৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:০৮

১০০০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী

মিয়ানমারের রাখাইনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সামরিক অভিযানের আদলে পরিচালিত অপারেশন ‘আনফিনিশড বিজনেস’ ইতিমধ্যে এক হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে। আর সরকার অনুমোদিত ওই তথাকথিত সন্ত্রাস দমন অভিযানে বেসামরিক নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যা এবং শয়ে শয়ে গ্রাম পুড়িয়ে দিতে হালকা মেশিনগান ও ভারি মর্টার শেলের মতো মারণাস্ত্র ব্যবহারেরও অভিযোগ উঠেছে। স্যাটেলাইট ইমেজেও ব্যাপকভিত্তিক অগ্নিসংযোগ এবং ধ্বংসলীলার প্রমাণ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। স্যাটেলইটে এরকম ২১টি এলাকা চিহ্নিত করা গেছে।

গতকাল দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে জাতিসংঘের একজন জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধির এক সাক্ষাৎকার এবং মার্কিন মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক বিবৃতিতে ওই তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। শুক্রবার ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে জাতিসংঘ কর্মকর্তার তথ্য সঠিক হলে নিহতদের সংখ্যা দাঁড়াবে বর্মী সরকারের দেয়া পরিসংখ্যানের দ্বিগুণ।
মিয়ানমারের মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল রেপটিয়ার ইয়াংগি লি বলেছেনে, সম্ভবত প্রায় একহাজার বা তার থেকে বেশি ইতিমধ্যেই নিহত হয়েছেন। তার কথায়, নিহতদের এই সংখ্যা হয়তো উভয় দিকের কিন্তু নিশ্চিতভাবেই এটা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সব থেকে বেশি।

উল্লেখ্য যে, শুধু গত দু’সপ্তাহে একলাখ ৬৪ হাজার ব্যক্তি, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক রোহিঙ্গা নাগরিক মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। আর সেখানে ইতিমধ্যেই তিল ধারণের ঠাঁই না থাকা উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে তারা আশ্রয় লাভের চেষ্টা করছেন। আর অন্য রোহিঙ্গাদের অনেকেই রাখাইনের চলমান সহিংসতা এড়াতে পালাতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। প্রত্যেক্ষদর্শীরা বলেছেন, গত ২৫শে আগস্টে রোহিঙ্গা জঙ্গিদের একটি সমন্বিত ধারাবাহিক আক্রমণের প্রেক্ষাপটে গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যর শিকার। দেশটি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করে চলছে। এবং দাবি করছে, তারা সবাই বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী। যদিও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে বসবাস করছেন।
মি. লি একজন দক্ষিণ কোরীয় শিক্ষাবিদ। সিউলে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিহতদের সংখ্যার বিষয়ে যে দাবি করেছেন তা সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়ে অনেক বেশি। সরকার দাবি করেছে, নিহতদের সংখ্যা মাত্র চারশ পঁচাত্তর। বৃহস্পতিবার বর্মী কর্তৃপক্ষের প্রকাশিত তথ্যে গত ২৫শে আগস্ট থেকে ছয় হাজার ছয়শটি রোহিঙ্গা বাড়ি এবং দুইশ একটি অমুসলিমদের গৃহ ভস্মীভূত হয়েছে। সরকারের ওই পরিসংখ্যান আরো বলেছে, ‘বিবাদমান পক্ষসমূহের মধ্যে লড়াইয়ের ফলে প্রায় ৩০ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছে। এরমধ্যে সাতজন রোহিঙ্গা, সাতজন হিন্দু, এবং ১৬ জন রাখাইন বৌদ্ধ।’
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ইতিপূর্বে বলেছে, তারা প্রায় ৪৩০ জন রোহিঙ্গা জঙ্গি হত্যা করেছে। বর্মী কর্তৃপক্ষসমূহের দাবি, আগস্ট আক্রমণের পর থেকে তারা এ পর্যন্ত ১৫ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য হারিয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে মি. লি এফপিকে জানিয়ে দিলেন, ‘এমন সম্ভাবনা খুব বেশি যে, তারা নিহতের সংখ্যা অনেক কমিয়ে প্রকাশ করছে। তিনি বলেছেন, এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, আমরা নিহতদের এই সংখ্যা যাচাই করার অবস্থানে নেই। কারণ সেখানে আমাদের কোনো প্রবেশাধিকার নেই।
কোরীয় বংশোদ্ভূত জাতিসংঘের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অনুশোচনার সঙ্গে আরো বলেছেন, ‘আমি মনে করি, এটি এমন একটি নিকৃষ্টতম বিপর্যয়ে পরিণত হচ্ছে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্ব এবং মিয়ানমার প্রত্যক্ষ করছে।’
এদিকে গতকাল নিউইয়র্কে দেয়া এক বিবৃতিতে মার্কিন মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী গত দু’সপ্তাহ ধরে যেটা করছে সেটা পরিষ্কারভাবে একটি বেপরোয়া এথনিক ক্লিনজিং বা জাতি নির্মূলকরণ অভিযান। গতকাল দেয়া বিবৃতিতে এই এথনিক ক্লিনজিং যা বর্মী সামরিক বাহিনীর ‘‘আনফিনিশড বিজনেস’’ বা অসমাপ্ত কর্ম এর অধীনে করা হচ্ছে বলেও চিহ্নিত করা হয়। এতে আরো বলা হয়, আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি আরসা রাখাইনের প্রায় ৩০টি পুলিশ ফাঁড়ি এবং একটি সামরিক ঘাঁটিতে গত ২৫শে আগস্ট হামলা চালানোর পর থেকে বর্মি সামরিক বাহিনী, পুলিশ এবং এথনিক রাখাইন সশস্ত্র গ্রুপগুলো রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে। বর্মী সেনা অধিনায়ক সিনিয়র জেনারেল মিন অং হেইন মিডিয়াকে বলেছেন, রাখাইনে বর্তমানে সরকার অনুমোদিত যে সামরিক শুদ্ধিকরণ অভিযান চলছে সরকারিভাবে তার নামকরণ করা হয়েছে “আনফিনিশড বিজনেস”। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ওই এলাকায় পরিচালিত অপারেশনের নাম ছিল আনফিনিশড বিজনেস। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের শুক্রবারের বিবৃতিতে বলা হয়, জরুরি ভিত্তিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক আহ্বান করা উচিত। তাদের উচিত বর্মী কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে দেয়া যে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নৃশংস ক্যাম্পেইন বন্ধ করা না হলে দেশটির বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।
সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয় পরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেছেন, বর্মী সামরিক বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে দিশাহারা রোহিঙ্গারা দিগি¦দিক ছুটছেন। আর তারা দেখতে পাচ্ছেন তাদের চোখের সামনে পুড়ে যাচ্ছে নিজেদের বসতবাড়ি।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে তারা যেসব ডাটা এবং ইমেজসমূহ সংগ্রহ করেছেন; তার সঙ্গে উত্তর রাখাইন রাজ্যের ব্যাপক ধ্বংসলীলার সামঞ্জস্য রয়েছে। উত্তর রাখাইন রাজ্যের, রথেডং, বুথিডং এবং মংডুসহ বিভিন্ন টাউনশিপে নির্বিচারে অগ্নিসংযোগের আলামত পাওয়া গেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এমন ২১টি বিশেষ এলাকা চিহ্নিত করেছে; যেখানে স্যাটেলাইটের ‘‘হিটস সেন্সিং টেকনলজি’’ তাৎপর্যপূর্ণভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছে যে বিশাল এলাকাজুড়ে আগুন লাগিয়ে সবকিছু পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ ভিত্তিক ওয়াকিবহাল সূত্রগুলো হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছে, সীমান্তের ওপার থেকে তারা হেভি এবং লাইট মেশিনগান দিয়ে গুলি চালানোর ভারি আওয়াজ পেয়েছেন। গ্রামগুলোতে মর্টারের শেল পড়ার শব্দও পরিষ্কার শোনা গেছে। আর তারপরই সীমান্তের অদূরের গ্রামগুলোতে ধূ¤্র উদগিরণও শনাক্ত করা গেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে আরো বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীগুলো দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ বর্মী সরকার নাকচ করেছে। তারা দাবি করেছে যে, রাখাইনে বর্তমানে সামরিক বাহিনী একটি সন্ত্রাস দমন অভিযানে নিয়োজিত আছে। আর সেই অভিযানে প্রায় চারশ ব্যক্তি নিহত হয়েছে। আর তাদের ভাষায় নিহতদের অধিকাংশই সন্দেহভাজন জঙ্গি। বর্মি কর্তৃপক্ষ কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই দাবি করেছে যে, উত্তর রাখাইনে জঙ্গি এবং রোহিঙ্গা গ্রামবাসীরা ৬০টি গ্রামের ছয় হাজার আটশ পঁয়তাল্লিশটি বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের বিবরণ বর্মী কর্মকর্তাদের এই দাবিকে চ্যালেঞ্জ করছে। যেমন মংডু টাউনশিপের বাসিন্দা ৩২ বয়স্ক মোমেনা বলেছেন, তিনি গত ২৬শে আগস্ট বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। এর আগের দিন নিরাপত্তা বাহিনী তার গ্রামে আক্রমণ চালায়। সৈন্যরা গ্রামে এলে তিনি তার সন্তানদের নিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন। এরপর তিনি যখন ফিরে আসেন, তখন তিনি সেখানে ৪০ থেকে ৫০ জন গ্রামবাসীর মৃতদেহ দেখতে পান। এরমধ্যে কিছু শিশু ও জ্যেষ্ঠ লোকেরা ছিলেন। মোমেনা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, নিহতদের কারও শরীরে ছুরিকাঘাত, কারও শরীরে বুলেট এবং কারও শরীরে উভয় ধরনের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, ‘‘মৃতদের মধ্যে আমি আমার পিতার লাশও খুঁজে পেয়েছিলাম। তার গলা কেটে ফেলা হয়েছে। আমি আমার পিতাকে কবর দিতে পারিনি। আমি পালিয়ে এসেছি।’

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=82115