মগসেনাদের রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়ে নিশ্চিহ্ন করার এ্যামনেস্টি প্রকাশিত
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৯:১৩

রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করছে মগ সেনারা

মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রাম পুড়িয়ে দেয়ার ছবি প্রকাশ করেছে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিগুলো প্রকাশ করে এ্যামনেস্টির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে বিতাড়ণের চেষ্টা করছে’ এই ছবিগুলোই তার প্রমাণ। গত তিন সপ্তাহ ধরে সেখানে ‘খুবই পরিকল্পিতভাবে একটি নির্দিষ্ট ছকে গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার’ ছবি এখানে উঠে এসেছে।

এ্যামনেস্টির ক্রাইসিস রেসপন্স ডিরেক্টর তিরানা হাসান বলেন, “মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে দেশ থেকে বিতাড়নের লক্ষ্য নিয়েই যে গ্রামগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে- এগুলো তার অকাট্য প্রমাণ। এটা জাতিগত নির্মূল অভিযান, এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।”
পশ্চিমের রাখাইন রাজ্যের প্রায় ৩০ শতাংশ রোহিঙ্গা গ্রাম এখন সম্পূর্ণ খালি, খোদ মিয়ানমার সরকার এ তথ্য দিয়েছে বলে জানায় বিবিসি। রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে হামলার বর্ণনায় এ্যামনেস্টির পক্ষ থেকে বলা হয়, মিয়ামারের সেনাবাহিনী এক একটি গ্রাম প্রথমে ঘিরে ফেলছে, পলায়নরত গ্রামবাসীর উপর নির্বিচারে গুলী ছুঁড়ছে এবং তাদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। এটা নিশ্চিতভাবেই ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’।
স্যাটেলাইটের ছবিতে ২৫ অগাস্টের পর লোকবসতি আছে এমন অন্তত ৮০টি জায়গায় বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড সনাক্ত হয়েছে বলে জানায় অ্যামনেস্টি।

গত ২৪ অগাস্ট রাতে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) রাখাইন রাজ্যে একসঙ্গে ৩০টি পুলিশ পোস্ট ও একটি সেনা ক্যাম্পে হামলা চালায়। হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ বেশ কয়েকজন নিহত হওয়ার পর থেকে রাখাইনে সেনা অভিযান চলছে।
সেনাবাহিনী কীভাবে গ্রামে ঢুকে নির্বিচারে গুলী চালিয়ে মানুষ মারছে, ঘরের ভেতরে আটকে রেখে কীভাবে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, লুটপাট চালিয়ে কীভাবে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেই বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কথায়। যদিও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দাবি তারা রাখাইনে জঙ্গি দমন অভিযান চালাচ্ছে এবং বেসামরিক নাগরিক তাদের লক্ষ্য নয়।
দীর্ঘদিন ধরেই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ‘অবৈধ অভিবাসী’ বর্ণনা করে তাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসেছে।
সেনা অভিযান শুরু পর প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন মিয়ানমারের কড়া সমালোচনা করেছে।
বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন বলেন, “আমি মনে করি, এই জনগোষ্ঠীর পাশে এখন বিশ্ববাসীকে দাঁড়াতে হবে। একটি জাতিগোষ্ঠী হিসেবে তাদের সঙ্গে কী আচরণ করা উচিৎ, সেই কথা বলতে হবে। এই সহিংসতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে, এই নির্মমতা বন্ধ করতেই হবে।”

রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না করলে মিয়ানমারের উপর অবরোধ আরোপের হুমকি দিয়েছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। রাখাইনে সেনা অভিযান স্থগিত এবং রোহিঙ্গাদের উপর সহিংসতা বন্ধের জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। বুধবার নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে গুতেরেস বলেন, রোহিঙ্গা সংকটে মানবিক পরিস্থিতি বিপর্যয়কর অবস্থায় পৌঁছেছে।
দেশান্তরী রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তা দিতে তিনি সব দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদও মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর অভিযান নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। এদিকে, রোহিঙ্গা চরমপন্থিরা রাখাইনে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকদের বাড়িঘরও পুড়িয়ে দিচ্ছে বলে খবর পেয়েছে অ্যামনেস্টি। কিন্তু এ খবরের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের ধন্যবাদ
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় এবং নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়ায় বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাস্তুচ্যুত মানুষদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে ৬৩ মিলিয়ন ডলার সহযোগিতা করেছে। বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হিদার নোয়ার্ট নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এই তথ্য জানিয়েছেন। নোয়ার্ট বলেন, ‘এতো বেশি রোহিঙ্গাদের গ্রহণ ও নিরাপদে থাকার স্থান দেওয়ায় বাংলাদেশ সরকারকে আমরা ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও বাইরে থেকে আসা বাস্তুচ্যুত মানুষদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ৬৩ মিলিয়ন ডলার সহযোগিতা দিয়েছে।’ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি জানি, এই ইস্যুতে (রোহিঙ্গা) সহায়তা বাবদ বাংলাদেশ কিছু অর্থ পেয়েছে।’ এএফপি।
এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ‘সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি, সংবাদের মাধ্যমে আপনারা যে পরিস্থিতির কথা জানছেন তা স্বত্ত্বেও এখনও এ নিয়ে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায়নি। আমরা আমাদের লোকেদের কাছ থেকে তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করছি।’ নোয়ার্ট জানান, ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি প্যাট্রিক মার্ফি আগামী সপ্তাহে বার্মা (মিয়ানমার) যাবেন। তিনি (মার্ফি) আরও মানবিক সহযোগিতা, সাংবাদিকদের প্রবেশের বিষয়ে চাপ দেবেন এবং রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করবেন। বুধবার মার্ফি যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জানিয়ে নোয়ার্ট বলেন, ‘রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসেছিলেন এবং তিনি আলোচনায় পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন। অবশ্যই কঠিন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনাটিও কঠিন ছিল।’

নিউ ইয়র্কে সদর দফতরে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টেফানি দুজারিক জানান, ২৫ আগস্ট থেকে শুরু থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৩ লাখ ৮৯ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত পার হয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশ এসেছে। তিনি বলেন, শুধু গত ২৪ ঘণ্টায় ১০ হাজার মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। গত বছরের অক্টোবরের সহিংসতায় পালানো মানুষদের মিলিয়ে হিসেব করলে রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের প্রায় ৪০ শতাংশ বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। দুজারিক জানান, কক্সবাজারে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের কয়েকটি ট্রাক রয়েছে। যেগুলোতে রোহিঙ্গাদের শিশুদের জন্য জরুরি পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম রয়েছে। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ৬০ শতাংশই শিশু। জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র দুজারিক বলেন, আগের শিবিরগুলো এমনিতেই শরণার্থীদের সংখ্যার আধিক্য ছিল। নতুন শরণার্থীরা যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে সেখানেই থাকছে।
ইউনিসেফের মতে, রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় সবকিছুরই ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে আশ্রয়, খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট আছে। সংস্থাটি পানির সরবরাহ নিশ্চিত করছে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে। দুজারিক আরও বলেন, আগামী চার মাসে জরুরি সেবার জন্য ৭০ লাখ ডলার সহযোগিতার জন্য ইউনিসেফ আহ্বান জানিয়ছে।
একদিন আগে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, সেখানে একটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, তিনি (মহাসচিব) যেমন বলেছেন সামরিক ও নিরাপত্তা অভিযান থামাতে হবে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে শরণার্থী পুরুষ, নারী ও শিশুদের সহযোগিতা এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, শরণার্থীদের মধ্যে শিশুদের হার উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বেশি। এসব মানুষের এখনই সহযোগিতা প্রয়োজন।

http://www.dailysangram.com/post/299896