৯ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার, ৯:৫১

মংডুসহ ফের রোহিঙ্গাদের কয়েকটি এলাকায় অগ্নিসংযোগ সেনাদের

বাংলাদেশে পালিয়ে আসার অপেক্ষায় আরো ২৫ হাজার রোহিঙ্গা

মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের মংডু, বুছিদং ও রাছিদং এলাকায় মিয়ানমারের সেনা পুলিশ ও মগদস্যুরা নতুন করে নির্যাতন শুরু করেছে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায়। গত জুমাবার রাতেও মিয়ানমারের আরাকান এর মংড়– টাউনশীপের দারাগার ডেইল, বুছিদং টাউনশীপের আলিয়ং ও রাছিদং টাউনশীপের কিয়নদং এলাকায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাড়ি-ঘরে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে শত শত বাড়ি-ঘর।

কিছুদিন বিরতির পর আবারো বাংলাদেশে দিকে আসতে শুরু করেছে রোহিঙ্গারা। ফের নতুনভাবে শুক্রবার সকাল থেকে গতকাল শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মিয়ানমারের আরকানের মংডু শহরের সাতটি মুসলিম মহল্লায় অগ্নিসংযোগ করেছে মিয়ানমার সেনা সদস্যরা। এতে পুড়ে গেছে অন্তত ৪ শতাধিক ঘর-বাড়ি। এতে কোন হতাহতের ঘটনা জানা যায়নি। জানা গেছে, আরাকানের অন্যান্য জায়গায় এর আগে ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে গুলি করে নারী শিশু-পুরুষকে হত্যা করে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে বেঁচে থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য করা হয়েছিল। মংডু টাউনশীপের দক্ষিণ পূর্ব দিকের দারাগার ডেইল, বুছিদং টাউনশীপের আলিয়ং ও রাছিদং টাউনশীপের কিয়নদং এলাকায় কিছু কিছু এলাকায় রোহিঙ্গাদের বাড়ি-ঘরের চারপাশে রাখাইন পাড়া থাকার সুবাদে এতদিন রোহিঙ্গাদের ওই বাড়ি-ঘর গুলোতে আগুন দেয়া হয়নি। ওই এলাকার রোহিঙ্গারা ভীত সন্ত্রস্থ অবস্থায়ও থাকলেও অন্তত এতদিন তারা তাদের বাড়িÑঘরে অবস্থান করেছিল।

গত কয়েকদিন থেকে ওই সব এলাকাতেও এখন অভিযান শুরু করেছে নিরাপত্তাবাহিনী। শিশু সন্তানদেরকে তাদের মা-বাবার সামনে ধারালো অস্ত্র দিয়ে বা গুলি করে হত্যা করছে। যুবতী মেয়েদেরকেও মা-বাবার সামনে ধর্ষণের পর হত্যা করছে। অথবা ধরে নিয়ে যাচ্ছে সেনা-পুলিশের ক্যাম্পে। ঘর-বাড়িতে পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। এসব কাজে নিরাপত্তা বাহিনীকে সহযোগিতা করছে রাখাইন মগদস্যুরা। সেখান থেকে পালিয়ে আসা নুরুল আলমসহ কয়েকজন জানান, ওই এলাকার কয়েক হাজার পরিবারের ২০/২৫ হাজার মত রোহিঙ্গা নারী পুরুষ পালিয়ে আসছে বাংলাদেশের দিকে।
শাহপরীরদ্বীপ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানায়, মংডু শহরের সিনেমা হলের পূর্ব পাশের মুসলিম মহল্লা, নয়াপাড়া, পূর্ব পাড়া, পশ্চিম পাড়া ও সুন্দরী পাড়ায় আগুন দেয় আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং মংডু শহরের উত্তর দিকে মাঙ্গালা পাড়ায় আগুন দেয় সেনা সদস্যরা। এ সময় অগ্রবৌদ্ধরা রাখাইনরা মুসলিম বিরোধী শ্লোগান দেয়। তারা বলছেন, মুসলিম রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধন করতে মিয়ানমার বাহিনীর নৃশংসতা শুরু হওয়ার পর থেকে অধিকাংশ রোহিঙ্গা মুসলিম আগেভাগে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশ পালিয়ে এসেছেন। যারা সাহস করে থেকে গিয়েছিল, এবার তাদের উপর শুরু হয়েছে নির্যাতন। যাতে তারাও পৈত্রিক ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হন।

নতুন আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, মংডু সুধা পাড়ার দশ হাজার রোহিঙ্গাকে ঘিরে রেখেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং তাদের গ্রামে আগুন দিয়েছে। সাথে চলছে নির্যাতন, দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকটও। এজন্য তারা প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন।
শুক্রবার রাতে টেকনাফ পৌর এলাকা থেকে আগুনের লেলিহান শিখা প্রত্যক্ষ করেছে সীমান্তের অধিবাসীরা। এছাড়া গোদাম পাড়া নামক একটি স্থানে নদীর পাশে প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে কয়েকদিন ধরে ঘিরে রেখেছে সেনাবাহিনী। সেখানে কাপড় ও পলিথিন দিয়ে ছোট ছোট তাবু বানিয়ে তারা অবস্থান করছে। সেনাবাহিনী তাদেরকে কোথাও যেতে দিচ্ছেনা। আবার তাদের কাছে থাকা মোবাইল ও দা-চুরি কেড়ে নিচ্ছে তারা। সেখানে থাকা রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। শুক্রবার গোপনে সেখানে থাকা এক রোহিঙ্গা তার আত্মীয়দের কাছে একটি ভিডিও পাঠিয়ে এ অবস্থার বর্ণনা দেন। এখন তাদেরকে নিয়ে সেনাবাহিনী কি করবে, তা নিয়ে তারা শঙ্কিত রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত মংডু অঞ্চলের ৯০ ভাগ গ্রাম রোহিঙ্গা শূন্য হয়ে পড়েছে। এসব গ্রামের ৭০ ভাগ বসতি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে উগ্রপন্থী বৌদ্ধ ও দেশটির সেনারা। রোহিঙ্গাদের ছেড়ে যাওয়া কিছু কিছু উন্নতমানের দ্বিতল কাঠের বাড়িঘর অক্ষত রাখা হয়েছে। সেসব দখলে নিচ্ছে স্থানীয় বৌদ্ধ রাখাইনরা।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নাফ নদের উপকূলে এখনো হাজারো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছেন। টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে প্রশাসন নজরদারী বৃদ্ধি ও স্থানীয় মানব পাচারকারী দালালদের উপর অভিযান পরিচালিত হওয়ায় কয়েকদিন ধরে টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে রোহিঙ্গা আসা কমেছিল। ফের রোহিঙ্গাদের উপর সহিংসতা শুরু হওয়ায় অনুপ্রবেশ বেড়েছে।
এদিকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপে পড়ে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কথা বললেও নতুন করে নির্যাতন মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য সৎ নয় বলেই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। এতে করে একদিকে মিয়ানমার সরকার এককালের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আরাকানকে মুসলিম শূন্য করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের বিশাল এক বোঝা বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইএমও) বলছে, গত কয়েকদিন গড়ে ১২শ’ রোহিঙ্গা ঢুকছে। তবে গত ৭ অক্টোম্বর একদিনে ঢুকছে প্রায় ৭শ’ জন রোহিঙ্গা। কর্মকর্তারা আরো দাবি করেছেন, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশমুখী জনস্রোত এখনও থামেনি। এখনও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার অপেক্ষায় রয়েছে। তবে স্থানীয়দের দাবি দিন দিন পরিস্থিতি ভয়াবহ হচ্ছে। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে রোহিঙ্গা আসার হার কমে আসছিল। মিয়ানমারের মন্ত্রীর ঢাকা সফরের পর পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। অক্টোবরে আবারো সীমান্তে রোহিঙ্গা স্রোত বাড়ছে। এত দিনে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সংখ্যা সাড়ে ছয় লাখে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ ব্যাপারে টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্ণেল এসএম আরিফুল ইসলাম জানান, গত দু’দিনে শাহপরীর দ্বীপ এলাকা দিয়ে রোহিঙ্গারা প্রবেশের চেষ্টা করে। এসময় পাচারকারী দালালের নৌকা জব্দ করা হয়েছে। রোহিঙ্গা আসা কিছুতা কমেছে। বাস্তবে বিজিবি কর্মকর্তা এমন কথা বললেও সীমান্ত দিয়ে দলে দলে গতকাল প্রায় ৭ শতাধিক রোহিঙ্গা এসেছে।
উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা নিধন এখনো অব্যাহত রয়েছে। সেই উদ্দেশ্যে চলছে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ।

https://www.dailyinqilab.com/article/98865