১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:৩৯

দিশেহারা কৃষক

চারা-বীজের জন্য হাহাকার


অধিকাংশ এলাকায় শুরু হয়নি কৃষি ত্রাণ বিতরণ : তিন গুণের বেশি দামে চারা কিনছেন কৃষক : পলির সদ্ব্যবহার করে বাম্পার ফলনের প্রত্যাশা ফিকে
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সমস্যার যেন শেষ নেই। দুই দফা বন্যায় খাদ্য উদ্বৃত্ত উত্তরের জেলাগুলোতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় আর্থিকভাবে প্রায় নিঃস্ব কৃষকরা। বন্যা যাওয়ার পর নতুন করে জমিতে রোপনের জন্য আমন চারার তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অল্পস্বল্প যে চারা পাওয়া যাচ্ছে, তার দাম স্বাভাবিকের চেয়ে তিন-চার গুণ বেশি। অনেক কৃষক সরকারি সহযোগিতা ছাড়াই এখন ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম করছেন। তবে অধিকাংশ কৃষকের পক্ষেই অতিরিক্ত দামে নতুন করে চারা কিনে আবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই কি করবেন ভেবে পচ্ছেন না। চারা-বীজের জন্য কৃষকদের মধ্যে একধরনের হাহাকার বিরাজ করছে। এদিকে সরকারিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কৃষি ত্রাণ হিসেবে আমনের চারা, দানাদার শস্যের বীজ ও সার বিতরণের কথা ঘোষণা করা হলেও মাঠপর্যায়ে কৃষকদের হাতে এখনো সেই সাহায্য পৌঁছায়নি। অথচ কৃষক এখনো সার-বীজসহ প্রণোদনা পেলে বন্যা শেষ হওয়ার পর জমিতে পরা পলির স্তরের সদ্ব্যবহার করে শীতকালীন সবজি, রবি শস্য ও আমনে বাম্পার ফলনের প্রত্যাশা করছেন। কৃষকের এ প্রত্যাশা দিনে দিনে ফিকে হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২০ আগস্ট দিনাজপুরে বন্যাদূর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ অনুষ্ঠানে বানভাসী মানুষদের বলেছেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সার্বিক সহায়তা দেওয়া হবে। নতুন ফসল না ওঠা পর্যন্ত সরকারের সাহায্য অব্যাহত থাকবে। এদিকে গত রোববার কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, সা¤প্রতিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতে ৫ লাখ ৪১ হাজার ২০১ জন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে ৫৮ কোটি ৭৭ লাখ ১৯ হাজার ৩১৫ টাকার প্রণোদনা হিসেবে বীজ ও সার দেওয়া হবে। মতিয়া চৌধুরী বলেন, বন্যায় দেশের ৩১ উপজেলায় ৬ লাখ ২৩ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব কৃষকদের পুনর্বাসন করতে সরকার ১১৭ কোটি টাকার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এবারের বন্যায় ২ লাখ ৪৯ হাজার ৮০০ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এজন্য আগামী বোরো মৌসুমে প্রতি বিঘা জমির জন্য পাঁচ কেজি করে বীজ দেবে সরকার। এছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কৃষিঋণ আদায় বন্ধ এবং সুদ মওকুফ করা হয়েছে। কৃষিমন্ত্রী বলেন, গম, ভুট্টা, সরিষা, ফেলন, খেসারি, গ্রীষ্মকালীন মুগ, গ্রীষ্মকালীন তিল, মাসকালাই, চিনাবাদাম ও বিটি বেগুনের বীজ এবং ডিএপি ও এমওপি সার দেওয়া হবে। প্রত্যেক কৃষককে এক বিঘা জমির জন্য এসব বীজ ও সার দেওয়া হবে। যদিও সরকারের এ হিসাবের চেয়ে বাস্তবে অনেক ফারাক। এছাড়া কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী দেশের ৬৪ জেলার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদেরও প্রণোদনা দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন।

সূত্র মতে, এবারের বন্যায় উত্তরের জেলাগুলোতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ধানই বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর প্রধান ফসল। বন্যার সময় রোপা আমনের মৌসুম চলছিল। পানিতে বেশির ভাগ জমির ধানের চারা নষ্ট হয়েছে। বন্যার অল্প কিছুদিন আগে এসব চারা লাগানো হয়েছিল। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলার বানে ডোবা খেতগুলোতে চারা পঁচে কালো হয়ে আছে। কৃষকেরা জানিয়েছেন, যাঁরা জমিতে এক দফা সার দিয়েছিলেন, তাঁদের পুরো জমির চারাই পঁচে গেছে। যাঁরা সার দেননি এবং যেসব জমির পানি দ্রæত নেমে গেছে, সেখানে কিছু চারা রক্ষা পেয়েছে। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত ৪০ জেলায় ৬ লাখ ৫২ হাজার ৬৫৪ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর এবার প্রতি হেক্টর জমি সাড়ে তিন টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। সেই হিসাবে তলিয়ে যাওয়া জমিতে অনাবাদি পড়ে থাকলে আমন মৌসুমে ২৩ লাখ টন চাল উৎপাদন কম হবে।
খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা কুড়িগ্রাম। এ বছর এ জেলায় বন্যার পানিতে তলিয়ে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে ৩৪ হাজার ৯ শত ২৭ হেক্টর জমির রোপা আমন ক্ষেত। আর বীজতলা নষ্ট হয়েছে ৫০০ হেক্টর। বন্যার পানিতে ১ সপ্তাহের বেশী তলিয়ে থাকায় পচে গলে গেছে কচি চারাগুলো। এ সময় যেখানে সবুজে ভরে থাকার কথা ছিল রোপা আমনের জমিগুলো, সেখানে এখন হলুদ বিবর্ণ হয়ে গেছে মাঠের পর মাঠ। ঊচু জমিতে থাকা কিছু চারা পাওয়া গেলেও দাম আকাশ ছোঁয়া হওয়ায় কৃষকরা চারা সংগ্রহ করে নতুন করে জমিতে লাগাবেন তাও সম্ভব হচ্ছেনা বলে জানালেন কৃষক মশিউর রহমান।

সূত্র মতে, এ বছর বন্যার পূর্বেই কুড়িগ্রাম কৃষিবিভাগ ৮৮ হাজার ৪৩০ হেক্টর রোপা আমনের লক্ষমাত্রা অর্জন করে। কিন্তু ১ মাসের ব্যবধানে দু দফা বন্যার কারণে রোপা আমনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। কৃষি বিভাগ রোপা আমনের ক্ষতি নিরুপন করে কৃষককে সাহায্য সহযোগিতার কথা বললেও অনেক কৃষক অভিযোগ করছেন তারা সরকারি কোন সাহায্য সহযোগিতা না পাওয়ায় নিজ উদ্যোগে মাঠে শুরু করেছেন আমন রোপনের কাজ। অনেকে তাকিয়ে আছেন সরকারি সহায়তার দিকে। কৃষক মশিউর রহমান বলেন, বন্যায় ধার দেনা করে লাগানো রোপা আমনের সাথে কৃষকের সব স্বপ্ন যেন ধুয়ে গেছে। বন্যার পানি নিঃস্ব করে দিয়েছে কৃষকদের। এখন তারা কি করবেন চিন্তা করে কোন কুল পাচ্ছেননা। অন্যদিকে চারা সংকট ও দাম আকাশ ছোঁয়া হওয়ায় চারা সংগ্রহ করে কৃষকরা নতুন করে জমিতে লাগাবেন তাও সম্ভব নয়। এ অবস্থায় চরম উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন তারা। কেউ কেউ ধার দেনা করে আবারও রোপন কাজ শুরু করছেন।

কুড়িগ্রাম সদরের ভোগডাঙ্গার চিকলির বিলের কৃষক হামিদ আলী আক্ষেপ করে জানান, ধার দেনা করে লাগানো ১১ একর জমির রোপা আমন সব নষ্ট হয়ে গেছে। সরকারিভাবে কোন রকম সাহায্য সহযোগিতা তারা পান নাই এখনও। কুড়িগ্রাম জেলা কৃষি স¤প্রসারণ কর্মকর্তা মো. মকবুল হোসেন বলেন, এ পর্যন্ত তারা মাত্র ৭০০জন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে রোপা আমনের চারাও ২০০ জনকে নাভিজাত চারা বিতরণ করেছেন। অথচ বন্যায় ১০ হাজার কৃষক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের পাশে তারাগঞ্জের বালাপাড়া গ্রামের আবদুল ছালেক বললেন, কয়েক দিন ধরে অনেক খুঁজে বেশি দামে অল্প কিছু চারা এনে রোপণ করেছি। তিনি বলেন, তারাগঞ্জ উপজেলায় বানে ডোবা খেত থেকে পানি নেমে গেছে। এরপরই কৃষকেরা নতুন চারা রোপণ করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। তবে অনেকেই নতুন করে রোপণের জন্য পর্যাপ্ত চারা পাচ্ছেন না। পাশ্ববর্তী মধুরামপুর গ্রামের কৃষক আফজাল হোসেন ও দুলাল হোসেন বলেন, এক বিঘা জমিতে রোপণের জন্য চারা কিনতেই তাঁদের প্রায় ৩ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা লাগছে। বন্যার আগে খরচ পড়ত ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা। কৃষকেরা জানান, এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে চাষাবাদের জন্য কোনো সাহায্য পাননি।
লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাটের চর শিবের কুটি গ্রামের কৃষক শাহ জামাল ও পূর্ব পাড়ের আবদুর রশিদ বলেন, তাঁরা সরকারি-বেসরকারি কোনো তরফ থেকেই কৃষি-সহায়তা পাননি।

শুধু কুড়িগ্রাম, রংপুর, দিনাজপুর ও লালমনিরহাটই নয়; এ যেন সারাদেশেরই চিত্র। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবীদ মো. গোলাম মারুফ ইনকিলাবকে বলেন, আপাতত বন্যায় বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষদ্র ও পান্তিক চাষীদের প্রণোদনা হিসেবে বীজ ও সার দেওয়া হবে। পরবর্তীতে দেশের ৬৪ জেলার ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদেরও প্রণোদনা দেয়া হবে। প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষক বন্যার পর জমিতে পরা পলির সদ্ব্যবহার করতে পারলে বাম্পার ফলন হবে বলে প্রত্যাশা করেন।
সরকার ঘোষিত প্রণোদনার হিসেব অনুযায়ী কৃষক ১১শ’টাকার কিছু বেশি পাবে। এই অর্থ সার-বীজের জন্য যথেষ্ট কিনা জানতে চাইলে মো. গোলাম মারুফ বলেন, এটা যথেষ্ট নয় ঠিক। তবে কৃষক এখন যা পাবে তাই তাদের জন্য ভালো বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি বলেন, অধিদপ্তর থেকে বীজ দেয়া হয়েছে। চাষীকে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পরামর্শ ও বিনাজামানতে সুদমুক্ত ঋণ দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনা হিসেবে সার ও চারা সরবরাহ করা হবে। মো. গোলাম মারুফ বরেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে কৃষি সেক্টরের ধারাবাহিক অগ্রগতি আসছে। কৃষি উন্নয়নের সব রকম আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে সর্বোচ্চ ফলন নিশ্চিতে কাজ করা হচ্ছে। এ বছরও ফসলের বাম্পার ফলন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

https://www.dailyinqilab.com/article/95387