উখিয়ার বালুখালী এলাকায় খোলা আকাশের নিচে এক রোহিঙ্গা শিশুর ঘুম
২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:১৫

তমব্রু সীমান্তে এখনো জ্বলছে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর

বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের তমব্রু এলাকায় এখনো জ্বলছে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহায়তায় রাখাইনরা বাছাই করে বাড়িঘরগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে। এপারে বান্দরবানের তমব্রু গ্রাম থেকে আগুনের শিখা স্পষ্ট দেখা যায়। তবে রাখাইনরা আগের মতো অনেক বাড়ি একসাথে পোড়াচ্ছে না। এরা বিকেলের দিকটা বেছে নিচ্ছে পোড়ানোর জন্য। সাংবাদিকেরা রিপোর্ট পাঠানোর জন্য বিকেলের দিকে সীমান্ত এলাকা ছেড়ে চলে যান এটা ওরা জেনে গেছে।
এদিকে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) এবং সেনাবাহিনী তাদের সীমান্তে টহল জোরদার করেছে। ফলে আগের মতো একসাথে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারছেন না বলে আশ্রয়শিবিরে আসা তাদের আত্মীয়স্বজনেরা জানিয়েছেন। রোহিঙ্গারা এখন ছোট ছোট দলে বা একটি অথবা দু’টি পরিবার একসাথে করে আসছে। জামাল তার পরিবারের লোকজন নিয়ে গত সোমবার বালুখালী এলাকায় রাস্তার পাশে বসেছিলেন। তিনি জানালেন, অনেক সাবধানে আমাদের আসতে হয়েছে। কারণ মগেরা (মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অথবা রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকজন) আমাদের দেখলেই গুলি করে। গুলবানু বেগম বালুখালী মাদরাসার পাশে একটি ভবনের নিচে বসেছিলেন তার ছোট ছোট পাঁচ সন্তান নিয়ে। তিনি বলেন, আমার স্বামীকে মগেরা গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমি সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে এসেছি আরেকটি পরিবারের সাথে।
বান্দরবান জেলার তমব্রু গ্রামের কামাল হোসেন বলেন, আগে বার্মিজরা সকাল থেকে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিত। এখন এরা বিকেলের দিকে জ্বালিয়ে থাকে। সারারাত জ্বলে পরের দিন সকাল বেলা ছাই হয়ে যায়। তিনি বলেন, শুধু রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়েই এরা ক্ষান্ত হচ্ছে না, ওখানকার মুসলমানদের ঐতিহ্যকেও শেষ করে দিচ্ছে।
কামাল হোসেন বলেন, মিয়ানমারসহ বাংলাদেশের লোকজন ব্রিটিশদের অধীনে থাকার সময় তমব্রু একটা গ্রাম ছিল। ব্রিটিশরা দেশভাগের সময় তমব্রু গ্রামকে দুই ভাগ করে দিয়ে যায়। আমাদের পূর্বপুরুষদের কেউ ওপারে থেকে যান এবং আমরা চলে আসি এপারে। ওপারে একটা বিশাল বড় কবরস্থান রয়েছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের সেখানে কবর দেয়া হয়েছে। আজকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের তাড়িয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না, তারা পুরনো সেই কবরস্থানের ওপর ব্যারাক তৈরি করে আমাদের মনে আঘাত করেছে।

তিনি বলেন, ওপারে অনেক পুরনো মসজিদ রয়েছে, সেগুলো ওরা ভেঙে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আমরা এখান থেকে দেখি কিন্তু কিছু করতে পারি না। এরা আমাদের পূর্বপুরুষদের কবরে নাচানাচি করছে, অত্যাচার করছে। আমাদের ঐতিহ্যকে সম্মান করছে না।
তমব্রুর বাসিন্দা উখিয়ার কলেজছাত্র জসিম উদ্দিন বলেন, ঈদের পরদিন আমাদের গ্রামে মিয়ানমার সেনাদের গুলি এসে লেগেছে। ওরা বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত ওখানকার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিলে সেখান থেকে জ্বলন্ত ছাইও এসে এখানে পড়ছে। আমরা আতঙ্কে আছি কবে যেন সে আগুনে আমাদের বাড়িঘরও জ্বলে যায়।
তমব্রুর নো ম্যানস ল্যান্ডে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছেন। পুড়ে যাওয়া বাড়িঘরের ছাই এসে তাদের গায়ে পড়ে। নীরবে আহাজারি করা ছাড়া তাদের করার কিছুই থাকে না।
জসিম উদ্দিন জানান, নো ম্যানস ল্যান্ডে পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে এখনো মানুষ জখম হচ্ছে। তমব্রুর নো ম্যানস ল্যান্ডে এক হাজার ৪০০ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন। চার-পাঁচজন রোহিঙ্গা মাইন বিস্ফোরণে হাত-পা হারিয়েছেন। এদের সবাই বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
বালুখালী আশ্রয়শিবিরে ১৫ দিন আগে এসেছেন হাফেজ রহিম আলী। তিনি বলেন, জান বাঁচাতে চলে এসেছি। কিন্তু পরে শুনেছি আমি যে মাদরাসার শিক্ষক ছিলাম সেটি পুড়িয়ে দিয়েছে মগরা। মাদরাসায় থাকা কুরআন এবং হাদিসের বইগুলো মগেরা পুড়িয়ে দিয়েছে।
তমব্রুর আশ্রয়শিবিরে ত্রাণসামগ্রী অপ্রতুল : তমব্রু বালুখালী থেকে কিছুটা দূরে ও প্রত্যন্ত এলাকা হওয়ায় সেখানে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে না। তাছাড়া এ আশ্রয়শিবিরটি নো ম্যানস ল্যান্ডে তৈরি করা হয়েছে বলে সেখানে ত্রাণ নিয়ে কেউ যেতেও পারেন না। বিজিবির সদস্যরা নো ম্যানস ল্যান্ডে কাউকে যেতে দিচ্ছেন না।

সরেজমিন তমব্রু গিয়ে দেখা গেছে, উখিয়া ও টেকনাফের রাস্তার পাশে আশ্রয়শিবিরগুলোতে যে হারে ত্রাণসামগ্রী যাচ্ছে সে তুলনায় তমব্রু কিছু দূরে এবং দুর্গম বলে সেখানে সে হারে ত্রাণ দাতারা যাচ্ছেন না এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধাও নেই। তবে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ও ওষুধ রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে নিয়ে যাচ্ছেন। মিয়ানমারের তমব্রুর সৈয়দুল আমিন জানান, এ আশ্রয়শিবিরে আমরা যথেষ্ট ত্রাণ পাচ্ছি না। এখানে পানিও পর্যাপ্ত নয়। অল্প কয়েকটা কল বসানো হয়েছে; কিন্তু অনেক বেশি আয়রন ও গন্ধ থাকায় এগুলোর পানি পান করা যায় না। বাধ্য হয়ে আমরা ছড়ার পানি খাই। ফলে ডায়রিয়া, আমাশয় হচ্ছে শিশুদের। এখানে কোনো স্যানিটারি ল্যাট্রিন নেই, সবই গর্ত করে প্লাস্টিকের বস্তা কেটে বানানো হয়েছে। ফলে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।

সেনা মোতায়েনে এসেছে শৃঙ্খলা বেশি মানুষ ত্রাণ পাচ্ছেন : আশ্রয়শিবিরগুলোতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করায় অনেকটা শৃঙ্খলা এসেছে। আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ ত্রাণ পাচ্ছেন। আগে যেমন ত্রাণদাতারা সুবিধা মতো এলাকায় গিয়ে ত্রাণ দিয়ে চলে আসতেন। ফলে কেউ পেতেন আবার কেউ পেতেন না। এখন সে রকম হচ্ছে না। ত্রাণ নিয়ে কেউ এলে আগে তাদের সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করতে হয়। সেনাবাহিনী তাদের জায়গা ঠিক করে দেয় কোথায় ত্রাণ দিতে হবে। ফলে প্রায় সবাই সমানভাবে ত্রাণ পাচ্ছেন। গতকাল ব্যক্তি উদ্যোগ ছাড়াও আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা এবং বিদেশী দূতাবাসের পক্ষ থেকে এভাবেই ত্রাণ দেয়া হয়েছে। আগে থেকেই ত্রাণশিবিরে গিয়ে টোকেন দিয়ে আসা হয়। পর দিন সে টোকেন দেখিয়ে ত্রাণ নিতে হয়।
সেনাবাহিনী নামার পর প্রধান সড়কে আগের মতো ভিড় নেই। কাউকে সড়কে বসে থাকতে দেয়া হচ্ছে না। সড়কের পাশের অস্থায়ী আশ্রয়শিবিরও তুলে দিয়ে এদের ভেতরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। পড়ে আছে তাদের জন্য বসানো টিউবওয়েল, স্যানিটারি ল্যাট্রিন ও অসংখ্য পুরনো কাপড়।

মিনিগছিতে রোহিঙ্গাদের গ্রামে সেনাতাণ্ডব : মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের বুচিডংয়ের মিনগিছিতে তাণ্ডব চালিয়েছে সেনাসদস্যরা। গতকাল মঙ্গলবার ও আগের দিন সোমবার রোহিঙ্গাদের যাকে যেখানে পেয়েছে সেখানে মারধর করেছে। দেশ ছেড়ে চলে না গেলে প্রাণে মেরে ফেলা হবে বলেও হুমকি দিয়েছে। সেনাবাহিনী আটক রোহিঙ্গাদের প্রহার করছে। এক রোহিঙ্গা কিশোরের পুরুষাঙ্গ কেটে দিয়েছে। এর আগে শুক্রবার গ্রামটিতে অগ্নিসংযোগ করলে অসংখ্য বাড়িঘর পুড়ে যায়।
এ দিকে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় মিথ্যা জবানবন্দী দিতে বাধ্য হওয়া কতুব পীরকে গৃহবন্দী করে রেখেছে সৈন্যরা। তাকে সেনা পাহারায় রাখা হয়েছে। কোনো রোহিঙ্গাকে পীরের বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছে না এবং কতুবপীরকেও বাইরে যেতে দেয়া হচ্ছে না। এমনকি তাকে স্ত্রী-সন্তানের সাথে দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছে সূত্র।

অন্য দিকে শুক্রবার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা কমে এলেও, সোমবার থেকে আবারো বৃদ্ধি পেয়েছে। সেনাবাহিনী নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়ায় বুচিডং থেকে দলে দলে রোহিঙ্গা আশ্রয়ের আশায় বাংলাদেশে আসছেন।
 একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে সীমান্তে স্থল মাইন পুঁতে রাখার পাশাপাশি এবার কাঁটাতারে বিদ্যুৎ সংযোগ করেছে বর্মি বাহিনী। এতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন দুই রোহিঙ্গা। নিহতদের লাশ ঘুমধুম সীমান্তের কাঁটাতারে এখনো জড়িয়ে আছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। এ ছাড়া বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে গতকাল সন্ধ্যায় স্থলমাইন বিস্ফোরণে এক রোহিঙ্গা যুবক নিহত হয়েছেন। তার নাম নূরে আলম (২৫)। তিনি আরাকানের বালবাজারের পুরান মাইজ্জা এলাকার মোহাচ্ছের আলীর ছেলে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/255150