১৮ অক্টোবর ২০১৭, বুধবার, ১১:০০

আর কত লোকসান রেলে

প্রতিবছর ভাঙছে আগের রেকর্ড

নতুন রেলপথ নির্মাণ, কোচ ও ইঞ্জিন কেনায় বরাদ্দ বাড়লেও রেলে লোকসান অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। নতুন বেতন কাঠামো চালু হওয়ায় ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায় বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে।

লোকসান ঠেকাতে পাঁচ বছরের ব্যবধানে দুই দফায় যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল। তাতে আয় কিছুটা বাড়লেও ব্যয় বেড়েছে কয়েক গুণ। তাই কিভাবে আয় আরো বাড়িয়ে লোকসান কমানো যায় তা নিয়ে চিন্তায় আছেন রেলের নীতিনির্ধারকরা। এ অবস্থায় রেলের বেশির ভাগ প্রকল্পগুলোতে ঋণ দেওয়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এখন আবার রেলে ভাড়া বাড়ানোর জন্য চাপ দিচ্ছে।
আয় বাড়াতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ টিকিট ছাড়া যাত্রী পরিবহন ঠেকাতে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা, বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণে জরিমানা বাড়ানো, টিকিট ছাড়া রেলস্টেশনে ঢোকা বন্ধ আরো জোরদার করার পরিকল্পনা নিচ্ছে।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি কিছুদিন আগে দায়িত্ব নিয়েছি। তারপর এ নিয়ে রেলের পরিচালনা ও হিসাব শাখাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছি। যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ভাড়া আগে একবার বাড়ানো হয়েছিল। তাতে লোকসান কমেনি।

আমরা বিনা টিকিটে যাত্রী পরিবহন কমিয়ে আনতে উদ্যোগ নিচ্ছি। তাতে প্রায় ১০ শতাংশ আয় বাড়ানো সম্ভব হবে। আয়ের অন্য উত্সগুলোর দিকেও তদারকি বাড়ানো হবে।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে দেশের ১০টি রেলস্টেশনে টিকিট ছাড়া যাত্রী পরিবহন বন্ধ করতে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে। নির্বাহী হাকিমের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা বাড়ানো হবে। জরিমানা বাড়ানোর উদ্যোগও নেওয়া হবে। রেলের জমিতে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেও আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিতে (পিপিপিতে) হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জোর দেওয়া হচ্ছে।

স্বাধীনতার পর থেকে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সড়ক কেন্দ্র করে। দেশে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীনেই নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ২১ হাজার কিলোমিটার সড়কপথ। অথচ রেলপথ তিন হাজার কিলোমিটারেরও নিচে।

রেলপথ আছে দুই হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার। স্বাধীনতার পর ৩০০ কিলোমিটার শাখা রেলপথ বন্ধ হয়েছিল। এখন নতুন রেলপথ নির্মাণের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ চলছে। ঢাকা-সিরাজগঞ্জ, ঢাকা-রংপুরসহ বিভিন্ন রুটে নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। তবে নতুন ও পুরনো সব ধরনের ট্রেনে বিনা টিকিটে যাত্রী পরিবহন কমেনি। তা রোধ করে রেলের আয় বাড়াতে কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারিও তেমন দেখা যায় না।

বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্যানুসারে, গত অর্থবছরে রেলের আয় হয়েছে এক হাজার ৩০৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ব্যয় হয়েছিল দুই হাজার ৫৩২ কোটি ৪২ লাখ টাকা। একই সময়ে লোকসান ছিল এক হাজার ২২৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা। তার আগের অর্থবছরে (২০১৫-১৬) আয় হয়েছিল এক হাজার ২৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, ব্যয় হয়েছিল দুই হাজার ২২৯ কোটি ২২ লাখ টাকা। সেবার লোকসান হয়েছিল এক হাজার ২০৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আয় ছিল ৯৫৬ কোটি ১২ লাখ টাকা, ব্যয় হয়েছিল এক হাজার ৮২৭ কোটি ২৭ লাখ টাকা। লোকসান ছিল ৮৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা।

জানা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রেলের আয় ছিল ৯৩১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, ব্যয় হয়েছিল এক হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। সে বছর লোকসান ছিল ৮০৩ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে সংস্থাটির আয় ও ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৮০৪ কোটি ও এক হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। ওই বছরে রেলে লোকসান ছিল ৮৮১ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে ৬২৯ কোটি টাকা আয় হলেও ব্যয় হয়েছিল এক হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা। লোকসান হয়েছিল এক হাজার ৫০ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে রেলে লোকসান হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

বাংলাদেশ রেলওয়ের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, আগের চেয়ে রেলের বিভিন্ন পথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন বাবদ আয় বাড়ছে। যেমন ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যাত্রী পরিবহনে রেলের আয় হয়েছিল ৭৮৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা এবং পণ্য পরিবহনে আয়ের পরিমাণ ছিল ২৬৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন বাবদ সংস্থাটির আয়ে যোগ হয়েছিল যথাক্রমে ৫৯৬ কোটি ৪৩ লাখ ও ১৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে আয় আগের চেয়ে বেড়েছে ভাড়ার হার বাড়ানোয়। এ ছাড়া বিভিন্ন পথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনও বেড়েছে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও লোকসান কমছে না। উল্টো দিন দিন তা বাড়ছেই। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন বেতন কাঠামো প্রবর্তনের পর থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা এত বেড়েছে যে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন বাবদ বেড়ে যাওয়া আয় তার তুলনায় খুবই কম।

১৯৯২ সালের পর টানা দুই দশক রেলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে ভাড়া বাড়ানো হয়নি। ১৯৯২ সালে নির্ধারিত ভাড়া ২০ বছর পর ২০১২ সালের ১ অক্টোবর থেকে ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে কার্যকর করা হয়েছিল লোকসান কমাতে। অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল প্রবর্তনে আয়-ব্যয়ের ব্যবধান বেড়ে যাবে যুক্তিতে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রেলে ভাড়া ৭ থেকে ৯ শতাংশ বাড়ানো হয়।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল প্রবর্তনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ছাড়াও রক্ষণাবেক্ষণে খরচ বেড়ে যাওয়ায় লোকসানের আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছিল রেল। নতুন বেতন স্কেল কার্যকর হওয়ায় ওই সময় বেতন-ভাতা বাবদ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ছাড়াও রক্ষণাবেক্ষণ ও আনুষঙ্গিক কাজে ২০০ কোটি টাকা ব্যয় বেড়ে যায়।

রেল সূত্রে জানা গেছে, এডিবির শর্ত অনুসারে, প্রতিবছর ট্রেনে ভাড়া বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ট্যারিফ কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। স্থায়ী ট্যারিফ নির্ণয় পদ্ধতি প্রবর্তনের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বিদেশি পরামর্শকরা বলেছেন, মুদ্রাস্ফীতি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ইত্যাদি খাতে ব্যয় বাড়ায় প্রতিবছর রেলওয়ের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।

রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, কোনো ধরনের লক্ষ্য ছাড়াই রেলওয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে। তাতে রেলে স্বাধীনতার পর প্রতিটি অর্থবছরেই লোকসান হয়েছে। এখন তা বেড়েছে অষ্টম বেতন কাঠামো চালুর ফলে। অপেক্ষাকৃত বেশি লাভ হলেও রেলে পণ্য পরিবহনে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

রেলওয়ের হিসাব অনুসারে, প্রতি কিলোমিটারে যাত্রীপ্রতি রেলের আয় গড়ে ৫৬ পয়সা, ব্যয় এক টাকা ৫২ পয়সা। পণ্য পরিবহনে প্রতি টনে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ২২ পয়সা, আয় দুই টাকার বেশি। কিন্তু পর্যাপ্ত ইঞ্জিনের অভাব, বগি সংকট, পণ্য পরিবহনের দীর্ঘ সময় অপচয়ে পণ্য পরিবহন আশানুরূপ নয়। তাতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহও কমছে। ব্যবসায়ীরা ট্রেন ছেড়ে ট্রাকের ওপর বেশি ভরসা পাচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেশির ভাগ জেলায় রেলপথ থাকলেও চাল, সবজি ও শিল্পের কাঁচামাল পরিবহনের জন্য তা ব্যবহার হচ্ছে না।

পণ্য পরিবহনে রেলের ব্যবসা বাড়াতে কম্পানি আইনের আওতায় আলাদা কনটেইনার করপোরেশন গঠনের সুপারিশ করেছে এডিবি। পরিবহন খাতের বিশিষ্ট গবেষক ড. সামছুল হক বলেছেন, দেশে নতুন ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে। সেগুলোর সঙ্গে রেলপথের শাখা পথ নির্মাণের সুপারিশ করছি। এগুলো বাস্তবায়ন হলে রেলে পণ্য পরিবহন বাড়বে।

এদিকে ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়ায় অন্যান্য দেশে বৈদ্যুতিক রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে তাতে আগ্রহ নেই রেলের শীর্ষ কর্মকর্তাদের। যেমন ভারতে অর্ধেকেরও বেশি রেলপথ ইলেকট্রিক ট্র্যাকশনে রূপান্তর করা হয়েছে। ২০১২ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ২২ কিলোমিটার রেলপথ বৈদ্যুতিক ট্র্যাকশনে রূপান্তরের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। পরের বছরই ওই পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়।

বিভিন্ন সংস্থার কাছে জমি ইজারা বাবদ বকেয়া আদায় করতে পারছে না রেলওয়ে। প্রায় ৬৩ হাজার একর জমির বেশির ভাগ প্রভাবশালীদের দখলে আছে। পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, রেলে আয়ের একাধিক পথ আছে। সেগুলোয় নজর দিতে হবে।

ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনের জন্য বৃত্তাকার রেলপথ নির্মাণের জন্য পরিকল্পনা ঘুরছে কাগজপত্রে। তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অথচ ঢাকা মহানগরীতে যানজট নিরসনের জন্য রেল যোগাযোগব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। ঢাকায় দিনে যানজটে নষ্ট হচ্ছে ৮৩ লাখ কর্মঘণ্টা। সীমিত গণপরিবহন সামাল দিতে পারছে না যাত্রী পরিবহনের চাহিদা।

বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা অষ্টম বেতন কাঠামো চালুর পর থেকেই লোকসান কিভাবে কমানো যায় তার জন্য চাপে আছি। পদ্মা সেতু রেল সংযোগসহ রেলপথ নির্মাণের বড় বড় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। রেলে বিনিয়োগ বাড়ছে, তবে তার সুফল পেতে সময় লাগবে। আমরা রেলপথ সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। ’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/10/18/554942