৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:২২

ঠাঁই নেই নতুন ক্যাম্পে, খাদ্য পানি সংকট

উখিয়া সীমান্তের কুতুপালং থেকে শুরু। টেকনাফ সীমান্তের শাহপরীর দ্বীপে শেষ। দীর্ঘ এ পথের বিভিন্ন স্থানে ঠাঁই নিয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। পাহাড়ের চূড়া, রাস্তার ধারে, বিভিন্ন গাছগাছালি ও দোকানপাটের কিনারায় আশ্রয় নিয়েছে আরো অগণিত রোহিঙ্গা। সবাই ক্লান্ত। চোখে মুখে উদ্বেগ ও আতঙ্কের ছাপ। অসহায় রোহিঙ্গাদের প্রাণান্তর চেষ্টা মাথা গোঁজার ঠাঁই। অনেকেই বাঁশখড় দিয়ে দুই চালা ঘর বেঁধে বসে পড়েছেন। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু পশ্চিম কূল পয়েন্ট, উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালী শফিউল্লাহ কাটার ঢালা, থাইংখালীর তাজনিমার খোলা ও হাকিমপাড়ার বনবিভাগের বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে তুলেছে নতুন ৪ রোহিঙ্গা বস্তি। হোয়াইক্যংয়ের রাইক্ষ্যংয়ে গড়ে উঠেছে
আরো একটি অস্থায়ী ক্যাম্প। সেখানে পুরোদমে চলছে ছোট ছোট তাঁবু স্থাপনের কাজ। ৪টি নতুন বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। তার পরও ঠাঁই হচ্ছে না। অনেকের কোনো রকম আশ্রয় জুটলেও খাবারের জন্য হাহাকার করছে। শত শত নারী-শিশু অভুক্ত থাকছে। এদের দুর্দশা দেখে কেউ কেউ ত্রাণ দিয়ে সাহায্য করছেন। ত্রাণবাহী গাড়ি আসলেই রোহিঙ্গারা দল বেঁধে ছুটছেন। কিন্তু ব্যক্তি ও বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে এসব ত্রাণও কেউ পাচ্ছেন, কেউ পাচ্ছেন না।
গতকাল সকালে উখিয়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পালংখালী ইউনিয়নের জামতলী বাগানে অবৈধভাবে বস্তি স্থাপনকারী ১ হাজার ঝুপড়ি উচ্ছেদ করা হয়েছে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) নুরুল আবসার চৌধুরী এর সত্যতা স্বীকার করেন।
মিয়ানমারের ওয়াবেং গ্রামের স্বামী হারানো রোহিঙ্গা মমতাজ বেগম (২৮) কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, তার স্বামী আবুল ফয়েজকে মিয়ানমারের মগ সেনারা ধরে নিয়ে গুলি করে মেরেছে। শিশু সন্তান নিয়ে অন্যদের সহযোগিতায় টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের কাঞ্জরপাড়া হয়ে এপারে চলে আসি। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের বালুখালী টিভি রিলে কেন্দ্র সংলগ্ন তাঁবুতে আশ্রয় নেয়া শাহাব বাজার এলাকার মৃত আশরফ আলীর ছেলে আলী আহমদ (৭০) বলেন, ৩ দিন আগে বাড়ি থেকে বের হয়েছি। মগ সেনারা বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। এখনো পর্যন্ত কোনো কিছু খেতে পারিনি। ছোট একটি তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছি। পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১১ জন। এর মধ্যে ৭ জন ছেলে, ২ জন মেয়ে। মিয়ানমারের মংডু গারদ বিল গ্রামের এজাহার হোসেন (৫৫) বলেন, তার এলাকায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে মগ সেনারা। এসব স্মৃতি চোখে ভাসছে। বালুখালীর ঢালে আশ্রয় নেয়া জামাল হোসেন বলেন, আমার বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে। এখনো পর্যন্ত বেঁচে আছে কি না জানিনা। মা-এর মুখ থেকে কোনো কিছুই বের হচ্ছে না। ঝিমনখালী গ্রামের নূর মোহাম্মদ (৫০) বলেন, তার একটি ছেলে মগ সেনাদের গুলিতে আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার কবরও দিতে পারিনি। হাকিমপাড়ার বস্তিতে আশ্রয় নেয়া রহিমা খাতুন, আজু মেহের বলেন, ‘অবাজি ইন কি দেইখ্যি, জীবনতও এনগরি ঘর বাড়ি পুরি দিয়ে, মানুষ মাইজ্জেদে ন দেখি। আর দুয়া পুয়া খুজি ন পাই।’ ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য সহযোগিতা দিচ্ছে। এরাও মানুষ। সীমান্ত এলাকায় বিজিবির সদস্যরা রাতদিন পরিশ্রম করছে। অনুপ্রবেশে ঠেকাতে তৎপর রয়েছে বিজিবির জোয়ানরা। টহলরত ঘুমধুম বিজিবির নায়েক সুবেদার রফিকুল ইসলাম বলেন, জড়ো হওয়া রোহিঙ্গারা যাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে না যায়, তা দেখা হচ্ছে। পুশব্যাক করা হবে কি না জানতে চাইলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতির অপেক্ষায় আছেন বলে জানান তিনি। এদিকে বালুখালীতে বনভূমির কয়েক শত একর জায়গায় গড়ে উঠছে নতুন আরেকটি রোহিঙ্গা বস্তি। সাবেক ইউপি সদস্য ফজল কাদের ভুট্টো বলেন, যেখানে রোহিঙ্গা বস্তি হচ্ছে, সেখানে আমার বহু জমি বেদখলে চলে গেছে। আমি যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান চাই। রোহিঙ্গারা চলে গেলে আমি খুশি। থাইংখালীর ভারপ্রাপ্ত বনবিট কর্মকর্তা মাসুম সরকার বলেন, বনভূমি দখল করে রোহিঙ্গা বস্তি করতে যাওয়ায় বাধা দিলে স্থানীয় কিছু বখাটে চক্র আমার সঙ্গে তর্কে জড়ায়। বিষয়টি আমি ইউএনওসহ বনবিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট অবহিত করেছি। তবে নতুন অনুপ্রবেশ করে এপারে আশ্রিত রোহিঙ্গা বলেন, আরাকান রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামে অগ্নিকাণ্ডে আগুনের লেলিহান শিখা সীমান্ত এলাকা থেকে দেখা যাচ্ছে। আতঙ্কিত রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে এপারে ঢুকে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

উখিয়ার পার্শ্ববর্তী ঘুমধুম, তুমব্রু, জলপাইতলীর নুরুল ইসলামের আমবাগান, পশ্চিমকুলের বাঁশ বাগান, উখিয়ার রহমতের বিল, ধামনখালী, বালুখালী, পালংখালী, টেকনাফের হোয়াইক্যং উলুবনিয়া, লম্বাবিল, খারাইংগ্যা ঘোনা এলাকা দিয়ে রোহিঙ্গাদের স্রোত অব্যাহত রয়েছে। রোহিঙ্গারা রাতের আঁধারে অনুপ্রবেশ করে টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্প, নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্প, উখিয়া কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্প, কুতুপালং ও বালুখালী অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছে। অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। পুুরুষদের ধরে গুলি করে হত্যা করছে। মহিলাদের নির্যাতন ও ধর্ষণ করা হচ্ছে। রোহিঙ্গারা আতঙ্কে পাহাড়, ধান ক্ষেতে ও বনজঙ্গল দিয়ে পালিয়ে লুকিয়ে আছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। কিন্তু বিজিবি বাধা দেওয়ায় কেউ ঢুকতে পারছে না। তারা রাতের আঁধারে বিজিবির চোখ ফাঁকি দিয়ে অনুপ্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। পালিয়ে আসা মিয়ানমারের ঢেকিবনিয়ার দিল মোহাম্মদ ও মিনারা বেগম জানান, সেনাবাহিনী গ্রামে ঢুকে অত্যাচার করছে। পুরুষদের ধরে নির্যাতন চালিয়ে গুলি করে হত্যা করছে। গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে গোটা গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। প্রায় সময় মিয়ানমারের মগ সেনাদের তাণ্ডব চলছে।

অপরদিকে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গুলিতে ৫ রোহিঙ্গা আহত হয়েছে। তারা হলেন, বুচিদং দম বাজারের মোহাম্মদ শোয়াইবের স্ত্রী সিরাজুন নেছা (৩২), তার মেয়ে উম্মে সালমা (১৩), ছৈয়দ নুরের ছেলে আবু ছিদ্দিক (৪০), জহির হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ সাদেক (৩২)। এদের সবাইকে উখিয়ার কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=81640