২ অক্টোবর ২০১৭, সোমবার, ৮:৩৭

ইনানী সৈকতে এক বিভীষিকা

কক্সবাজারের ইনানি সমুদ্র সৈকত। সারি ধরে শুইয়ে রাখা হয়েছে লাশ। বেশির ভাগই শিশুর লাশ সেগুলো। পুরনো লুঙ্গি বা শাড়ি দিয়ে ঢেকে রাখা লাশগুলোর পাশে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন স্বজনরা। কাঁদছেন সাধারণ মানুষ। কাঁদছেন উদ্ধারকর্মীরাও। একসঙ্গে এত শিশুর লাশ দেখে বিবেকবোধ সম্পন্ন কোনো মানুষই অশ্রু ধরে রাখতে পারেননি। তার পাশে এসে নিজের স্ত্রী, দুই মেয়ে আর নাতিকে খুঁজছিলেন আবদুল কালাম (৫৫)। এক পর্যায়ে তাদের মৃতদেহ খুঁজে পান তিনি। তার কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়। আকাশ যেন আরো ভারি হয়ে ওঠে। কালো মেঘ থেকেও নেমে আসে কান্নারূপে বৃষ্টি। এ এক মর্মস্পর্শী, এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি ইনানি সমুদ্রসৈকতে। মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ও বৌদ্ধদের নৃশংস নির্যাতন থেকে পালাতে গিয়ে নৌকাডুবে নিহতদের লাশ নিয়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় সেখানে। সর্বশেষ নৌকাডুবিতে নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে ৬০। এর বেশির ভাগই শিশু। কমপক্ষে ৮০ জন রোহিঙ্গাকে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাতে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে নৌকা ছুটেছিল বাংলাদেশের উদ্দেশে। কিন্তু না, তারা বাঁচতে পারেনি। যখন বাংলাদেশের স্থলভাগ দৃষ্টিগোচর হয় তখনই উত্তাল ঢেউ আর বাতাসের কারণে নৌকাটি ডুবে যায়। রচনা হয় আরো একটি ট্র্যাজেডি। তবে ওই নৌকাডুবি থেকে রক্ষা পেয়েছেন আবদুল কালাম। তিনি বলেছেন, এক সপ্তাহ আগে তার গ্রামে হানা দেয় বৌদ্ধদের সশস্ত্র একটি গ্রুপ। আবদুল কালামের পালিত পশু, ঘরে থাকা খাবার সব কিছু কেড়ে নিয়ে যায় তারা। সেনা অফিসে তলব করা হয় আবদুল কালামসহ অন্যদের। সেখান থেকে তাদেরকে বলা হয়, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নামে কোনো মানুষ থাকতে পারবে না। আবদুল কালাম বলেন, এরপরই তিনি সিদ্ধান্ত নেন দেশ ছেড়ে আসার। পরিবার নিয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। সেই যাত্রাই যে এতগুলো মানুষের শেষ যাত্রা হবে তা তিনি বুঝতে পারেননি। তাই মৃত স্বজনদের লাশের পাশে বসে আহাজারি করে আকাশ বাতাস ভারি করছিলেন। অভুক্ত, শোকার্ত আবদুল কালামের কান্নার সঙ্গে অন্যদের কান্না মিলেমিশে এক মর্মস্পর্শী দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। অভিবাসন বিষয়ক জাতিসংঘের সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) বলছে, ওই নৌযানে অতিরিক্ত মানুষ বোঝাই করা হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই হয়তো মারা গেছেন না হয় নিখোঁজ আছেন। ধরে নেয়া যায় তারা মারা গেছেন। আইওএমের মুখপাত্র জোয়েল মিলম্যান বলেছেন, সর্বশেষ এই ট্র্যাজেডির শিকার হয়েছেন যেসব মানুষ তারা দু’দিন ধরে সমুদ্রে ছিলেন। তাদের কাছে কোনো খাবার ছিল না। সামনে ছিল শুধু উত্তাল, বিভীষিকাময় সাগরের ঢেউ। নৌযানটির যে চালক তিনি যাত্রীদের পার করে দেয়ার জন্য কোনো ভাড়া নেননি। সমুদ্রে টহল বা চেকপয়েন্ট এড়িয়ে তিনি এসব মানুষকে নিরাপদে নামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিলেন বাংলাদেশে। একপর্যায়ে তিনি নৌযানটি নোঙর করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তার এ সিদ্ধান্তটি ভয়াবহ এক ভুলে পরিণত হয়। তিনি যতটা ভেবেছিলেন তার চেয়ে উন্মত্ত ছিল সমুদ্র। আর সামান্য সময় পেরুলেই তিনি তীরে পৌঁছতে পারতেন।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=85523