৩ অক্টোবর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:১৪

আসামে আতঙ্কে বাংলাভাষী মুসলিমরা

আসামের লাখ লাখ বাংলাভাষী মুসলিম আতঙ্কে রয়েছেন। যথাযথ তদন্ত না করেই তাদেরকে বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসী হিসেবে নোটিশ ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, পুলিশ এসব মানুষকে অবৈধ অভিবাসী বা বাংলাদেশি বলে রিপোর্ট করে দিচ্ছে! এমন অবস্থার শিকার হয়ে আসামের কমপক্ষে ছয়টি বন্দিশিবিরে আটকে আছেন হাজার খানেকেরও বেশি বাংলাভাষী মানুষ। সর্বশেষ এমন আচরণের শিকার হয়েছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ৩০ বছরেরও বেশি জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার (জেসিও) পদে চাকরি করে অবসরে যাওয়া গুয়াহাটির বাসিন্দা মুহাম্মদ আজমল হক। তাকে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বলে নোটিশ দেয়া হয়েছে। তিনি যে বাংলাদেশি নন এটা প্রমাণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে জেসিও পদে অবসরপ্রাপ্ত একজন কমিশন্ড অফিসার। গত ৩০ বছরের চাকরিজীবনে তাকে মোতায়েন করা হয়েছে সেকান্দারাবাদ, গুরুদাসপুর, চণ্ডিগড়, কোটা, তাওয়াং ও মিরাটে। কিন্তু আসাম সরকার বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসীদের শনাক্তকরণে যে আদালত বসিয়েছে তারাই আসামের কামরূপের বাসিন্দা মুহাম্মদ আজমল হককে নোটিশ পাঠিয়েছে। বলা হয়েছে, তাকে এখন প্রমাণ করতে হবে যে, তিনি ভারতীয় নাগরিক। আজমল গত বছর ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে অবসর লাভ করেছেন। আসামে বাংলাভাষীদের অহরহ যে এ রকম নোটিশ দেয়া হচ্ছে এটি তারই একটি প্রমাণ। সেখানে বাংলাভাষী বলতে বোঝানো হচ্ছে বাংলাদেশি অভিবাসী। তারই শিকার হয়েছেন আজমল। এ নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া গুরুত্ব দিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। আজমলকে যে নোটিশ দেয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পরে বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই তিনি ভারতে প্রবেশ করেছেন। আসাম চুক্তির অধীনে ওই তারিখের পরে যারা ভারতে প্রবেশ করেছেন তারা ভারতীয় বৈধ নাগরিক বলে বিবেচ্য নন। তাই আজমলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তিনি যেন প্রমাণ করেন যে, তিনি একজন ভারতীয় বৈধ নাগরিক। উল্লেখ্য, আজমল হকের বর্তমানে বয়স ৪৯ বছর। তিনি ১৯৮৬ সালে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে যোগ দেন। অবসরে যান গত বছর ৩০শে সেপ্টেম্বর। এ নিয়ে বিবিসিতে ভারতীয় সাংবাদিক শুভজ্যোতি ঘোষ লিখেছেন, আজমল হক জানিয়েছেন, এত লম্বা সময় ধরে দেশের সেবা করার পর তাকে এভাবে অপমানিত ও অপদস্থ হতে হবে তা তিনি কখনো কল্পনাও করেন নি। আসামের মানবাধিকার আইনজীবীরাও বলছেন, সে রাজ্যে যে রকম ঢালাওভাবে বাংলাভাষী মুসলিমদের কাছে অবৈধ বিদেশি হিসেবে নোটিশ পাঠানো হচ্ছে আজমল হকও তার সামপ্রতিকতম ভিকটিম এবং বাংলাদেশি খোঁজার এই হিড়িকে আসামে লাখ লাখ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হচ্ছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তিরিশ বছরের কর্মজীবনের শেষে গত বছরই জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার হিসেবে অবসর নিয়েছেন মুহাম্মদ আজমল হক। তার গ্রামের বাড়ি আসামের রাজধানী গুয়াহাটির কাছে ছায়াগাঁওতে যখন নিশ্চিন্তে বাকি জীবনটা কাটাবেন বলে সবে থিতু হয়েছেন- তখনই তার কাছে আসাম পুলিশের নোটিশ এসেছে- তিনি না কি অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসেছিলেন। আজমল হক বলেন, আমি ভারতের নাগরিক। তিরিশ বছর ধরে দেশের সেবা করেছি। এখন রিটায়ার করার পর বালবাচ্চা নিয়ে গুয়াহাটিতে নিজের বাড়িতে থাকি। এখন আচমকা আমাকে নোটিশ পাঠিয়ে বলা হচ্ছে- আমি না কি অবৈধ, আমি না কি ১৯৭১ সালের পর আসামে এসেছি! এই খবরটা শুনে তো আমি অতিশয় দুঃখ পেলাম, আমার দিলটা একেবারে ভেঙে গেল। কী হচ্ছেটা আমার সঙ্গে? নিজের দেশেই আজ আমি বিদেশি হয়ে গেলাম- তাও আবার তিরিশ বছর দেশকে সেবা দেয়ার পর?

অথচ সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পাওয়ার সময় এই আসাম পুলিশই তাকে ভারতের নাগরিক হিসেবে ভেরিফাই করেছিল- আর এখন তারাই আবার তার নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। আজমল বলেন, এটাই তো আমি ভেবে পাচ্ছি না। কারণ যখন একজন জওয়ান ভারতীয় সেনায় ভর্তি হন, পুলিশ তার প্রপার ভেরিফিকেশন করে। পুলিশ তার গ্রামে গিয়ে বাবা-মা’র কাগজপত্র খতিয়ে দেখে, বংশপরিচয় খোঁজ নিয়ে তারপরই তাদের রিপোর্ট পাঠায়- তারপরই আমাদের ‘কসম প্যারেড’ হয়। এত কিছুর পরেও আজ যে তাদের সন্দেহ হচ্ছে, এটা আমার জন্য অত্যন্ত দুঃখের, অপমানের ও লজ্জার বিষয়! এটা কিন্তু আমার প্রাপ্য ছিল না। (সাবেক) প্রেসিডেন্ট এপিজে আবদুল কালাম সাহেব আমাকে সেনাবাহিনীতে জেসিও হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিরিশ বছর ধরে দেশের হয়ে বিভিন্ন কঠিন পোস্টিংয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমি ডিউটি করেছি। তারপরেও যদি দেশের মানুষ বা আসাম সরকার আমাকে এভাবে চরম অপমান করে, আমি শুধু ন্যায্য বিচারই দাবি করবো।

আসলে আজমল হক হলেন আসামের সেই লাখ লাখ বাঙালি মুসলিমদের একজন, যাদের অবৈধ বিদেশি বলে ঢালাও নোটিশ পাঠানো হচ্ছে আর ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়ে তাদের ভারতীয়ত্ব প্রমাণ করতে হচ্ছে। এ রকম বহু কেস নিয়ে লড়ছেন রাজ্যের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার আইনজীবী আমান ওয়াদুদ। তিনি বলেন, কেউ কিন্তু আজমল হকের কাছে কোনো কাগজ বা নথিপত্র চায় নি। কোনো তদন্ত ছাড়াই বলে দেয়া হচ্ছে যে, তিনি নাকি ১৯৭১-এর পর বাংলাদেশ থেকে আসামে এসেছিলেন। আর এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, আসামে লাখ লাখ লোকের সম্পর্কে কোনো তদন্ত না করেই পুলিশ তাদের অবৈধ অভিবাসী বা বাংলাদেশি বলে রিপোর্ট করে দিচ্ছে! ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে কিন্তু শতকরা আশি ভাগ কেসই ভারতীয় নাগরিক বলে প্রমাণিত হচ্ছে। তার মানে এটাই যে, পুলিশ কোনো ঠিকঠাক তদন্ত ছাড়াই এই রিপোর্টগুলো দাখিল করে দিচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তো কোনো তদন্তই হয় না। ফলে পরিস্থিতি খুব গুরুতর। এই মুহূর্তে রাজ্যের ছটি ডিটেনশন শিবিরে হাজারখানেকেরও বেশি লোক আটক আছেন। বাংলাদেশও তাদের নেবে না- আর কেনই বা নেবে, তারা তো আসলেই ভারতীয় নাগরিক! বাংলাদেশ এদের কিছুতেই নিতে রাজি হবে না, জানা থাকা সত্ত্বেও কথিত বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছেই- কারণ আসামে এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি রাজনৈতিক ইস্যু।

মুহাম্মদ আজমল হক বলেন, পাঁচ বছর আগে তিনি যখন সেনাবাহিনীর সার্ভিং অফিসার- তখন তার স্ত্রীও এই ধরনের নোটিশ পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, তখন আমি চণ্ডীমন্দির ক্যান্টনমেন্টে পোস্টেড, আমার স্ত্রীও সঙ্গেই ছিলেন। দেশ থেকে জানানো হলো, আমার স্ত্রীর নামে না কি নোটিশ এসেছে- তিনি বিদেশি। সঙ্গে সঙ্গে আমি ছুটে গিয়ে কোর্টে কাগজপত্র সব জমা দিলাম, মহামান্য আদালত রায় দিলেন- না, মমতাজ খানম ওয়াইফ অব আজমল হক অবশ্যই ভারতের একজন বৈধ নাগরিক! আমাদের গ্রামেই তো অন্তত চল্লিশ জনের বিরুদ্ধে এরকম বিদেশি বলে নোটিশ এসেছে। কিন্তু আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি- চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারি, তারা সবাই নিজেদেরকে ভারতীয় বলে প্রমাণ করতে পারবে। আগামী ১৩ই অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে গিয়ে ভারতের এই সাবেক সেনা নিজের নাগরিকত্ব হয়তো প্রমাণ করতে পারবেন- কিন্তু ঠিকঠাক কাগজপত্র না থাকা আসামের লাখ লাখ বাঙালি মুসলিম কিছুতেই ততটা আশাবাদী হতে পারছেন না।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=85642