২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, রবিবার, ৮:৩০

এবার আকিয়াবে সেনা অভিযান

বাংলাদেশের পথে হাজারো রোহিঙ্গা; বুচিডংয়ের উত্তর-পূর্বে রোহিঙ্গা গ্রামে অগ্নিসংযোগ-লুটপাট

আরাকান রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানদের অস্তিত্ব মুছে দিতে এবার সেখানের বন্দরনগরী আকিয়াবে (বর্তমান নাম সিটওয়ে) পরিকল্পিতভাবে স্থলমাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে রোহিঙ্গাদের দায়ী করছে মিয়ানমারের সেনারা। গত বুধবার আকিয়াব জেলার মাম্ব্রা ইউনিয়নের হত্তিপাড়ায় একটি নির্জন জায়গায় তিনটি বিস্ফোরণ ঘটে। এতে হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এরপরও এ ঘটনাকে পুজি করে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে সেনাবাহিনী। আরকান রাজ্যের তিন জেলাÑ মংডু, বুচিডং ও রাচিডং শহরে জ্বালাও-পোড়াও, হত্যা, গুম ও বিতাড়নের কাজ শেষপর্যায়ে এনে এখন আকিয়াবে একই কায়দায় তাণ্ডব শুরু হয়েছে। জীবন বাঁচাতে আকিয়াবের মুসলমানরাও সাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন। উল্লেখ্য, আকিয়াবে রোহিঙ্গাদের আধিক্য রয়েছে।

সেনাবাহিনীর এই অভিযানে ইন্ধন দিচ্ছে স্থানীয় রাখাইনদের সংগঠন নাডালা বাহিনী। সীমান্তের স্থলবন্দর ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের সেনারা আরাকানের রোহিঙ্গাদের চলাচলের রাস্তায় যত্রতত্র স্থলমাইন পুঁতে রেখেছে। এ রকম কিছু মাইন আকিয়াবের হত্তিপাড়ায় বিস্ফোরিত হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ ও তল্লাশি চালানো হচ্ছে। গতকাল শনিবার ও আগের দিন শুক্রবার সকালে পাথরকিল্লায়ও রোহিঙ্গাদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশির নামে নারকীয় তাণ্ডব চালানো হয়। সূত্র আরো জানিয়েছে, সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের দায়ী করলেও স্থানীয় পুলিশ প্রধান বিষয়টি নাকচ করে দেন। তিনি সেনা কর্তৃপক্ষকে জানান, স্থানীয় মুসলমানরা খুবই শান্তিপ্রিয়। আরাকানের কোনো থানায় তেমন কোনো মামলাও নেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে। বিস্ফোরণের সাথে তারা জড়িত নন। তারপরও সেনাবাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গাদের হয়রানি করে চলছে।
স্থলবন্দরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আকিয়াবের পাথরকিল্লা তথা ম্রাউক নগরীর আশপাশের রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে গত শুক্রবার সকাল থেকে সেনারা অভিযান শুরু করেছে। সেখানের মসজিদ-মক্তব ও রোহিঙ্গাদের বসতিতে অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। সেখানকার নাজিরপাড়া ও চ্যাক্কিপাড়ার বাড়িঘরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলেছে। জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আসার জন্য আকিয়াব অঞ্চলের রোহিঙ্গাদের সাগরপথই একমাত্র ভরসা। হাজার হাজার রোহিঙ্গা সাগর পাড়ি দেয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। আতঙ্কে পুরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীই বাংলাদেশে চলে আসার চিন্তায় রয়েছে।

উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের নিবন্ধিত রোহিঙ্গা জালাল জানান, মিয়ানমার সেনাবাহিনী এখন আকিয়াবের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে ওই অঞ্চলের হাজার হাজার লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে সাগরপথে বাংলাদেশে আসার জন্য রওয়ানা হয়েছেন।
শুক্রবার সাগরপথে এসে টেকনাফের শামলাপুরে ঠাঁই নেয়া মংডুর দক্ষিণের হাইচ্ছুরাতা এলাকার নুর কবির ও বড়ছড়া এলাকার আবু কালাম জানান, মংডুর উত্তরাঞ্চলের রোহিঙ্গা পল্লী পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়ার পর বাংলাদেশের স্থলসীমান্তে নতুন করে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ ও মাইন স্থাপন করছে মিয়ানমার সেনারা। সীমান্ত পার হতে গিয়ে মাইন বিস্ফোরণে বহু রোহিঙ্গা হতাহত হয়েছেন। এ কারণে রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগই এখন আসছেন সাগরপথে।

নাইক্ষ্যংছড়ির চেয়ারম্যান তসলিম ইকবাল বলেন, রোহিঙ্গারা যাতে নিজ দেশে ফিরতে না পারেন সে জন্য সীমান্তে নতুন করে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ ও মাইন স্থাপন করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। মিয়ানমার সীমান্তে দায়িত্বরত নাইক্ষ্যংছড়ি বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আনোয়ারুল আজিমও মনে করছেন, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা নিজ দেশে যাতে ফিরতে না পারেন সে জন্যই সে দেশের সেনাবাহিনী সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ ও মাইন বসাচ্ছে।
অস্ত্রের মুখে পীরের স্বীকারোক্তি আদায় : বুচিডংয়ের মিনিগিছির প্রখ্যাত আলেম ও বড়পীর মোজাফফর আহমদের ছেলে মাওলানা কুতুব উদ্দিন ওরফে ছোট পীরকে গত শুক্রবার অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সেনাবাহিনীর একটি দল। মিনিগিছি ও নারাইংশং রোহিঙ্গা পল্লীতে সৈন্যরা অগ্নিসংযোগের আগেই জিম্মি করে পীরকে। পীরের পুরো পরিবারকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে মিথ্যা জবানবন্দী দিতে বাধ্য করে সেনারা।

সূত্র জানিয়েছে, গত শুক্রবার পরিকল্পিতভাবে মিনিগিছি গ্রামে একটি স্থলমাইন বিস্ফোরণ ঘটায় সেনারা। গ্রামের সাধারণ রোহিঙ্গা ও রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরসাকে এ বিস্ফোরণের জন্য দায়ী করতেই কুতুব পীরকে জিম্মি করে বলে জানা গেছে। তাকে এক ঘণ্টা আটকে রাখার পর পীরকে একটি খোলা মাঠে নিয়ে বসায় সেনারা। পীরের সাথে আরো সাত-আটজন রোহিঙ্গা ছিলেন। এ সময় সৈন্যরা পীরকে ঘিরে রাখে। বাড়িতে পীরের পরিবারকেও জিম্মি করে। পরে ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন নিয়ে সাংবাদিকের ভূমিকায় এক সেনা সদস্য পীরের কাছে জানতে চায়, এখানে কারা বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে? প্রতিকূল পরিবেশ ও অনেক মানুষের জীবন বাঁচানোর তাগিদে সৈন্যদের শিখিয়ে দেয়া মিথ্যা কথা বলতে বাধ্য হন পীর। পরে তার স্বীকারোক্তি আদায় করে মিয়ানমারের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করে সেনারা।

স্থানীয় রোহিঙ্গাদের মতে, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের দমননীতি ও গণহত্যার মতো জঘন্য অপরাধ সঙ্ঘটিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক মহল চাপ প্রয়োগ করছে সু চির সরকার ও সেনাবাহিনীর ওপর। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী কেন অপারেশন চালাচ্ছে তা বিশ্বকে দেখাতে মিয়ানমার সরকার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে। পীরকে জিম্মি করে মিথ্যা বলতে বাধ্য করাও এমন একটি কৌশল হতে পারে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। এর আগে রোহিঙ্গারা নিজেদের বাড়িঘরে নিজেরা আগুন দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে এমন মিথ্যাচার করেছিল মিয়ানমারের প্রশাসন। এ মিথ্যাচারকে সত্য বানানোর চেষ্টাও কম করেনি প্রশাসন। কয়েকজন হিন্দুকে মাথায় টুপি ও মুখে ওড়না পেঁচিয়ে রোহিঙ্গা মুসলমান সাজিয়ে ঘরে আগুন দেয়ার ভিডিও ও ছবি নিয়েছিল। পরে বিবিসির একজন সাংবাদিক মংডুতে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে এ ছবি দেখান সেনা কর্মকর্তারা। পরে ছবির হিন্দু নারী ও পুরুষকে একটি আশ্রয়কেন্দ্রে চিহ্নিত করতে পারেন ওই সাংবাদিক। তিনি তাদের কাছে আগুন লাগানোর বিষয়টি জানতে চান। এ সময় তারা বলেন, আগুন দিতে বাধ্য করেছে সৈন্যরা।

শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গাদের দোষী সাব্যস্ত করে তাদের বিরুদ্ধে চালানো অভিযানকে আইনসঙ্গত প্রমাণ করতে নানা নাটক করে চলছে প্রশাসন। সেনাপ্রধান মিন অংহ্লাইং এক দিকে উদ্বাস্তুদের ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছেন, অন্য দিকে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন দিতে লেলিয়ে দিয়েছেন।
বুচিডংয়ে রোহিঙ্গা গ্রামে অগ্নিসংযোগ-লুটপাট : আরাকানের বুচিডং শহরতলির উত্তর-পূর্বে দু’টি রোহিঙ্গা গ্রামে গত শুক্রবার দুপুরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে সেনা সদস্যরা। রোহিঙ্গাদের সূত্র জানায়, তংবাজারের নিকটবর্তী গ্রাম নারাইংশং ও মিনিগিছিতে সকাল থেকে সেনা সদস্যরা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে তল্লাশির নামে লুটপাট চালায়। এ সময় তারা স্বর্ণালঙ্কার, টাকা, দামি আসবাবপত্র, মোবাইল সেট, সৌর প্যানেল ও গবাদিপশু লুট করে। বেলা দেড়টার দিকে পেট্রল ঢেলে মশাল জ্বালিয়ে রোহিঙ্গাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। ধাওয়া করে গ্রামের রোহিঙ্গাদের। জীবন বাঁচাতে রোহিঙ্গারা দিগি¦দিক ছুটে পালান। নদী পাড়ের ঝোপঝাড়ে ও পাহাড়ে আশ্রয় নেন অনেকে। গবাদিপশু লুট করে নিয়ে যাওয়ার সময় একটি গরু সামনে অগ্রসর না হলে কুড়াল দিয়ে সেটির পিঠে আঘাত করে ফেলে চলে যায়। এ ঘটনার পর আশপাশের গ্রামের অনেক রোহিঙ্গা পালিয়ে যাচ্ছেন। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বাংলাদেশের দিকে ছুটছেন তারা। আতঙ্ক, উৎকণ্ঠা ও শঙ্কা বিরাজ করছে সব রোহিঙ্গা বসতিতে।
সেনাপ্রধানের ঝটিকা সফর : ২০ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিং অংহ্লাইং ঝটিকা সফরে আরাকানে আসেন। সেখানে তিনি বেশ কিছু রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে কী বলেছেন তা জানা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে আরাকানে চলমান অবস্থা নিয়ে মুখ না খোলার জন্য রোহিঙ্গাদের চাপ প্রয়োগ করেছেন। সেনাপ্রধান মিন অংহ্লাং আরাকান ছেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে মংডুর ফ’খালীর পুতিপাড়া ও তুম্ব্রসহ পাঁচটি গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে সৈন্য ও নাডালা বাহিনী।

উল্লেখ্য, গত ২৪ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাবিরোধী সামরিক অভিযান শুরুর পর ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের যে ঢল নেমেছে তা থামছেই না। তবে স্থলপথ ও নাফ নদের তুলনায় সমুদ্রপথেই এখন বেশি আসছেন রোহিঙ্গারা। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মতে, এখনো রোহিঙ্গাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে চার শ’র বেশি গ্রামের হাজার হাজার বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ঘরছাড়া হয়েছেন পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। এর মধ্যে গত ২৪ আগস্ট থেকে গত এক মাসে অন্তত সাড়ে চার লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে। এখনো প্রতিদিনই প্রায় আট হাজার মানুষ নদী ও সাগরপথে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছেন বলে ইউএনএইচসিআরসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পর্যবেক্ষকদের অভিমত।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/254358