৭ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৮:০৬

গণশুনানিতে বক্তাদের অভিযোগ

বেশি দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বছরে ক্ষতি ৭৮৪৩ কোটি টাকা

দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, ঘুষ লেনদেন আর লুটপাটের কারণে বিদ্যুৎ খাতে সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আদর্শিকভাবে এ খাতে কোনো উন্নয়ন হয়নি। এ ছাড়া বেশি দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করায় ভোক্তারা বছরে ৭ হাজার ৮৪৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকার ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। পরিকল্পিতভাবে কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হয়নি। বিদ্যুৎ খাতে ঘুষ লেনদেন হয়েছে টনে টনে। হাজার হাজার কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন হয়েছে। দুর্নীতিবাজরা আছে পর্দার অন্তরালে। একেকটি পাওয়ার প্ল্যান্ট করতে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করা হয়েছে, তার অর্ধেক দামে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো করা সম্ভব ছিল। কিন্তু টনে টনে ঘুষ লেনদেন করতে গিয়ে এটা করা হয়নি। ঘুষের টাকা সমন্বয় করতে জনগণের পকেট কেটে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হচ্ছে। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক আর অন্যায়। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে বিদ্যুতের দাম কমানো নিয়ে গণশুনানিতে ভোক্তা অধিকার সংগঠনের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা প্রফেসর শামসুল আলম এসব কথা বলেন। শামসুল আলম বলেন, তিনি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারবেন, প্রতিটি আন-সলিসিটেড পাওয়ার প্ল্যান্ট কমপক্ষে ৫০ ভাগ কম দামে করা সম্ভব ছিল। তারপরও বেশি দামে যেগুলো করা হয়েছে তার বেশিরভাগ মানহীন। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র ৫০ শতাংশ বেশি দামে করে দায়ভার আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে শামসুল আলম বলেন, এখনও বিনা দরপত্রে অমীমাংসিতভাবে যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নির্মিত হচ্ছে, সেগুলোয় কারিগরি ও আর্থিক দুর্নীতি হচ্ছে। প্রফেসর আলম বলেন, কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বেশি দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। স্বল্পতম ব্যয়ে উৎপাদন কৌশল গ্রহণ না করায় ভোক্তারা বছরে ৭ হাজার ৮৪৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকার ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এ অবস্থায় পাইকারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি খুচরা বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে বিতরণকারী সংস্থা-কোম্পানিগুলো। পিডিবি প্রতি ইউনিট পাইকারি বিদ্যুতের দাম গড়ে ৭২ পয়সা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে এবং ৫৭ পয়সা বৃদ্ধির পক্ষে মত দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির কারিগরি কমিটি। অথচ বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খাতভিত্তিক খরচগুলো সঠিকভাবে সমন্বয় এবং স্বল্পতম ব্যয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হলে প্রতি ইউনিট পাইকারি বিদ্যুতের দাম ৬ পয়সা কমানো যায়।

বিদ্যুতের দাম কমাতে ক্যাবের প্রস্তাবের ওপর শুনানি করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এর আগে গত ২৫ সেপ্টেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়াতে পিডিবির প্রস্তাবের ওপর শুনানি হয়। বুধবার পর্যন্ত বিতরণ সংস্থা-কোম্পানিগুলোর খুচরা মূল্যবৃদ্ধির ওপর শুনানি হয়।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টার প্রস্তাবনায় দেখা গেছে, পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যহার ৭২ পয়সা বৃদ্ধির প্রস্তাবে রাজস্ব চাহিদায় প্রতি ইউনিটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল বাবদ ২৬ পয়সা, ভর্তুকির সুদ বাবদ ২১ পয়সা, পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যহারে ঘাটতি ৫ পয়সা। এ ছাড়া দরপতন সমন্বয়কৃত মূল্যহারে ফার্নেস অয়েলের পরিবর্তে মেঘনাঘাট আইপিপিতে ডিজেল ব্যবহারের ঘাটতি ১৪ পয়সা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে আয়হারে অন্তর্ভুক্ত হয়নি ভোক্তা পর্যায়ে ১৩২ কেভি লেভেলে বিদ্যুৎ বিক্রিতে উদ্বৃত্ত আয় ৮ পয়সা এবং পাওয়ার ফ্যাক্টর জরিমানা আদায় বাবদ আয় ৪ পয়সা। সব মিলিয়ে এই ৭৮ পয়সা প্রস্তাবিত মূল্যহার বৃদ্ধির সঙ্গেও যদি সমন্বয় করা হয় তবে বার্ষিক ৩২১ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে। ফলে বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিটে ৭২ পয়সা বৃদ্ধি নয়, ৬ পয়সা কমানো যায়।

তিনি বলেন, সরকার কম দক্ষ এবং বেসরকারি রেন্টাল বিদ্যুতে গ্যাস দিয়ে উৎপাদন খরচ বাড়াচ্ছে। অথচ পিডিবির কেন্দ্রগুলো গ্যাসের অভাবে অপেক্ষাকৃত কম খরচের বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। ওই গ্যাস পিডিবি পেলে কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। প্রভাবশালী ও ব্যবসায়ীদের একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় জনগণের ওপর খরচের বোঝা চাপিয়েই যাচ্ছে সরকার। এই দুর্নীতি বন্ধ এবং নীতিগত ভুল সংশোধন করতে হবে।

তিনি বলেন, কর্তাব্যক্তিদের দুর্নীতি, অনিয়ম ও নীতিগত ভুলের মাশুল বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে দিতে হচ্ছে। অন্যায্যভাবে উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দাম বাড়ানো অন্যায় ও অযৌক্তিক।
ক্যাবের প্রস্তাবের বিপরীতে কোনো মূল্যায়ন প্রতিবেদন দেয়নি বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। তবে ক্যাবের প্রস্তাব ও বক্তব্যের বিপরীতে বক্তব্য উপস্থাপন ও প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন পিডিবির মহাব্যবস্থাপক কাওসার আমীর আলীসহ কয়েকজন কর্মকর্তা। পিডিবি বলেছে, উৎপাদন ব্যয় ৬ হাজার ৩৪২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা সাশ্রয়ের বিষয়ে ক্যাবের মূল্যায়ন সঠিক নয়। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন হার ১ টাকা ৩২ পয়সা উদ্বৃত্ত থাকার হিসাব বাস্তবসম্মত নয়। তবে ব্যয়ে অন্তর্ভুক্ত বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল বাবদ ২৬ পয়সা, ভর্তুকির সুদ বাবদ ২১ পয়সা, ১৩২ কেভি লেভেলে গ্রাহক সিঙ্গেল বায়ারের অধীন অন্তর্ভুক্ত করলে ৮ পয়সা অর্থাৎ মোট ৫৫ পয়সা সমন্বয় করা হলে এবং বার্ষিক ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হলে হ্রাসকৃত দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে।

শুনানিতে অংশ নিয়ে সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, মানুষের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। এসবের সঙ্গে বিদ্যুৎ যোগ করতে হবে। এটা তারই একটি অংশ। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সমন্বয় ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, সরকারি সেবার ক্ষেত্রে নয়। মানুষ কর-ভ্যাটের মাধ্যমে সরকারকে টাকা দিচ্ছে। তা থেকে এ খাতে বরাদ্দ দিতে হবে, ভর্তুকি নয়।

কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, সরকার অনেক সময় খেয়ালখুশিমতো কিছু কিছু জিনিসের দাম বাড়াতে সহযোগিতা করে কিংবা নিজেই বাড়িয়ে দেয়। কিছুদিন আগে চাল নিয়ে আমরা তা দেখেছি। তবে চালের দাম বাড়ানো আর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো এক নয়।
বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে অনেক সেবা ও পণ্যের দামও বেড়ে যায়। এর প্রভাব আরও বেশি। তিনি বলেন, একটি গণতান্ত্রিক সরকার মানুষের বোঝা কমাবে কিন্তু বোঝা চাপিয়ে দিতে পারে না। সরকার কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয়, তারা বলতে পারে না এ ক্ষেত্রে লাভ কিংবা লোকসান হচ্ছে। সংবেদনশীলতার সঙ্গে যাচাই না করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে তা হবে জনগণকে বৈদ্যুতিক শক দেয়ার শামিল।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, বিদ্যুৎ একটি কৌশলগত পণ্য এবং এটির দাম বেড়ে গেলে অন্য সব পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। এতে দুটি প্রতিক্রিয়া হয়। একটি মুদ্রাস্ফীতি, এতে জনগণের প্রকৃত আয় কমে যায় এবং অন্যটি দেশের পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। রফতানি খাত প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যায়। তাই বিদ্যুতের দাম কমানো সম্ভব হলে তা কমানো দরকার।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সরকার কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করলে বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে কমানোর সুযোগ রয়েছে। আগে সরকার বলত- আন্তর্জাতিক বাজারে যেহেতু জ্বালানির দাম বাড়ছে তাই মূল্য সমন্বয় করার জন্য অভ্যন্তরীণ বাজারে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করতে হবে। কিন্তু যখন দাম তিন ভাগের এক ভাগ কমে এলো তখন নৈতিক দায়িত্ব দাম কমানো। এ পর্যন্ত জনগণ এর প্রত্যক্ষ সুফল পায়নি।
গণশুনানিতে সভাপতিত্ব করেন বিইআরসির চেয়ারম্যান ও সাবেক বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার ইসলাম। শুনানিতে আরও উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য রহমান মুরশেদ, মাহমুদউল হক ভুঁইয়া, আবদুল আজিজ খান ও মিজানুর রহমান। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক আমজাদ হোসেন, সিপিবির সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, গণসংহতির সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী, প্রকৌশলী মোবাশ্বের হোসেন।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/10/06/160977/