৭ অক্টোবর ২০১৭, শনিবার, ৭:৪৪

রেনাটা লকের অপকীর্তি এবার মিয়ানমারে

সৈয়দ আবদাল আহমদ

এবার মিয়ানমারে অপকর্মে জড়ালেন জাতিসঙ্ঘের শীর্ষ কর্মকর্তা রেনাটা লক ডেসালিয়েন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সেখানে তার বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারই সাবেক সহকর্মী এবং বিভিন্ন ত্রাণসংস্থার কর্মকর্তারা।
ডেসালিয়েনের কথা কি মনে আছে? ইনি সেই কর্মকর্তা যিনি জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুনের মূল চিঠি আড়াল করে তারই বরাতে একটি জাল চিঠি প্রচার করে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের ২২ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন স্থগিত এবং জরুরি অবস্থা জারি করার পথ করে দিয়েছিলেন। তখন তিনি বাংলাদেশে ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসঙ্ঘের প্রধান সমন্বয়কারী ছিলেন। আর এবার তিনি মিয়ানমারে জাতিসঙ্ঘের প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে আরেকটি অপকর্মে জড়ালেন।
গত ৩০ ডিসেম্বর শুক্রবার বিবিসি রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রচার করেছে। জোনাহ ফিশার প্রতিবেদনটি করেন। এতে বলা হয়, মিয়ানমারে জাতিসঙ্ঘের শীর্ষ কর্মকর্তা রেনাটা লক ডেসালিয়েন রোহিঙ্গা সঙ্কটে যে ভূমিকা নিয়েছেন, তা নিয়ে তারই সাবেক সহকর্মী এবং বিভিন্ন ত্রাণসংস্থার কর্মকর্তারা প্রশ্ন তুলেছেন। তারা অভিযোগ করেন, রেনাটা লক জাতিসঙ্ঘের বর্তমান নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করছেন। বর্তমান রোহিঙ্গা সঙ্কটের পূর্ববর্তী চার বছর ধরে এই ইস্যুতে তিনি বিতর্কিত ভূমিকা পালন করে আসছেন। মিয়ানমারে জাতিসঙ্ঘ অফিসের কর্মকর্তাদের তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলতে বারণ করেছেন এবং মানবাধিকার কর্মীদের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন এলাকায় যাওয়া থেকে বিরত রাখতে চেয়েছেন। জাতিসঙ্ঘ স্থানীয় অফিসে রোহিঙ্গা নিয়ে তিনি কর্মকর্তাদের কোনো কথা বলতে দেননি এবং শরণার্থী অধিকারের বিষয়টি মিয়ানমার সরকারের কাছে উত্থাপনেও তিনি বাধা দিয়েছেন।

বিবিসির রিপোর্টে বলা হয়, কানাডার নাগরিক রেনাটা লক ডেসালিয়েনের বিরুদ্ধে তার সাবেক সহকর্মী ও বিভিন্ন ত্রাণসংস্থার কর্মকর্তারা সুনির্দিষ্ট যেসব অভিযোগ আনেন তা হচ্ছেÑ রোহিঙ্গা এলাকায় মানবাধিকার কর্মীদের যেতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করা, এ নিয়ে জনমত গড়ে তোলার কর্মসূচি বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা এবং রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধনের চেষ্টার ব্যাপারে সতর্কবাণী দিয়েছেন যেসব কর্মকর্তা, তাদেরকে বিচ্ছিন্ন রাখার প্রয়াস।

জাতিসঙ্ঘের কর্মকর্তা ক্যারোলাইন ভ্যানডেনাবিলি ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারে জাতিসঙ্ঘের আবাসিক সমন্বয়কের দফতরের প্রধান ছিলেন। রেনাটা লক ডেসালিয়েন বর্তমানে মিয়ানমারে আবাসিক সমন্বয়ক। বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ক্যারোলাইন বলেন, রোহিঙ্গা বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের কর্মকর্তারা এখন আর প্রকাশ্যে কোনো কথা বলছেন না। এটা যেন এখন একটা ‘নিষিদ্ধ’ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমার জাতিসঙ্ঘ অফিসের প্রেস বিজ্ঞপ্তিগুলোতেও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি পর্যন্ত উল্লেখ করা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়। এর কারণ মিয়ানমার সরকার ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ ব্যবহার করে না, তারা ‘বাঙালি’ ব্যবহার করে। তিনি বলেন, আমি যখন মিয়ানমারে কাজ করতাম, তখন জাতিসঙ্ঘ কর্মীরা অকপটে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলত। এখন মিয়ানমারে জাতিসঙ্ঘ অফিসে রুদ্ধদ্বার কক্ষেও আলোচনায় রোহিঙ্গা ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’
মিয়ানমারে কর্মরত ত্রাণকর্মকর্তাদের একাধিক সূত্র বিবিসিকে জানায়, উচ্চপর্যায়ের জাতিসঙ্ঘ বৈঠকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা রীতিমতো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এ ব্যাপারে ভ্যানডেনাবিলি বলেন, শিগগিরই এ বিষয়টি সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সেখানে উচ্চপর্যায়ের জাতিসঙ্ঘ বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলা কিংবা জাতিগত নির্মূল অভিযানের ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এর বাইরে গিয়ে কোনো কর্মকর্তা রোহিঙ্গাদের বিষয় উত্থাপন করলে তাকে একটা পরিণতি ভোগ করতে হয়। এই পরিণতি হচ্ছেÑ তাকে আর কোনো সভায় ডাকা হবে না, ভ্রমণের অনুমতিপত্র ঠিকভাবে পাওয়া যাবে না, চাকরি হারাতে হবে, বৈঠকের মধ্যে সবার সামনে হেনস্তা করা হবে ইত্যাদি। বর্তমানে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে যাতে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কোনো কথাই বলা না যায়।

বিবিসিকে ক্যারোলাইন আরো অভিযোগ করেন, জাতিসঙ্ঘের মানবিক ত্রাণবিষয়ক দফতরের প্রতিনিধিকেও উপেক্ষা করা হয়। তিনি যখন রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন বৈঠকের আয়োজন করেন, তখন তাকে নির্দেশনা দেয়া হয় বৈঠকগুলো যেন এমন সময় করা হয়, যখন জাতিসঙ্ঘের মানবিক ত্রাণবিষয়ক দফতরের (ইউএন ও সিএইচএ) প্রতিনিধি শহরে না থাকেন।
টমাস কুইটানা এখন উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক কর্মকর্তা। তিনি মিয়ানমারে আগে দায়িত্ব পালন করেছেন। আর্জেন্টিনা থেকে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ইয়াঙ্গুন বিমানবন্দরে একবার রেনাটার সঙ্গে দেখা হয়। তিনি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, উত্তর রাখাইনে তার যাওয়া উচিত হবে না। কেন, প্রশ্ন করলে রেনাটা বলেন, এ নিয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো ঝামেলায় তিনি যেতে চান না। অবশ্য এ পরামর্শ গ্রহণ না করে তিনি উত্তর রাখাইনে যান এবং এ ব্যাপারে স্থানীয় মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি বলে জানান। জাতিসঙ্ঘের নতুন মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস দায়িত্ব নেয়ার পরে তার জন্য যে রিপোর্ট তৈরি করা হয়, তাতে মিয়ানমারে জাতিসঙ্ঘ দফতরের কার্যক্রম নিয়ে কঠোর সমালোচনা আছে এবং মিয়ানমারে জাতিসঙ্ঘ অফিস একেবারে অকার্যকর হয়ে পড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। রেনাটা লক এখনো মিয়ানমারে দায়িত্ব পালন করছেন। তাকে বদলি করে তার জায়গায় নতুন কর্মকর্তার নাম পাঠানো হলেও মিয়ানমার সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেছে। ডেসালিয়েনই এখন কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে মিয়ানমারের সরকার রেনাটা লক ডেসালিয়েনকে এত পছন্দ করার কারণ কী? তিনি কার হয়ে সেখানে কাজ করছেন? জাতিসঙ্ঘ না মিয়ানমার সরকারের? তার কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে, তিনি সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের রাখাইন প্রদেশ থেকে চিরতরে নির্মূল অভিযানে সমর্থন করছেন। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে জাতিসঙ্ঘ খুবই সোচ্চার। মহাসচিব এ ইস্যুকে ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে উল্লেখ করে এর কড়া প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন। এ নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ বৈঠক হয়েছে এবং সহিংসতা বন্ধ করা এবং রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সদস্যদেশগুলোর পক্ষ থেকে সর্বসম্মতভাবে আহ্বান জানানো হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের এ ভূমিকাকে পাশ কাটিয়ে সেখানে রেনাটা লক ডেসালিয়েনের অন্য ভূমিকা নেয়ার রহস্য কী?
বাংলাদেশে অবস্থানকালে রেনাটা লকের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের চিঠি পর্যন্ত তিনি জালিয়াতি করেছিলেন, যার ওপর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ঢাকার বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়। জাতিসঙ্ঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুন রাজপথে সহিংসতা বন্ধ এবং এবং সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করার তাগিদ দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু রেনাটা বান কি মুনের মূল চিঠি পাশ কাটিয়ে একটি ভুয়া চিঠি ইস্যু করেন, জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের মূল চিঠির সঙ্গে যার মিল ছিল না। জাতিসঙ্ঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুনের নাম ভাঙিয়ে রেনাটা লক ডেসালিয়েন যে জাল বিবৃতি প্রচার করেন তাতে যে ভাষা প্রয়োগ করা হয় তা হচ্ছে, সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে সেনাবাহিনী ভূমিকা রাখলে শান্তিরক্ষী মিশন থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করার বিষয় জাতিসঙ্ঘ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে। অর্থাৎ জাতিসঙ্ঘ এরূপ কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে বলে প্রচার করা হয়, যা সত্য ছিল না। আর জাল চিঠির এই সুযোগটিই নিয়েছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ ও তার সহযোগীরা। এই চিঠি নিয়েই জেনারেল মইন গং বঙ্গভবনে যান এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে ২২ জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিত করে জরুরি অবস্থা জারি করতে বাধ্য করেন। ২০১০ সালে বিতর্কিত জাতিসঙ্ঘ কর্মকর্তা ডেসালিয়েন বাংলাদেশে তার দায়িত্ব শেষ করে চীনে যাওয়ার প্রাক্কালে স্বীকারও করেছিলেন যে, জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুনের স্বাক্ষর করা চিঠিতে জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কোনো হুঁশিয়ারির কথা ছিল না। কিন্তু প্রায় তিন বছর তিনি এ বিষয়ে চুপ থাকেন। এই কর্মকর্তাটি ‘১-১১’ কুশীলবদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন। পত্রপত্রিকার রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ‘১-১১’র জরুরি অবস্থা জারির আগের কয়েক দিন রেনাটা লক জেনারেল মইন ও অন্য সেনাকর্মকর্তাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি গোপন বৈঠক করেছিলেন। এ বিষয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির তথ্য উপদেষ্টা মোখলেছুর রহমান চৌধুরীর লেখাতেও রেনাটার তৎপরতা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়। এবার রেনাটা লক রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আরো কী অঘটন ঘটান সেটাই দেখার বিষয়।


কেন তিনি জাতিসঙ্ঘের নীতির বিরুদ্ধে কাজ করছেন, এ নিয়ে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। বিবিসির রিপোর্টের পর রেনাটার বিতর্কিত ভূমিকার আরো প্রমাণ পাওয়া গেল। এ ছাড়া, বাংলাদেশে জাতিসঙ্ঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুনের চিঠি জাল করার পরও তিনি কিভাবে দায়িত্বে রয়েছেন, সেটাও প্রশ্ন হয়ে আছে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও জাতীয় প্রেস কাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক
 

 

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/257447