাবি করেন, খুব বেশি ক্ষতি হয়নি।

সারাদেশে বোনা ও রোপা মিলে মোট ৫৫ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে আমন আবাদ হয়। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ও আংশিক ক্ষতির পরিমাণ সামান্য। মাঠপর্যায়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না কারার শর্তে বলেন, আমাদের কাছে যে খবর আছে তাতে সারাদেশে ৪৮টি জেলায় ২ লাখ ১৫ হাজার হেক্টর জমির ধান আক্রান্ত হয়। এতে উৎপাদনে ঘাটতি হলে চালের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমন আবাদের শুরুর দিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বক্তব্য ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অকাল বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ায় নওগাঁ, কুষ্টিয়া, বগুড়া, মৌলভীবাজার, যশোর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, নাটোর, পিরোজপুর, বাগেরহাট, ভোলা, ঝালকাঠি, মাগুরা, নড়াইল, ফরিদপর, রাজশাহী ও নোয়াখালিসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কমবেশি ক্ষতি হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী বোরো’র ক্ষতির পর এবার আমন চাষে যে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তা পূরণ হবে না। বন্যায় বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ার পর চালের বাজার লাফিয়ে বেড়েছে। এবার আমনের ক্ষতির পরও চালের বাজারে ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। এ ছাড়া হেমন্তের শুরুতে এমন বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ার ফলে সবজি চাষেও বিরূপ প্রভাব পড়বে। ইতোমধ্যে সবজির দাম অনেক বেড়ে গেছে। বৃষ্টির ফলে শীতের সবজির যে আগাম চাষ হয়েছিল তা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই আগামী মাস দু’য়েক সবজির বাজার চড়া থাকবে কৃষিবিদরা এমনটাই মনে করছেন।

সারাদেশে নিম্নচাপের প্রভাবে ৩ দিনের অবিরাম বর্ষণ ও ঝড়ো হাওয়ায় রোপা আমনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষকের কথা ‘এই বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া পাকা ধানে মই দিয়েছে’। চোখের পলকে মাঠের পাকা ধান পড়ে গেছে মাটি ও কাদাপানিতে। এছাড়া অনেক জমিতে ধানের কেবল শীষ বেরুচ্ছে এ অবস্থায় কাদাপানিতে লেপ্টে ও পানিতে ডুবে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। এ ক্ষতি অপূরণীয়। দুর্যোগে কৃষকের সোনালী স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ হয়ে গেছে। অকাল বৃষ্টি শুধু রোপা আমন ধানের ক্ষতি করেনি, সবজিরও ক্ষতি হয়েছে বিরাট। তেল ও ডাল জাতীয় ফসল আবাদ হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যেসব মাঠের ধান সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তা সিংহভাগই চর বা বিলাঞ্চলের। শুধু তাই নয়, অকাল বর্ষণের আগেও একদফা বাদামী ফড়িংসহ পোকা মাকড়ের আক্রমণে রোপা আমন ধানের বেশ ক্ষতি হয়। আবাদ ও উৎপাদনে নানা সমস্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে গিয়ে কৃষকরা রীতিমতো দিশেহারা। মেরুদন্ড সোজা করে তারা দাঁড়াতে পারছেন না। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বোরোতে ব্লাস্ট ও পাহাড়ী ঢলের কারণে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। যার জেরে চালের মূল্য বেড়ে যায় অস্বাভাবিক। আরেক খাদ্যশস্য গমের উৎপাদনও মার খেয়েছে। আশা করা হয়েছিল রোপা আমনের ফলন আশানুরূপ হলে চালের মূল্য আসবে সহনীয় পর্যায়ে। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতির কারণে রোপা আমনেও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে না, যার কারণে উৎপাদন ঘাটতির আশঙ্কা প্রবল। অথচ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ক্ষতির বিষয়টি বেমালুম চেপে যাচ্ছে। সুত্রমতে, পর পর প্রধান দু’টি আবাদ ও উৎপাদনের ক্ষতির ধাক্কা সামলানো কঠিন। তাই বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ মহলের অভিমত, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ আমন উৎপাদনের ঘাটতিতে আরেক দফা চালের মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা থাকছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশের ৪৮টি জেলার ২ লক্ষাধিক হেক্টর জমির ধান আক্রান্ত হয় অকাল বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ায়। যার মধ্যে শতকরা প্রায় ১৫ ভাগ সম্পূর্ণ ও ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ আংশিক ক্ষতি হয়েছে। বাস্তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি বলে কৃষক ও মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে। অবশ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ গোলাম মারুফ দাবি করেন, খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। তার কথা, বৃষ্টির পর ধানের জমি থেকে পানি দ্রæত সরে গেছে। মাটিতে পড়ে যাওয়া ধান ঝুঁটি বেঁধে খাড়া করানো হয়। বিভিন্ন জেলার রোপা আমনের ক্ষয়ক্ষতির সচিত্র প্রতিবেদন মিডিয়ায় প্রকাশ হচ্ছে অথচ আপনি দাবি করছেন খুব বেশি ক্ষতি হয়নি? এর জবাবে মহাপরিচালক বলেন, ক্ষতির আশঙ্কা ছিল প্রবল। কিন্তু মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তা, কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের সমন্বিত উদ্যোগে এবং নতুন করে বৃষ্টি না হওয়ায় ধান রক্ষা করা গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ফিল্ড সার্ভিস উইং এর পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল হান্নান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, রোপা আমনের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করা হচ্ছে। জেলা ও উপজেলা থেকে যে খবর পাচ্ছি তাতে ক্ষতি তেমন হয়নি। কৃষকরা বলছেন বিল এলাকার সব ধান নষ্ট হয়ে গেছে, আর আপনি বলছেন ক্ষতি হয়নি-এর জবাব না দিয়ে তিনি জেলা ও উপজেলার তথ্য নিতে খুবই ব্যস্ত আছেন বলে জানান।

অভিযোগ রয়েছে, একশ্রেণীর কৃষি কর্মকর্তা মাঠে নামেন না। দুর্যোগসহ বিভিন্ন সমস্যায় তোলপাড় সৃষ্টি হলে তখন একটু নড়েচড়ে বসেন। তাও অনেকক্ষেত্রে তড়িঘড়ি গোজামিল দিয়ে উপর মহলকে তথ্য দেওয়া হয়। আবার ভিন্ন চিত্রও আছে। অনেক কৃষি কর্মকর্তা দিনরাত মাঠে নেমে পরিশ্রম করে আবাদ ও উৎপাদনের তদারকি করেন, কৃষকদের দেন পরামর্শ। প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতেও কার্পণ্য করেন না। তবে চাকরির ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে তাই নামপ্রকাশ করতে নিষেধ করেন।
কুষ্টিয়ার বিলাঞ্চলের রোপা আমন ধানের ক্ষতির কথা উল্লেখ করে রোপা আমন চাষি তবারক হোসেন জানান, তার দেড় বিঘা জমিতে ধান ছিল। ধানে পাক ধরেছিল। অনেক স্বপ্ন ছিল চালের মূূল্যবৃদ্ধির কারণে লাভবান হবেন। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ স্বপ্ন ধূলিস্মাৎ হয়ে গেছে। তার প্রায় সম্পূর্ণ ধান নষ্ট হয়ে গেছে। তার মতো যশোরসহ বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক জানান, ‘আমরা আশা করেছিলাম বর্তমানে ধান ও চালের দামও বেশি। তাই ধান আবাদে আর্থিকভাবে বেশি লাভবান হবো। কিন্তু আশা পূর্ণ হলো না।’

একজন কৃষি বিশেষজ্ঞের মতে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে উৎপাদন ঘাটতি মোকাবেলা করতে কৃষিপরিকল্পনা নেওয়া জরুরি। খাদ্যশস্যের উৎপাদন কীভাবে বাড়ানো যায় তার চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগুতে হবে। গম, বোরো, রোপা আমন, সবজি উৎপাদন ঘাটতি বিরাট। এই ঘাটতি কীভাবে পূরণ করা কিংবা ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যায় তার উপায় খুঁজতে হবে। কারণ এমনিতেই প্রতিবছর আবাদী জমি কমছে, খাদ্য নিরাপত্তার ঝঁকিতে পড়ছে দেশ।

https://www.dailyinqilab.com/article/101793