৪ অক্টোবর ২০১৭, বুধবার, ৮:৩৯

যুগ যুগ ধরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বর্মিদের ঘৃণা চর্চা

রোহিঙ্গা নির্মূল কেন-১

রোহিঙ্গা নির্মূলের পেছনে রয়েছে বর্মিদের জাতিগত ও ধর্মীয় বিদ্বেষ। ইতিহাস এ সাক্ষ্যই দিচ্ছে। প্রায় শতাব্দীকাল ধরে অনবরত প্রচার চালানো হয়েছে রোহিঙ্গারা বার্মার নয়, তারা ভারতীয় বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে এসেছে। আর বার্মা শুধুমাত্র বর্মি বৌদ্ধদের জন্য, অন্য কারো জায়গা হবে না এ দেশে। রোহিঙ্গারা বাঙালি। তারা ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী। মুসলমানদের জনসংখ্যা খুব দ্রুত বাড়ছে রাখাইনসহ গোটা বার্মায়। এখনই তাদের থামানো না গেলে এ দেশ একদিন তারা দখল করে নেবে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান একদিন বৌদ্ধদের ছিল। পরে মুসলমানেরা দখল করেছে। একদিন মিয়ানমারও দখল করবে। তাই আর সময় নেই। এখনই তাদের দমন করতে হবে যেকোনোভাবেই হোক। বার্মার প্রায় প্রতিটি বৌদ্ধ জন্মের পর থেকে ক্রমাগতভাবে এ বিষের গান শুনতে শুনতেই বড় হয়েছে এবং তাদের বুকের মধ্যে জমানো বিষ দিনে দিনে কালো হয়েছে। গোটা বার্মায় মুসলমানদের জনসংখ্যা শতকরা মাত্র ৫ ভাগ হলেও জঘন্য মিথ্যা আর অপপ্রচারের জোরে আজ এসব কাল্পনিক গল্প আর গুজবই সেখানে প্রতিষ্ঠিত সত্য। শুধু অশিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিতরাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া প্রায় সব উচ্চ শিক্ষিতরাও বিশ্বাস করে মুসলমানদের সম্পর্কে এ মিথ্যাচার। বর্তমানে চলমান রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বর্মি সেনা আর তাদের লেলিয়ে দেয়া স্থানীয় বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের পৈশাচিকতার প্রতি সবার সমর্থন এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে গোটা বার্মা বা মিয়ানমারের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান এ সত্যেরই সাক্ষ্য দিচ্ছে।
প্রথমে পরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের সম্পর্কে বর্মি বৌদ্ধদের মনে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে এক ভীতি আর আতঙ্ক। এ ভীতি-আতঙ্ক থেকে বৌদ্ধ জাতি আর বার্মাকে রক্ষা করার জন্য সব রাষ্ট্রযন্ত্র, সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠন, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যমের সহায়তায় রোহিঙ্গাসহ বার্মার মুসলমানদের বিরুদ্ধে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে চরম ঘৃণার বিষ। ক্রমাগতভাবে মিথ্যাচারের মাধ্যমে বর্মি বৌদ্ধদের মধ্যে উসকে দেয়া হয়েছে সাম্প্রদায়িকতা, বিদ্বেষ ও জিঘাংসা। রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে বৌদ্ধদের রক্ত যেন টগবগ করে জ্বলে ওঠে আগ্নেয়গিরিতে রূপ নেয় এমন সব উসকানিমূলক জঘন্য বক্তব্য দিয়েছে ভিক্ষু নামক অনেক বৌদ্ধ সন্ত্রাসী নেতা। আর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে গোপন ও প্রকাশ্য সমর্থন দিয়েছে বর্মি সেনাবাহিনী ও তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ছড়িয়ে দেয়া জাতিগত ও ধর্মীয় বিদ্বেষের এ আগ্নেয়গিরির আগুনে পুড়ে মরছেন অসহায় রোহিঙ্গারা।
বাস্তবে ভূত না থাকলেও ভূতের গল্প পড়ে শিশু যেমন ভূতে বিশ্বাস করে তেমনি মিয়ানমারের প্রায় প্রতিটি বৌদ্ধ আজ রোহিঙ্গাসহ সব মুসলমানকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখছে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এতই হিংসা বিদ্বেষ ঘৃণা আর অপপ্রচার চালানো হয়েছে যে, বিষাক্ত সাপ দেখলে যেমন মানুষ নিজেকে রক্ষার জন্য তাকে পিটিয়ে মারে তেমনি রোহিঙ্গা দেখা মাত্র তাদের গুলি করে, হত্যা করে, পিটিয়ে মেরে ফেলা উচিত বলে মনে করে অনেক বর্মি।
তাই তো তারা মায়ের কোল থেকে নবজাতক শিশু কেড়ে নিয়ে আগুনে নিক্ষেপ করছে। কেটে টুকরো টুকরো করছে। রোহিঙ্গাদের ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারে একসাথে সবাইকে। জীবন নিয়ে কেউ কেউ পালিয়ে যাওয়ার সময়ও পেছন থেকে গুলি করে মারছে। মৃত রোহিঙ্গার চামড়া তুলে, কাটা অঙ্গ নিয়ে উল্লাস নৃত্য করে।
রোহিঙ্গাদের প্রতি যদি কেউ কোনো ধরনের সহমর্মিতা দেখায় তবে তারও রক্ষা নেই মিয়ানমারে। সোয়ে চায় নামক এক বর্মি নারী রোহিঙ্গাদের খাবার দেয়ার অপরাধে তার চুল কেটে গলায় ‘আমি জাতীয় বেঈমান’ সাইনবোর্ড টাঙিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরিয়েছে বর্মিরা।
রোহিঙ্গাসহ মুসলমানদের বিরুদ্ধে বর্মিদের এতটাই ক্ষেপিয়ে তোলা হয়েছে যে, চলমান গণহত্যা এবং নির্মূল অভিযান পরিচালনার সময় ১২ সেপ্টেম্বর মধ্য মিয়ানমারের মাগওয়েতে এক ব্যক্তি রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে, ‘রাস্তায় কি কোনো মুসলমান আছে? বেরিয়ে আয়! আমি তোকে হত্যা করব।’
ইসলামবিষয়ক কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক টিন মাউং থান জানান, মিয়ানমারের সাধারণ আতঙ্ক হচ্ছে, ‘মুসলিমরা আমাদের দেশ দখল করবে’। তিনি বলেন, মিয়ানমারের জনসংখ্যার মধ্যে মুসলমানরা মাত্র চার শতাংশ (রোহিঙ্গারা বাদে)। এতো ক্ষুদ্র সংখ্যা হয়ে কিভাবে আমরা মিয়ানমার দখল করব?
রোহিঙ্গাসহ মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংস্রতা উসকে দেয়া বৌদ্ধ সন্ন্যাসী অশিন ভিরাথু ২০১৩ সালে মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী মান্দালয়ে এক সমাবেশে ৯০ মিনিটের বক্তব্যে বলেন, এখন শান্ত থাকার সময় নয়। এখন জেগে ওঠার সময় যখন আপনাদের রক্ত টগবগ করতে হবে। মুসলমানরা খুব দ্রুত বাড়ছে। তারা আমাদের মেয়েদের চুরি করছে, ধর্ষণ করছে। তারা আমাদের দেশ দখল করবে। কিন্তু আমরা এটা হতে দেবো না। মিয়ানমার অবশ্যই বৌদ্ধদের জন্য রাখতে হবে।
বারাক ওবামার রক্তে বইছে কাল মুসলমানদের রক্তের ধারা। আরবরা জাতিসঙ্ঘ দখল করেছে। মিয়ানমারের মুসলমানদের ৯০ ভাগই চরমপন্থী, খারাপ। শত শত বছর আগে মুসলমানেরা ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান দখল করেছে যা এক সময় বৌদ্ধদের ছিল। এখন তাদের নতুন ভূমি দরকার। তারা মিয়ানমার দখল করবে। আরবরা এখানে মসজিদ নির্মাণের জন্য টাকা ঢালছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনে ভিরাথুর এসব সাম্প্রদায়িক বক্তব্য তুলে ধরে ২০১৩ সালের জুলাই প্রথম সংখ্যায়। সেখানে ভিরাথু সম্পর্কে বলা হয়, ২০০৩ সালে তাকে সাত বছর জেল দেয়া হয়েছিল। অন্য একটি প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়েছে, সে মিয়ানমারের একজন জাতীয় সন্ত্রাসী এবং তার তেমন কোনো লেখাপড়া নেই। ২০০৫ সালে তাকে ২৫ বছর জেল দেয়া হলেও ২০১০ সালে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। অশিক্ষিত বর্বর এই লোকটি বৌদ্ধভিক্ষু সেজে ভিক্ষু ও অগণিত সাধারণ বর্মির নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং গোটা মিয়ানমারে বৌদ্ধদের কাছে মুসলমানদের সম্পর্কে চরম হিংস্রতা আর ঘৃণা ছড়িয়ে দিচ্ছে। ২০১২ সালে রাখাইনসহ মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা ছড়িয়ে তাদের নির্বিচারে হত্যা ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার পেছনে তার ঘৃণ্য উসকানিমূলক বক্তব্য এবং তার লেলিয়ে দেয়া বাহিনীকে দায়ী করা হয়েছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও গণমাধ্যমে। টাইম ম্যাগাজিন তাদের কভার পেজে তার ছবিসহ হেডলাইন করেছিল ‘দ্য ফেস অব বুদ্ধিস্ট টেরর’। ভিরাথু মিয়ানমারের ধর্ম ও জাতিসত্তা রক্ষা সংগঠন মা বা থা, ৬৯৬ আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/256977