রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রবেশ থামছে না
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:৪৮

গণহত্যা এখনো চলছে

থামছে না রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ; ইনানীতে আরো ৭ লাশ উদ্ধার ; মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২১


মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সে দেশের সেনাবাহিনীর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও অব্যাহত রয়েছে। বর্বর নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে রোহিঙ্গারা গ্রাম ছেড়ে পাহাড়ে জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ দিকে কক্সবাজারের ইনানী সমুদ্র উপকূলে নৌকাডুবিতে মারা যাওয়া শিশুসহ আরো সাত রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে স্থানীয়দের সহযোগিতায় এসব লাশ উদ্ধার করা হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে ১৪টি লাশ উদ্ধার করা হয়। ২১টি লাশ আইনি প্রক্রিয়া শেষে গতকাল বেলা ১১টার দিকে ইনানীর একটি কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এ ছাড়া গত রাত পর্যন্ত ২৭ রোহিঙ্গাকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৯ জন কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার ভোর রাত থেকে যখন বৃষ্টি হচ্ছিল তখন শাহপরীর দ্বীপের জালিয়া পাড়া, জেটি ঘাট, মিস্ত্রিপাড়া, দক্ষিণ পাড়া, ঘোলা পাড়া দিয়ে দলে দলে বাংলাদেশে ঢুকেছেন রোহিঙ্গারা। স্বামীকে হারিয়ে চার সন্তান নিয়ে বৃহস্পতিবার নাফনদী পাড়ি দিয়ে শাহপরীর দ্বীপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ফাতেমা বেগম (২৮)। তিনি রাখাইনের ধংখালী গ্রামের বাসিন্দা। তিনি জানালেন, সেনাবাহিনী ও রাখাইনরা মিলে গুলিবর্ষণ, গলা কেটে হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। ‘রোহিঙ্গা অক্কল যত দিন বর্মাত আছে হেটো দিন তুয়ারারে মাইজ্জুম, জান বাঁচাইতো মনে হয়লে এ দেশত্যু জোগুই’ তার কথা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যত দিন থাকবে তত দিন নির্যাতন চালানো হবে, প্রাণে বেঁচে থাকতে চাইলে এ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাও। সেনারা এভাবে মাইকিং করে যাচ্ছে গ্রামে গ্রামে।

ফাতেমার কোলে ছিল ছোট সন্তান নুর কায়েছ (২)। প্রচণ্ড জ্বরে শিশুটি মায়ের কোলে ছটফট করছিল। গত মঙ্গলবার রাতে সেনারা তাদের গ্রামে আবারো হামলা চালায়, নির্বিচার গুলিবর্ষণ করে। গুলির শব্দ শুনে তিনি সন্তানদের নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পাশের প্যারাবনে ঢুকে পড়েন। তখন তার স্বামী ঘরের একটু পূর্বে ধানক্ষেতে লুকিয়ে ছিল। কিন্তু সেখানে তার রক্ষা হয়নি। তাকে ধরে নিয়ে রাস্তায় গলা কেটে হত্যা করে সেনারা। সেনারা চলে গেলে ধানক্ষেতে গিয়ে দেখি তার লাশ। সেনারা আমার চার সন্তানকে এতিম করেছে। আল্লাহ তাদের বিচার করবে।
চার সন্তান নিয়ে আরো ১৫ জন দুঃখিনীর সাথে এপারে পালিয়ে সীমান্তে পৌঁছি। সেখানেও প্রাণে রক্ষা পাওয়া খুবই কঠিন। সেনারা এখন জঙ্গল ও প্যারাবন লক্ষ্য করেও গুলি চালাচ্ছে। বৃহস্পতিবার ভোরে নৌকায় নাফ নদী পার হয়ে শাহপরীর দ্বীপ জালিয়া পাড়া সীমান্ত দিয়ে এপারে আসি। জানি না কোথায় যাবো। বৃষ্টির কারণে আর কোথাও যেতে পারছি না। দু’দিন ধরে শুধু মুড়ি খেয়ে আছি।

ওই সময় রাস্তার একটু দূরে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ছিল নুর কামাল নামে একটি শিশু। তার বয়স ৭ বছর। তার চোখে মুখে আতঙ্ক ও কান্নার ছাপ। হঠাৎ দৌড়ে এসে বলল, ‘আরা ঘর যে বর্মাত, মিলিটিরিয়ে আর মা-বাপরে জরগরাই দিয়ে যে’। তার কথার অর্থ দাঁড়ায়, আমার বাড়ি মিয়ানমারে, আমার চোখের সামনে মা-বাবাকে গলা কেটে হত্যা করেছে সেনারা। আমি কিছুই করতে পারিনি, কী করব, ছোট মানুষ। সে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে শিশুটি।
রোহিঙ্গা পারাপারের নৌকার মাঝি আবদুর রশিদ বলেন, ‘মিয়ানমারে যেসব গ্রামে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রয়েছে সেখানে আবারো হামলা চালাচ্ছে সেনারা, যাতে রোহিঙ্গারা পালিয়ে যায়। বিশেষ করে মংডু এলাকার চমইন্ন্যা, পতেংজা, ধংখালী, মগন্নি পাড়া, হাসসুরাতা, শিলখালী, ভরডেইল, সাইরা পাড়ায় এখনো হত্যা, গুলিবর্ষণ ও জ্বালাও-পোড়াও অব্যাহত রেখেছে তারা। বৃহস্পতিবার ভোরে তার নৌকা করে পতেঙজা পাড়ার ২৫ জন রোহিঙ্গা শাহপরীর দ্বীপ জেটি ঘাট পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। বিনিময়ে যে যা দিয়েছে তা নিয়েছে। অনেকে কিছুই দিতে পারেনি। মানবিক চিন্তা করে নিষ্পাপ শিশুদের প্রাণ রক্ষা করতে তাদেরকে নৌকা দিয়ে সহযোগিতা করছি। কারণ আমার বাড়িও মিয়ানমারে পতেঙজা। এ ছাড়া মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া চর, গদুরছড়া ও ধংখালী এলাকার প্রায় ১০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা এপারে আসার অপেক্ষায় রয়েছে। তিনিও নিজের জন্মভূমিতে পরবাসী হয়ে পালিয়ে এসে এখন শাহপরীর দ্বীপ ভাঙ্গা নামক এ স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। ’
শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তে স্থানীয় বাসিন্দা আবদুস সালাম জানান, গত বুধবার রাতে শাহপরীর দ্বীপের জেটি ঘাট এলাকার ওপারে প্রচণ্ড গুলির শব্দ শোনা গেছে। সকালে উঠে ডাঙ্গাতে গিয়ে দেখা যায়, বৃষ্টিতে ভিজে নাফ নদী পার হয়ে শাহপরীর দ্বীপ দিয়ে দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ ছিল নারী ও শিশু।

মংডুর পতেঙজা থেকে দ্ইু শিশুসন্তান নিয়ে পালিয়ে এসেছেন নুর নাহার। বৃহস্পতিবার ভোরে সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয়ের খোঁজে লেদা ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি। নুর নাহার জানান, মিয়ানমার সেনারা রোহিঙ্গাদের পাড়ায় পাড়ায় এখনো হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। মঙ্গলবার দুপুরে বাড়িতে ঢুকে তার ভাই হাসানকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সন্তানদের নিয়ে ধানক্ষেতে লুকিয়ে ছিলাম বলে বেঁচেছি। পরে জানতে পারেন তার ভাইকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই পাড়ায় অন্তত ১০০ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানান নুর নাহার।
মংডু মগনিপাড় গ্রামে দেড় হাজার বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে সেনাবাহিনী। তাদের এ অভিযানে সহায়তা করেছে স্থানীয় রাখাইনরা। ওই গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছেন অবস্থাপন্ন জেলে মো: শফি উল্লাহ। তিনি জানালেন, সেখানে এখনো পরিস্থিতি ভয়াবহ। শীলখালীর এক গ্রামেই পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে সহ¯্রাধিক ঘরবাড়ি। রোহিঙ্গারা পালিয়েও বাঁচতে পারছেন না।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/255924