১৭ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৪৫

৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে নানা প্রশ্ন

মুখস্থনির্ভর শিক্ষা থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্য নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে চালু হয় সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি। আট বছর পেরিয়ে গেলেও অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাছে এ পদ্ধতি এখনো অধরা। প্রায় ৬০ ভাগ শিক্ষার্থী এ পদ্ধতি বুঝে উঠতে পারেনি। বাধ্য হয়ে কোচিং ও গাইড বই অনুসরণ করছে। আর অর্ধেক শিক্ষক সৃজনশীল না বুঝেই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করাচ্ছেন। সরাসরি গাইড বই থেকে পরীক্ষার প্রশ্ন করা হচ্ছে। ৮ বছর আগে সৃজনশীল পাঠদানের মানোন্নয়নে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও সরকারের অর্থায়নে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয়া হয়। তাতেও ফল মেলেনি। সম্প্রতি সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর শিক্ষা প্রশাসনে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। সৃজনশীলের বেহাল দশা নিয়ে এর আগে একই ধরনের প্রতিবেদন দিয়েছে খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ২০১৪ সালে শুরু হওয়া ঝঊঝউচ শীর্ষক প্রকল্পটি আগামী ডিসেম্বর মাসে শেষ হওয়া কথা রয়েছে। এরই মধ্যে এই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন করেছে বলে জানা গেছে। আইএমইডির প্রতিবেদন তথ্যানুসারে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট খরচ হয়েছে সাতশ’ ৫২ কোটি টাকার বেশি। আর বরাদ্দ ছিল সাতশ’ ৯৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠদান আরো সহজবোধ্য করতে এ পদ্ধতি চালু হয়। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি, মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি এবং সকলের সম-অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। সম অর্জনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্জন হলেও সৃজনশীল মানোন্নয়নে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সৃজনশীল পদ্ধতির যে চারটি ধাপের জ্ঞানমূলক, অনুধাবনমূলক, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতার মধ্যে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানমূলক ও অনুধাবনমূলক বিষয়ের ওপর প্রশ্নের কিছু উত্তর দিতে পারলেও প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতামূলক উত্তর দিতে পারেনি। গণিত ৫১.৭ ভাগ, ইংরেজি ৮.২ ভাগ ও বিজ্ঞান ৩৩ ভাগ শিক্ষার্থীর কাছে কঠিন বিষয় বলে তথ্য এসেছে। বিভিন্ন বর্ষের পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন বলছে, ২০১৫ ও ২০১৭ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার মূল কারণ গণিত, বিজ্ঞান ও ইংরেজিতে কম নম্বর পাওয়া। ফলে শিক্ষার্থীদের ৫৯.৮ ভাগ এই বিষয়গুলো বুঝতে প্রাইভেট পড়তে হয় ও গাইড বই অনুসরণ করতে হয়, যা স্থানীয় পর্যায়ে মতবিনিময় কর্মশালায় উপস্থিত শিক্ষার্থীরাও বলেছে। শিক্ষার্থীদের মতে, শিক্ষকদের প্রায় ৪০ ভাগ তাদের প্রাইভেট পড়তে উৎসাহিত করেন।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, পাঠ্যক্রম ও সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সময় যথেষ্ট ছিল না, পরিবর্তিত পাঠ্যক্রম শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গাইড নির্ভরতা মোটেও কমাতে পারেনি, বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর কাছে পাঠ্য-পুস্তকের ভাষা কঠিন ছিল, শিক্ষকরা প্রশ্ন প্রণয়ন ও পাঠদানে সরাসরি গাইড বইয়ের ব্যবহার করছেন, সৃজনশীল পদ্ধতি সঠিকভাবে না বোঝার কারণে এখনও বিরাটসংখ্যক শিক্ষার্থী কোচিং ও প্রাইভেট পড়ছে এবং স্থানীয় কর্মশালায় নির্বাচিত স্কুলের কোনো শিক্ষকই সৃজনশীল পদ্ধতির ওপর প্রশিক্ষণ ছাড়াই পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছেন। এর প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়নের লক্ষ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ (বিদ্যালয় ও মাদরাসা) থেকে ৭৬৮ জনকে উত্তরদাতা হিসেবে নির্বাচন করা হয়, যেখানে মোট নমুনায়ন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৬৪টি। তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৭০ ভাগ (৪৪১টি) ছিল গ্রামে/প্রত্যন্ত অঞ্চলের। শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংখ্যা ছিল ৩০ ভাগ (১৯৯টি)। এছাড়া, যে সব শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীর অনুপাত ছিল সমান সমান এবং উভয়েরই গড় বয়স ১৪ বছর। অধিকন্তু, সাক্ষাৎকার প্রদানকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশিরভাগই (৪৮.১ ভাগ) দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। এছাড়া অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে নবম শ্রেণির ৪২.১ ভাগ অষ্টম শ্রেণির ৮.৪ ভাগ এবং সপ্তম শ্রেণির ১.৪ ভাগ শিক্ষার্থী ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশিরভাগ শিক্ষার্থী নবম ও দশম শ্রেণির হওয়ার ফলে তাদের কাছ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সার্বিক চিত্র সম্পর্কে সঠিক তথ্য তুলে আনা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ৫৬ ভাগ শিক্ষক স্নাতক সম্মান পাস করেছেন এবং অবশিষ্ট ৪৪ ভাগ পাস কোর্স (ডিগ্রি) পাস করে শিক্ষকতা পেশা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিবেদনে আইটি শিক্ষার বেহাল দশার চিত্রও উঠে এসেছে। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে পাঠদান করার জন্য অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু হয়েছে। এর আওতায় কম্পিউটার, স্পিকার, ইন্টারনেট সংযোগ, মডেম, প্রজেক্টর, প্রিন্টার ও ফটোকপি মেশিন বিতরণ করা হয়েছে। এরপরও প্রায় ৭১ ভাগ শিক্ষার্থী বলছে তাদের বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও এখনো ৬০ ভাগ শিক্ষার্থী কিভাবে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয় তা জানে না। মাত্র ২৩ ভাগ বলছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষিত শিক্ষক আছেন। শিক্ষকরা বলেছেন, বেশিরভাগ কম্পিউটার প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলো মেরামত করার কোনো দক্ষ লোকবল ও অর্থের কোনো সংস্থান এ প্রকল্পের আওতায় ছিল না। এমনকি ই-লার্নিং স্কুলে কম্পিউটার বিষয়ে স্পেশালাইজড্‌ কোনো শিক্ষক নেই। অন্যদিকে অনেক পুরাতন মডেলের, কনফিগারেশনের কম্পিউটার হওয়ায় অনেক আধুনিক ভার্সনের প্রয়োজনীয় এ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করা যায় না। পাশাপাশি কম্পিউটার ল্যাবে ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য রাউটার থাকলেও সংযোগ অনেক বিদ্যালয়ে নেই বললেই চলে। অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা নিজ উদ্যোগে এবং কিছু কিছু বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি নিয়ে ই-লার্নিং ব্যবস্থা সচল রেখেছে। এ ছাড়াও শিক্ষকদের ৬ দিনের প্রশিক্ষণ ও আইসিটি উপকরণ মোটেও ই-লার্নিং পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত ছিল না বলে তারা মনে করেন।

অভিযোগ রয়েছে, এ প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে কানাডা, চীন, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে প্রমোদ ভ্রমণ করেছেন। প্রতিবেদনে এর চিত্র এসেছে। মাউশি অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এই প্রকল্প আওতায় মোট ১৭০ জন (৬৭ জন বৈদেশিক ট্রেনিং এবং ১০৩ জন শিক্ষা সফর) বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। বৈদেশিক প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা সফর ১২টি ব্যাচের মাধ্যমে কানাডা, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ভ্রমণ করেছেন। মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ৯টি বিষয়ে প্রশিক্ষণের আওতাভুক্ত ছিল। প্রশিক্ষণ শেষে অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন প্রতিবেদন দিলেও তা বাস্তবসম্মত নয়। সমীক্ষা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের ৩৪ ভাগ মনে করে লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই, ২০ ভাগ বলেছে কোনো লাইব্রেরিয়ান নেই এবং ১৪ ভাগ বলেছে লাইব্রেরি বন্ধ থাকে। তবে বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের প্রায় ৩৬ ভাগ বিজ্ঞানাগার ব্যবহার করে না।
এদিকে প্রতিবেদনে প্রকল্পের কিছু ভালো দিকও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, মাধ্যমিক শিক্ষাকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে তথা কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, দারিদ্র্য দূরীকরণ, প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন, জেন্ডার উন্নয়ন, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের এই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। অন্যান্য কর্মসূচির সঙ্গে সমন্বয় রেখে প্রকল্পটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ বিভাগের সক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম হয়েছে, মাউশি অধিদপ্তরের কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণসহ মানব সম্পদের উন্নয়ন, প্রশিক্ষিত শিক্ষক, পরিমার্জিত এবং পরিবর্তিত শিক্ষাক্রম, জাতীয় পরীক্ষা পদ্ধতি সংস্কার, বিদ্যালয়ে শিখন-শিক্ষণ পরিবেশের উন্নয়ন, দরিদ্র তথা মেয়ে শিক্ষার্থীদের সম অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ এবং সেই সঙ্গে সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়েছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=87891