২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, সোমবার, ৬:৫৬

হাকালুকি হাওরে টোকেন বাণিজ্য!

দেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকি। এ হাওরের বিশাল মৎস্যভাণ্ডার প্রতিনিয়ত সংকুচিত হয়ে আসছে। থামছে না অবাধে মাছ শিকার। প্রভাবশালী ও প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্তাদের ম্যানেজ করে টোকেনের মাধ্যমে মৎস্য নিধন করে রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে কিছু ব্যবসায়ী। যার কাছে টোকেন থাকবে, সে নির্ভয়ে হাওরে অবাধে মাছ ধরতে পারবে। এসবের নেপথ্যে রয়েছে প্রভাবশালী একটি চক্র। ফলে হাকালুকির বিস্তীর্ণ জলাভূমিতে মাছের বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিদিন চলছে মাছ আহরণের অবৈধ টোকেন খেলা। জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া-জুড়ী-বড়লেখা ও সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ এই ৫টি উপজেলায় ২৩৮টি বিল নিয়ে বৃহত্তম হাকালুকি হাওর। সংশ্লিষ্ট উপজেলাগুলোর বাসিন্দারা প্রশাসনের সহায়তা পেয়ে বাণিজ্যের এ সিন্ডিকেট তৈরি করে নির্বিঘ্নে মাছ আহরণ করছে। আর এই অবৈধ বাণিজ্যের ভাগ-ভাটোয়ারা যায় স্থানীয় প্রভাবশালীসহ প্রশাসনের কিছু বড় কর্তাদের পকেটে।

স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, হাকালুকি হাওর তীরবর্তী এলাকা কুলাউড়ার শাদিপুর, জুড়ী উপজেলার বেলাগাঁও, জাঙ্গিরাই, নয়াগ্রাম, বড়লেখার দক্ষিণভাগের খাগটেখার কয়েকশ’ মানুষ হাওরে মাছ শিকারে নিয়োজিত রয়েছে। অনুরূপভাবে অন্য দুটি উপজেলার মৎস্য শিকারিও তৎপর রয়েছে হাকালুকিতে। এসব শিকারিরা দিন-রাতের বেশির ভাগ সময়ই হাওরে তাণ্ডব চালাচ্ছে। ফলে শুধু মাছই নির্বংশ হচ্ছে না ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে হাকালুকির জলজ উদ্ধিদের অস্তিত্ব। হোগা (চাপিলা), ইছা, কাঁচকি ও তিতপুঁটি শিকারের নামে এসব মৎস্য শিকারি ও সিন্ডিকেট সদস্যরা শিকার করে নিচ্ছে সব ধরনের মাছ। প্রতিদিন প্রায় তিন শতাধিক বেড়জাল নিয়ে এসব শিকারি ঝাঁপিয়ে পড়ে হাকালুকিতে। শিকারিরা বিত্তবান শ্রেণির না হলেও জালের মালিকরা সবাই বিত্তবান। সরজমিন জানা যায়, এসব অবৈধজালের মালিকরা এতই বিত্তবান যে বিলগুলো ইজারা নেয়ার সময় তারাই নেন। জালের মালিকরাই মূলত সৃষ্টি করেছে টোকেন সিস্টেম। টোকেন ছাড়া জাল দিয়ে মাছ ধরে ডাঙ্গায় উঠলেই মাছসহ ধরা পড়ে যেতে হয় উপজেলা মৎস্য অফিসে। চলতি বছর ১৭ই জুন এমন দুজন শিকারি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জুড়ী উপজেলা মৎস্য অফিসে গিয়ে মুছলেকায় ছাড়া পায়। শিকারিরা জানান, প্রতিটি জালের সঙ্গে ২০-৩০ জন করে শিকারি থাকে। ২ হাজার হাত জালে থাকে ৫০ থেকে ৬০ জন। শিকারিদের এসব জাল চার শ’, পাঁচ শ’, বার শ’ ও দুই হাজার হাত লম্বা হয়ে থাকে। শিকারিদের সবচেয়ে তিকারক জাল হচ্ছে তিতপুঁিট মারার কৌশলি জাল। একে বিষ জালও বলা হয়ে থাকে। এই জাল দিয়ে শিকারিরা ছোট ছোট মাছের পোনা ধরে, গলফা জাল দিয়ে শিকার করা হয় বড় বড় মাছ। তাছাড়া সব শ্রেণির মাছ শিকারে রয়েছে বেড়জাল। শিকারিদের সঙ্গে জালের মালিকদের চুক্তি হলো সব খরচ বাদে জাল মালিকের ১ ভাগ আর শিকারিদের ২ ভাগ। তাতে করেই শিকারিদের জন প্রতি আট’শ থেকে এক হাজার টাকা দৈনিক আয় হয়ে থাকে। শিকারিদের কাছ থেকে অঞ্চলভিত্তিক হাওর রক্ষা কমিটির নামে চাঁদাও নেয়া হয়। তবে হাওর তীরবর্তী বাসিন্দাদের ভাগ্যে এসব মাছ খুব কমই জুটে। ভোরের আলো ফোটার আগেই সব মাছ চলে যায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। এসব মাছ নির্বিঘ্নে যাতায়াতে সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। কারণ, প্রকাশ্য এসব ব্যবসা হলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন তাতে নজর দেয় না। এদিকে হাকালুকিতে মাছ না ধরলে সরকারিভাবে প্রতি মাসে ভাতা দেয়া হবে-এমন কথা বলে শিকারিদের আইডি কার্ড জমা নেয়া হয়। এখন সরকারি ভাতাও আসছে না শিকারিদের শিকারও থামছে না। সম্প্রতি হাওরে অবৈধভাবে মাছ শিকারের দায়ে জুড়ী উপজেলায় প্রায় ৫ শ’ কেজি পোনা মাছ আটক করা হয়। হাওরে মাছ শিকারি তাহের আলী (৫০) ও আলমগীর (৪৫) এর কাছে বেআইনি মাছ শিকার সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা জানান, বেআইনি জেনেও শিকার করতে হচ্ছে। তাছাড়া জীবিকা নির্বাহের কোনো পথ নেই। তাহের আলী আরও জানান, আটজন সদস্যের পরিবারে তিনিই একমাত্র রোজগারি। তিনি একটি মামলায় ৩ মাস জেল খেটেছেন। কুলাউড়া উপজেলার সিনিয়র মৎস্য অফিসার মো. সুলতান মাহমুদ জানান, প্রতি মাসেই কয়েকবার হাওরে অভিযান পরিচালনা করি। সর্বশেষ ১৪ই সেপ্টেম্বর বিশেষ অভিযান চালিয়ে বিপুলসংখ্যক অবৈধ কারেন্টজাল জব্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি হাওর রক্ষার স্বার্থে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে শিকারিদের প্রতিরোধের চেষ্টা চলছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=84546