২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৭:০৪

হোল্ডিং ট্যাক্স আতঙ্কে বাড়ির মালিকরা

রাজধানীর উত্তর বাসাবোর ৩৪/৭ নম্বর বাড়ির মালিক আজমল আলীর বার্ষিক হোল্ডিং ট্যাক্স ছিল ১৮ হাজার টাকা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) চলতি বছর পুনর্মূল্যায়নের পর তা নির্ধারণ করেছে ৬০ হাজার ৭২০ টাকা। সম্প্রতি ডিএসসিসি থেকে এ সংক্রান্ত চিঠি তার বাসায় এলে তিনি হতভম্ব হয়ে পড়েন। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যান খিলগাঁওয়ে ডিএসসিসির ২ নম্বর আঞ্চলিক কার্যালয়ে। কিন্তু কর্মকর্তারা নির্ধারিত ট্যাক্সে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেননি।

আজমল আলী সমকালকে জানান, ২০১০ সাল থেকে তার বাসার বার্ষিক ট্যাক্স ধরা হচ্ছে ১৮ হাজার টাকা। এক দফায় তা বাড়িয়ে সাড়ে ৪২ হাজার টাকা করা হয়েছে। তিনি জানান, এবার ট্যাক্স নির্ধারণের আগে তার বাড়িতে করপোরেশনে কর্মরত কয়েক ব্যক্তি গিয়েছিলেন। এর কিছুদিন পরই ওই চিঠি আসে। একবারেই এত ট্যাক্স বাড়িয়ে জুলুম করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

শুধু আজমল আলীই নন, রাজধানীর উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রায় সব এলাকার বাসিন্দাদের ক্ষেত্রেই ঘটছে এমন ঘটনা। তারা এখন হোল্ডিং ট্যাক্স আতঙ্কে ভুগছেন। অনেকে ট্যাক্স কমানোর জন্য সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে ছুটছেন। এই সুযোগে কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী সুবিধা নিয়ে হোল্ডিং হট্যাক্স কমিয়ে দিচ্ছেন। ওদিকে ভাড়াটেদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। তারা মনে করছেন, বাড়ির মালিকরা তাদের ভাড়া বাড়িয়ে এই 'ক্ষতি' পুষিয়ে নেবেন। এতে বাসা ভাড়া মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যাওয়ায় মধ্য ও নিল্ফম্ন আয়ের মানুষ পড়বে মহাবিড়ম্বনায়।

এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকন সমকালকে জানান, তিনি চান না নগরবাসীর ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ হোক। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সিটি করপোরেশনেরও হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানোর ক্ষমতা নেই। এ জন্য সরকারের সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। মেয়র বলেন, 'তবে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়নের একটি নিয়ম রয়েছে, যা এতদিন করা হয়নি। এতে দেখা যাচ্ছে, ২৫ বছর আগে কোনো কোনো বাসার ভাড়া ছিল পাঁচ হাজার টাকা; ওই বাসার ভাড়া বেড়েছে, যদিও হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়েনি। এখন এক্ষেত্রে সেই সমতা আনা হচ্ছে।'

পুনর্মূল্যায়ন বাণিজ্য : হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়নের জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন তৎপরতা শুরু করে বছরখানেক আগে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন অঞ্চল-২ ও অঞ্চল-৪ এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন অঞ্চল-১ ও অঞ্চল-৩ এলাকায় এই পুনর্মূল্যায়ন শুরু করে। ট্যাক্স নির্ধারণ নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক উৎকোচ বাণিজ্য। এরই মধ্যে ডিএসসিসির উপ-কর কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন জমাদ্দারকে উৎকোচের টাকাসহ হাতেনাতে আটক করে পুলিশ। এরপর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে ডিএসসিসি।

এদিকে হোল্ডিং ট্যাক্স পুনর্মূল্যায়নের বৈধতা নিয়ে একজন নাগরিক আদালতের আশ্রয় নেন। আদালতের নির্দেশে এ কার্যক্রম স্থগিত করে দুই সিটি করপোরেশন। সর্বশেষ গত ৭ আগস্ট আদালতের আরেক আদেশে সেই স্থগিতাদেশ উঠে যায়। ফলে নতুন করে দুই সিটি করপোরেশন পুরোদমে পুনর্মূল্যায়নের কার্যক্রম শুরু করেছে। ডিএনসিসির পুরো এলাকাতেই চলছে পুনর্মূল্যায়ন কার্যক্রম। ডিএসসিসি প্রথম ধাপে শুরু করা দুটি অঞ্চলের পুনর্মূল্যায়ন কাজ শেষ করেছে। অন্য তিনটি অঞ্চলের কাজও শুরু হওয়ার পথে। উভয় সিটি করপোরেশনই প্রতিটি হোল্ডিংয়ের মালিকের ঠিকানায় চিঠি পাঠিয়ে নতুন হোল্ডিং ট্যাক্সের পরিমাণ জানিয়ে দিচ্ছে। ফলে উৎকোচ বাণিজ্য আবারও শুরু হয়েছে ব্যাপকভাবে।

কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি নন : এদিকে উৎকোচ বাণিজ্যের শিকার ভুক্তভোগীরা নাম জানিয়ে কিছু বলতে চাইছেন না। তারা মনে করছেন, এতে করপোরেশনের কর্মকর্তারা নাখোশ হয়ে হোল্ডিং ট্যাক্স আরও বাড়াতে পারেন।

শান্তিনগরের এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, আগে আমার হোল্ডিং ট্যাক্স ছিল ১০ হাজার টাকা। পুনর্মূল্যায়নের পর তা হয়েছে ৯৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ বাসার হোল্ডিং ট্যাক্স প্রায় ১০ গুণ বেড়েছে। তিনি বলেন- গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ছে। চাল ডাল মাছ মাংস সবকিছুরই দাম বাড়ছে। কিন্তু আয় বাড়ছে না। এভাবে হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানো হলে ঢাকা শহরে বসবাসের উপায় থাকবে না।

কর্মকর্তাদের অভিমত : এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির অঞ্চল-২-এর কর কর্মকর্তা দেওয়ান আলীম আল রাজী বলেন, হোল্ডিং ট্যাক্স বাড়ানোর চিঠি ইস্যু হওয়ার পর অনেকেই অফিসে আসছেন। তারা বেশি ট্যাক্স ধরার অভিযোগ করছেন। এ নিয়ে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাড়ির মালিকদের তর্ক-বিতর্কও হচ্ছে। তিনি বলেন, হোল্ডিং ট্যাক্স পর্যালোচনার জন্য কেউ আবেদন করলে কপোরেশন ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ট্যাক্স মওকুফ করতে পারে। এ ছাড়া করপোরেশনের কিছু করার নেই।

ডিএসসিসির উপ-প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা সাইদুর রহমান বলেন, অনেক বাড়ি বা ফ্ল্যাটের হোল্ডিং ট্যাক্স দীর্ঘদিন পুনর্মূল্যায়ন করা হয়নি। তাই তাদের ট্যাক্স একবারে হঠাৎ করে বেশি বেড়ে যেতে পারে। তবে তারা আবেদন করলে ট্যাক্সের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার একটি সুযোগ আছে বা কিস্তিতে পরিশোধেরও ব্যবস্থা আছে।

ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা রবীন্দ্রশ্রী বড়ূয়া বলেন, পুরনো বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিকরা এখনও পুরনো হিসেবেই ট্যাক্স দিয়ে আসছেন। অথচ যখন নতুন একটি ভবন বা ফ্ল্যাটের ট্যাক্স নির্ধারণ করা হচ্ছে, তখন পাশাপাশি একই আকৃতির ফ্ল্যাট বা বাড়ির হোল্ডিং ট্যাক্স অনেক বেশি হচ্ছে। এতে তারাও প্রশ্ন তুলছেন। এ ক্ষেত্রে অভিম্নতা আনতে যাওয়ায় অনেকে মনে করছেন পুরনোদের ট্যাক্স এক ধাপে অনেক বেড়ে যাচ্ছে। বাস্তবতা হলো- এতদিন তারা কম দিয়েছেন।

সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা জানান, কোনো বাড়ি বা ফ্ল্যাটের বার্ষিক ভাড়ার ১০ শতাংশ অর্থ হোল্ডিং ট্যাক্স বাবদ নির্ধারণ করে সিটি করপোরেশন। তবে ওই বাড়ি বা ফ্ল্যাট মালিক নিজে ব্যবহার করলে ওই ১০ শতাংশের ৪০ শতাংশ রিবেট পান তিনি। উদাহরণ হিসেবে কোনো ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া ১০ হাজার টাকা হলে বার্ষিক ভাড়া হয় এক লাখ বিশ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে ওই ফ্ল্যাটের বার্ষিক হোল্ডিং ট্যাক্স হবে ১২ হাজার টাকা। মালিক নিজে ব্যবহার করলে হবে সাত হাজার দুইশ' টাকা।

http://www.samakal.com/capital/article/17091538