১৭ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৮:৪৮

অনিরাপদ খাদ্য-নীরবে গণহত্যা

অধ্যক্ষ ডা. মিজানুর রহমান : বৈজ্ঞানিকদের মতে পৃথিবীর বয়স ৪০০ কোটি বছর। ভূতত্ত্ববিদদের ধারণামতে পৃথিবীর বয়স ১৫০-২০০ কোটি বছর। পৃথিবীতে মানুষের উদ্ভব সম্পর্কে রুশ উৎসে বলা হয়েছে বিশ লাখ বছর। তবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অধিকাংশ উৎসে মানুষের আবির্ভাব দশ লাখ বছর আগের কথা উল্লেখ আছে।
মদ্দাকথা পৃথিবী ও মানুষ সৃষ্টির বিষয়ে নানা মতপার্থক্য থাকলেও প্রাণীকুল তথা মানব সৃষ্টি লগ্ন থেকেই তাদের খাদ্যের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে কোন রকমের মতপার্থক্য নেই। কাজেই একথা নিদির্¦ধায় বলা যায় যে, মানুষের খাদ্যের সন্ধান, যোগার ও গ্রহণের প্রক্রিয়া একটি অনাদিকালের শাশ্বত চলমান প্রক্রিয়া। মোট কথা প্রাণী জগৎকে বেঁচে থাকতে হলে আলো, বাতাস, পানি, আগুন ও খাদ্য অতীব জরুরী বিষয়ই নয় বরং অনিবার্য্য।
স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে অবতরণ করার পরপরই তাদের খাদ্য বিষয়ক বর্ণনা পবিত্র আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে মাত্র তিনটি ফর্মুলায় পৃথিবীর সকল খাবারকে বৈধ ও অবৈধতা নিশ্চিত করেছে বিশ্ব নবীর একটি বাণীতে। কালের বিবর্তনে একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিশ্বব্যাপী একটি প্রশ্ন দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে মানবজাতিকে তা হলো নিরাপদ ও অনিরাপদ তথা ঝুঁকিপূর্ণ খাদ্য ও পানীয় ভাবনা।
প্রকৃতি যে খাদ্য ও পানীয় দান করে বলেছে তা নিঃসন্দেহে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত। এগুলো অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয় রূপান্তরিত ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মধ্যদিয়ে। এই রূপান্তর ও প্রক্রিয়াজাত কারণে ইচ্ছাকৃত বা অসাবধানতা অথবা অজ্ঞতাকে দায়ী করা যায়। কারণ যাইহোক এর ভাবিফল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ঝুঁকি যে জাতিকে কতটা ভয়াবহতায় ফেলতে পারে তা নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে বিশ্ববাসীকে।

পৃথিবীতে জনসংখ্যা যে জনসম্পদ একথা অস্বীকার করার যো নেই। তবে প্রশ্ন হচ্ছে এই জনসংখ্যার কতটা মানসিক ও শারীরিক সুস্থ ও সবল তা নিয়ে। মূলত মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ ও সবল মানুষেরাই একটি দেশ ও জাতির অমূল্য সম্পদ। অপর দিকে মানসিক ও শারীরিক বিকলাঙ্গ, অক্ষম, দুর্বল রোগাক্রান্ত অকর্মন্য অথবা বেকার জনসংখ্যা বিশ্ব ও দেশের জন্য বোঝাই নয় অভিশাপ। কাজেই মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ জাতি গঠনে পুষ্টিমান সম্পন্ন নিরাপদ খাদ্য পানীয় এর বিষয়টি সর্বাগ্রে এসে যায়।
জীবন জীবিকার তাগিদে সমস্ত সৃষ্টি জগত এক অসম প্রতিযোগিতায় স্ব-স্ব প্রজাতির উপযোগী খাদ্যের যোগানের মিশনে অবতীর্ণ রয়েছে অনাদিকাল হতে। খাদ্যের চাহিদা মেটাতে সমস্ত প্রাণীকুলের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করে। এদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি প্রাণীর মতো মানুষ ও খাদ্য সঞ্চয় করে এবং মজুদ করে। তবে মানুষ সে সব খাদ্যকে যেভাবে প্রক্রিয়াজাত ও রূপান্তর করতে পারে তা অন্য প্রাণীরা পারে না। মানব জাতির খাদ্য সঞ্চয় ও মজুদের কোন পরিমাণ নেই। এরা যতই খাদ্য সঞ্চয় করে ততই চাহিদা বাড়াতে থাকে। অথচ খাদ্যের অভাবে অন্যান্য প্রাণীকুল মৃত্যুবরণ না করলেও মানুষ খাদ্যের অভাবে মুত্যুবরণ করার ইতিহাস স্বীকৃত বটে।

কোন কোন দেশ খাদ্য মজুদ করায় খাদ্যের মান নষ্ট হলে সে খাদ্য সাগরে ফেলে দেয়। কোন কোন দেশে খাদ্যের অভাবে মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এগুলো মূলত মানবাধিকার মানব সভ্যতার মানদন্ডে বিবেচিত বিষয়। আমি সেদিকে যাচ্ছি না।
আমি আলোচনা করতে চাই উন্নতশীল দেশ, উন্নয়নশীল দেশ বা অভাবী দেশের খাদ্য নিরাপত্তার কথা। মানবদেহের পুষ্টিসাধন ও ক্ষুধা নিবারণে দৈনন্দিন জীবনে আমরা যা খাচ্ছি তা কতটা নিরাপদ? খাদ্য নিরাপত্তার মাত্রার উপরই নির্ভর করে জাতীয় অগ্রগতি ও সভ্যতা। বলতে গেলে একটি দেশের সামগ্রিক উন্নতির উপাত্ত নিরূপণ করা যায় সে দেশের জননিরাপত্তা ও খাদ্য নিরাপত্তার মাত্রা দিয়ে। যে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা যত উন্নত সে দেশ সভ্যতা ও জননিরাপত্তা ততই উন্নত।
আপাতদৃষ্টিতে বৈষয়িক উন্নতি, সম্পদের উন্নতি, অবকাঠামোগত উন্নতি, শিক্ষা, যোগাযোগ ও সমরাস্ত্রের উন্নতিকে উন্নতি বলা হলেও তা টেকসই উন্নতি বলে নিশ্চয়তা দেয়া যায় না, যদি না খাদ্য নিরাপত্তার উন্নতি সাধিত না হয়। মূলত সকল উন্নতিকে টেকসই করতে হলে প্রথমে আসে খাদ্য নিরাপত্তার কথা। এরপর আসে জননিরাপত্তা ও মানবাধিকারের কথা।
যেখাদ্য আমাদের জীবন বাঁচায়, সেই খাদ্যই যদি অখাদ্যে রূপান্তরিত হয় তা জেনেই হোক আর না জেনেই হোক তা গ্রহণের পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। এই ধরনের খাদ্য আমাদের জীবন জীবিকার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালে আমরা যে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির শিকার হবো তা কিন্তু যুদ্ধ ও মহামারীর ভয়াবহতার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। কাজেই কাল বিলম্ব না করে এমন পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। কারণ খাদ্য নিরাপত্তার উপর জোর তাগিদ না দিয়ে এড়িয়ে গিয়ে দেশ যতই উন্নতি লাভ করুক না কেন তা টেকসই না হয়ে হবে বুমেরাং। জীবন ও খাদ্য দুটি একে অপরের পরিপুরক। কথায় আছে নিরাপদ খাদ্য খেলে ওষুধের প্রয়োজন হয় না। আবার খাদ্যের মান ও খাদ্য অভ্যাস না থাকলে ওষুধ কোন কাজে আসে না।
ইদানীং পত্রপত্রিকা মিডিয়ায় প্রায়শই খাদ্য দূষণ সম্পর্কে যে ভীতিকর সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে তা বিবেককে নারা দেবার মতো। বিশেষ করে বাংলাদেশ তথা আশে পাশের দেশগুলোতে। খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিপণনের বিভিন্ন অনিয়ন্ত্রিত অথবা ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া সম্বলিত পদার্থ মিশিয়ে প্রাণীজগতের খাবারকে বিশেষ করে মানুষের খাবার ও পানীয়কে যেভাবে দূষিত করা হচ্ছে তা নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে। এক্ষেত্রে নিরাপদ খাবার-দাবার সম্পর্কে সর্বস্তরের তথা তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক গণসচেতনতা বাড়ানো অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে।

কারণ মানুষ নিরাপদ খাবার খেয়ে বেশিদিন বাঁচতে চায়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না দৈনন্দিন জীবনে সে যা খাচ্ছে তা কি আদৌ নিরাপদ খাবার? কোন খাবার নিরাপদ, কোন খাবার নিরাপদ নয় তা চিনবে কিভাবে? তবে মানুষ অনিরাপদ খাবারের প্রতিকার কামনা করে। দেশের জনগন মনে করে এটা সরকারেরই দায়িত্ব। তবে দুঃখজনক হলেও বাস্তব সত্য যে কোন কোন দেশের অধিকাংশ মানুষই জানে না নিরাপদ খাদ্য আইন কাকে বলে। তারা এও জানে না যে নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক কর্তৃপক্ষ কারা। তারা এতটুকুও জানেন না যে সে কর্তৃপক্ষ কতটা দায়িত্বশীল ও কর্তব্য পরায়ন।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্য উৎপাদনে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছে। কিন্তু খাদ্যের গুণগত মান ও নিরাপত্তার বিষয়টি প্রশ্নবোধক। এক্ষেত্রে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতকরণে একটি দক্ষ ও কার্যকর কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করে খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াজাতকরণ, মজুদ, সরবরাহ, বিপণন ও বিক্রয় সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩, প্রণীত হয়েছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ থেকে আইনটির কার্যকারিতা শুরু হয়েছে। এই আইনের ধারা ৫ (১) অনুযায়ী ইতোমধ্যে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠিত হওয়ায় জনমনে বিরাট আশাবাদের সূচনা হয়েছে। এতে করে দেশের সর্বস্তরের মানুষ আশা করছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ খাদ্য উপাদান ও বিপণনে জড়িত বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি টেকসই কার্যকর সমন্বয় সাধনের বিষয়টি সহজতর হবে। এই সমন্বয় মুনাফালোভী, স্বার্থানেষী মহলের নিরাপদ খাদ্য অনিরাপদ করার অপচেষ্টা রোধ করা সহজতর হবে। নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতকরণে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের উপর যেসব দায়িত্ব অর্পিত করা হয়েছে তা সুষ্ঠুভাবে প্রতিপালিত হলে দেশের জনগণ নীরব গণহত্যা থেকে পরিত্রাণ পাবে।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ যদি নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় আন্তরিকভাবে কাজ করেন তবে খাদ্যের ভেজালরোধসহ খাদ্য বিষয়ক যাবতীয় অনিয়ম, দুর্নীতি সিংহভাগ দূর করা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে সরকার, সরকারী বেসরকারী সংস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় নেতা, প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াসহ সকলস্তরের জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা বাঞ্ছনীয়।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য নেটওয়ার্ক (বিএফএসএন) নাগরিক সমাজের ঐক্যজোট ভোক্তা পর্যায়ে নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি ও নিরাপদ খাদ্য আইন বাস্তবায়নে সরকারকে সম্ভাব্য সহায়তা প্রদান করছে। সেই সাথে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পলিসি এডভোকেসি করার লক্ষ্যে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বিএফএসএন’র কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহায়তা করছে। সংস্থাটি প্রতি বছর বিশ্ব হাত ধোয়া দিবস উপলক্ষে ১৫ অক্টোবর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। সেই সাথে সভা সেমিনার এডভোকেসি করে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক গণসচেতনতা ত্বরান্বিত করে যাচ্ছে। সেই সাথে বিভিন্ন ছবি সম্বলিত খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক প্রচার পত্রে লিখিত বিষয়সমূহ পাঠ ও প্রদর্শনীতে দেশে অনেকটা নিরাপদ খাদ্যের গণজাগরণ তৈরি হয়েছে।

গত ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তে বগুড়া জেলা সদরের সেউজগাড়ীর হোটেল গোঁধুলীতে একটি প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণের অতিথি বক্তা হিসেবে আমি অংশগ্রহণ করি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সহযোগিতায় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য নেটওয়ার্ক (বিএফএসএন) এর পক্ষে বিকশিত বাংলাদেশ এর ব্যবস্থাপনায় আয়োজিত প্রশিক্ষণে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বাংলাদেশ অফিসের ন্যাশনাল এডভাইজার ড. রোকেয়া বেগম ও নিরাপদ খাদ্য নেটওয়ার্ক এর অন্যতম সংগঠক বিশিষ্ট কলাম লেখক ও গবেষক আতাউর রহমান মিটন। যিনি ‘‘হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড” এর কান্ট্রি ডাইরেক্টর (বাংলাদেশ) এর দায়িত্বে নিয়জিত আছেন। যা হোক ঐ প্রশিক্ষণে বাস্তবতার নিরিখে বাংলাদেশ যে খাদ্যে অগ্রগতি লাভ করেছে সেটা যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি অনিরাপত্তা খাদ্যের সয়লাব ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় দেশের জনগণ একটি নীরব গণহত্যার শিকার হচ্ছে এটি সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

সম্প্রতি প্রচার মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিপণন জগতে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে মানুষের নিরাপদ খাবার যে দূষিত করার প্রবণতা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সেই সাথে অঅনুমোদিত বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানী যেসব ওষুধ তৈরি ও বাজারজাত করছে সেসব ওষুধের গুণগতমান নিয়েও নানা প্রশ্ন বিদ্যমান। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের দেশ ক্রমশ অসংক্রামক ব্যাধিগুলো যেমন, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনী নষ্ট, এ্যাজমা ও এলার্জী, চর্মরোগ, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, বিকলাঙ্গ বা শারীরিক প্রতিবন্ধী, অটিজম, সন্তানের জন্ম হার ইত্যাদি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সেইসাথে খাবারের অনিরাপত্তাজনিত কারণে ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েট জ্বর, ইনফ্লুয়েঞ্জা, চিকন গুনিয়া, ম্যালেরিয়া, এ্যানথাক্সসিনাম, টিউমার, হেপাটাইটিস, থাইরয়েডগ্লান্ট বৃদ্ধি, সুয়াইনফ্লু, কৃমির উপদ্রপ ইত্যাদি রোগের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

এই অসুখগুলোর পিছনে দূষিত খাবারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় ক্রম বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এসব অসুখের প্রাদুর্ভাব ব্যাপকহারে বৃদ্ধির ফলে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি রাষ্ট্রের ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। খাদ্যে ভেজাল নিরাপদ খাদ্যকে অনিরাপদ করে এ প্রসংগে প্রথমেই চলে আসে কৃষিজাতপণ্য বিশেষ করে ফল ফলাদিতে রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো। কৃষিজাত শষ্য উৎপাদন ও আহোরণ প্রক্রিয়া অনিয়ন্ত্রিত কীটনাশকের ব্যবহার, মাছ ও মুরগীতে অনিয়ন্ত্রিত এবং মাত্রাতিরিক্ত এন্টিবায়োটিক ব্যবহার, নানা ধরনের রাসায়নিক ওষুধ দিয়ে গরু-ছাগল, হাস-মুরগী মোটাতাজাকরণ, গাভীর দুধের পরিমাণ বৃদ্ধি, ক্যালসিয়াম কার্বাইড বা ইথোফেন জাতীয় ওষুধ স্প্রে করে ফল পাকানো, খাবারের পচনরোধে ফরমালিন বা এজাতীয় রাসায়নিক উপাদানের ব্যবহার দিনদিন বেড়েই চলেছে।

খাবার সংরক্ষণ, রান্নাবান্না, পরিবেশনের ক্ষেত্রেও স্বাস্থ্য সচেতনতার ঘাটতি থাকায় স্বাস্থ্যকর খাবার ও পানীয় অনেক ক্ষেত্রে মারাত্মক দূষণের শিকার হতে পারে। এছাড়া প্যাকেটজাত খাবাসমূহ দীর্ঘদিন টাটকা ও সতেজ রাখার ক্ষেত্রেও নানা ধরনের রাসায়নিক উপাদান মেশানো হচ্ছে। সেগুলো বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে মুখরোচক, বাহারী স্বাদে ভরপুর হলেও সবক্ষেত্রে যে এগুলো নিরাপদ তা ভাবা যায় না।
খাবারের বাহনকে চকচকে ঝকঝকে করে তোলার জন্য নানা রকম সাজে প্রিন্ট করে তাতে বাতাস ঢুকিয়ে ফোলানো হয়। ভিতরের খাবারে রাসায়নিক মিশ্রণ ঘটিয়ে খাবারের রং এবং স্বাদ বাড়ানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই যে, কৃত্রিমভাবে শোভা বর্ধনীয় এসব খাবারে বিএসটিআই এ সীল ও মেয়াদ লেখা থাকলেও এসব খাবার মূলত কতটুকু মানসম্পন্ন এবং মানবদেহের জন্য উপযোগী তা পুনঃপরীক্ষার প্রয়োজন। এতে করে একদিকে যেমন শিশু ও গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্য নিরাপদ হবে অপরদিকে সর্ষের দানার ভিতরের লুকিয়ে থাকা ভূতত্ত দূর হবে।

আমরা বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছি যে, নগর জীবনের সাথে তাল মিলাতে এখন অজো পাড়াগাঁয়ের দোকানগুলোতে স্তরে স্তরে সাজানো কোমল পানীয়, আইসক্রীম, প্যাকেটে মোড়ানো খাবার সাজিয়ে বা ঝুঁলিয়ে রাখা হচ্ছে। রাস্তার ধারে খেজুরের রস, তালের রস, ডাবের পানি, লেবুর সরবত অবাধে বিক্রি হচ্ছে।
গ্রামে-গঞ্জের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে টিফিন কিংবা ছুটির পর এসব দোকানে মৌমাছির মতো ভিড় করে শিশুরা। স্কুলে যাবার সময় বায়না ধরা আদায়ের খুচরো টাকাগুলো দিয়ে শিশুরা কি কিনে খাচ্ছে? তা নিয়ে কেউ ভাবছি না। এসব খাবারের কত অংশ ভেজালমুক্ত ও নিরাপদ আর কত অংশ অখাদ্য অনিরাপদ তা ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। “চকচক করলেই সোনা হয় না” কথাটি যেমন সত্য তেমনি দেখতে বাহারী হলেও স্বাদে সুস্বাদু হলেই যে সে খাবার নিরাপদ হবে এর কোন নিশ্চয়তা নেই।
কথায় আছে সাবধানের মাইর নেই, অসাবধানতাই অগ্নিকান্ডের মূল কারণ। কাজেই আগুন অল্প থাকতেই নিভাতে হবে, বন্ধ করতে হবে নীরব হত্যাযজ্ঞ।

বাংলাদেশে নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক বেশ কয়েকটি দেশী বিদেশি সংস্থা কাজ করছে তন্মধ্যে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য নেটওয়ার্ক (Bangladesh Food Society Network) ২০১০ সালে গঠিত হয়। শুরুতে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)-এর সহায়তায় অনুষ্ঠিত কর্মশালায় আলোচনার প্রেক্ষিতে এই নেটওয়ার্ক গঠিত হয়।
বিভিন্ন পরিবেশ ও কৃষকের সাথে কাজ করে চলেছে সংগঠনটি। মাঠে ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার খাওয়ার পাত্রে ওঠা পর্যন্ত নিরাপদ খাদ্য থাকছে কিনা তা নিয়মিত পর্যালোচনা করে থাকে সংগঠনটি। বর্তমানে বাংলাদেশ কনজুমার্স এ্যাসোসিয়েশন (ক্যাব) এর সচিবালয় কাজ করছে। এর সদস্যরা হলেন- উবিনীগ, বি-সেফ, শিসুক ও হাঙ্গার ফ্রি ওয়াল্ড। এতে করে অনিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে দেশের জনগণ যথেষ্ট সচেতনতার সুযোগ পাচ্ছে।

প্রথমত বলা যায় যে, পৃথিবীর সৃষ্টিকুলের মধ্যে মানুষকে সেরা সৃষ্টি হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এর বহুবিধ কারণ বিদ্যমান। তবে মানুষকে একটি বিশেষ গুণ ও ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তাহলো মানুষ হাসতে পারে, আবার কাঁদতেও পারে কিন্তু অন্যান্য প্রাণীরা তা পারে না। অপরদিকে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীজগত কোন ধরনের খাবার নিরাপদ আর কোন ধরনের খাবার ও পানীয় অনিরাপদ ও ক্ষতিকর তা সহজেই প্রাকৃতিকভাবেই বুঝতে পারে। এ বিশেষ ক্ষমতার কারণেই প্রাণী জগতে অসুখ বিশুখ নেই বললেই চলে।
কিন্তু মানুষ এখনও জানে না যে, সে যে খাবার খাচ্ছে বা পান করছে তা কি নিরাপদ? এ অজানার কারণেই একশ্রেণীর মুনাফাখোর, লোভী, স্বার্থবাদী, মহল বা ব্যক্তি মানুষকে সর্বনাশ করে তাদেরকে নীরব হত্যাযজ্ঞে মেতেছে।
মোটকথা জীবন নিয়ে তামাশা করা নীরবে গণহত্যা করা সভ্যতার বিপরীতে অসভ্যতা আর অমানবিকতা। সময় এসেছে এসব গণহত্যাকারীদে খুঁজে বের করার। এ কাজটি অত সহজ নয়, তবে সর্ব প্রথম রাষ্ট্রযন্ত্রকে এগিয়ে আসতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ মহল ও সর্বস্তরের জনতাকে। এক্ষেত্রে খাদ্যের বিভিন্ন বিষয় নি¤েœ সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনা পেশ করা হলো :
খাদ্য-ক্ষুধা নিবারণ, পুষ্টি সাধন, শরীরের গঠন, বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ এবং রোগ প্রতিরোধ করে দেহকে কর্মক্ষম রাখতে আমরা যা কিছু খাই তাই খাদ্য। খাদ্যের প্রকার- শর্করা, আমিষ, স্নেহ, ভিটামিন ও খনিজ এবং পানি। খাদ্যের উদ্দেশ্য- ১. শরীকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখা। ২. বয়স অনুযায়ী পর্যাপ্ত পুষ্টিমান নিশ্চিত করা। ৩. পুষ্টির অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধ করা। ৪. সকল প্রকার পুষ্টি উপাদান গ্রহণ নিশ্চিত করা। ৫. শরীরকে নিরোগ রাখা এবং আয়ু বৃদ্ধি করা। খাদ্যের উৎস-১. প্রাকৃতিক, ২. উৎপাদিত, ৩. প্রক্রিয়াজত :

নিরাপদ খাদ্য- স্বাস্থ্যসম্মত সুষম খাবার পুষ্টি সাধন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো ও জীবনী শক্তিকে সবল রাখার মতো মানসম্পন্ন এবং মানসিক ও শারীরিক বিকাশ করার মত মানসম্পন্ন যে খাবার সেটিই নিরাপদ খাবার।
খাদ্য অনিরাপদ হয়-১. ইচ্ছাকৃত, ২. অনিচ্ছাকৃত, ৩. অজ্ঞতাবশত
১. ইচ্ছাকৃত : অনিরাপদ খাদ্যের জন্য উন্মুক্ত পরিবেশের অনিরাপত্তা, প্রক্রিয়াজাতকরণে অসতর্কতা, মাত্রা বা গুণাগুণের হেরফের এবং খাদ্যে বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক কেমিক্যাল মিশ্রিত করে নিরাপদ মানসম্পন্ন খাবারকে ভেজাল খাদ্যে রূপান্তরিত করা।
২. অনিচ্ছাকৃত- মেয়াদ উত্তীর্ণ, ক্যামিক্যাল মিশ্রণ, খাদ্য দূষণ, খাদ্যের গুণগত মান নষ্ট হওয়া ইত্যাদি।
৩. অজ্ঞতাবশত : বদভ্যাস, আর্সেনিকযুক্ত পানি, কয়েলের বা নানা প্রকার দূষিত বায়ু গ্রহণ, খাদ্য গ্রহণের সময় খবরের কাগজের কালো কালীতে খাবার গ্রহণ ও পরিবেশন, অস্বাস্থ্যকর পোশাক বা পরিবেশ হাঁচি, কাশি, বায়ু ও পানিবাহিত রোগবালাই। পরিশেষে ৩টি কবিতা দিয়ে আজকের প্রবন্ধ শেষ রতে চাই-
মেঘ দেখে তুই করিসনে ভয়-আড়ালে তার সূর্য হাসে- বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত-আমরা আনিব রাঙ্গা প্রভাত-আমরা টুটাব তিমির রাত- বাঁধার বিন্ধাচল-জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম। একটি প্রদীপ জ্বললে পড়ে-হাজার প্রদীপ জ্বলে-একটি মানুষ মানুষ হলে-হাজার মানুষ টলে-উপরোক্ত ৩টি কবিতার সারমর্মে সহজেই বোধ্যগম্য যে বাধা আসলেই থেমে যেতে নেই। বাধা যতই থাকুক না কেন-আমি জেগেছি আপনিও জাগুন। আসুন গণসচেতনতা বাড়িয়ে আমজনতার বিবেককে শানিত করি। তবেই বন্ধ হবে নীরব গণহত্যা।

http://www.dailysangram.com/post/303809