বিপন্ন রোহিঙ্গা নারীর আহাজারি
৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:০২

রাথিদং-বুথিদংয়ের জঙ্গলে অবরুদ্ধ ৩লাখ রোহিঙ্গা ॥ শতাধিক শিশুর প্রাণহানি

কামাল হোসেন আজাদ ও শাহনেওয়াজ জিল্লু, কক্সবাজার : গেল সপ্তাহে আরাকানের নিরস্ত্র নিরীহ রোহিঙ্গাদের উপর বর্মী সামরিক বাহিনী কিলিং অপারেশন শুরু করলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে দিকবিদিক ছুটে যায়। রাথিদং ও বুথিদং এ বিভিন্ন রোহিঙ্গা পল্লীর প্রায় ৩লাখ রোহিঙ্গা গহীন অরণ্যে আশ্রয় নেয়। বিশেষ করে তংবাজার ও তামী এলাকার অরণ্যে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা অগণিত অসংখ্য।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাহাড়ে আশ্রিত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা এখন মানবেতর দিন যাপন করছে। খাদ্য সঙ্কটে পড়ে প্রাণহানির ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক। এ পর্যন্ত কয়েকশ’ শিশুর প্রাণহানি ঘটেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। খাবারের অভাবে গাছের লতাপাতা, শিকড় খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করছে তারা। খোলা আকাশের নীচে বৃষ্টিতে ভিজে অসুস্থ হয়ে পড়ছে নারী-শিশু ও বৃদ্ধরা। তারা না পারছে লোকালয়ে আসতে আর না পারছে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে আগাতে।
সূত্র জানিয়েছে, পাহাড়ের চারপাশে বেষ্টন করে আছে বর্মী হানাদার বাহিনী এবং উগ্রপন্থী রাখাইন দল নাডালা। পাহাড় থেকে বের হলেই নিশ্চিত মৃত্যু অবধারিত রোহিঙ্গাদের। সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতি থেকে ৩লাখ রোহিঙ্গাকে উদ্ধারের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে সচেতন মহল।

নাফ নদী এখন লাশের নদী!
নাফ নদীতে এখন লাশের মিছিল। যতই দিন গড়াচ্ছে লাশের সংখ্যা ততই বাড়ছে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লাশের সংখ্যা। জেলেরা এখন নাফ নদী থেকে প্রতিদিন মাছের বদলে লাশ উত্তোলন করছে। কেউই মাছ ধরতে আর এনদীতে যাচ্ছে না। জেলেরা প্রতিদিনের মত নদীতে যায় ঠিকই। তবে মাছ ধরতে নয় লাশ তুলতে। এদিকে গতকালও কক্সবাজারের টেকনাফের নাফ নদী থেকে আরও দুজন রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। রোববার রাত সাড়ে ৮টা থেকে সোমবার সকাল ১০টার মধ্যে লাশ দুটি উদ্ধার করা হয়। এ নিয়ে গত বুধবার থেকে এখন পর্যন্ত নাফ নদী থেকে ৫৫ জন রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সবশেষ উদ্ধার হওয়া লাশ দুটির মধ্যে একজন শিশু ও একজন নারী। রোববার রাতে শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়। গতকাল সোমবার সকালে উদ্ধার করা হয় নারীর লাশ।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাইনুদ্দিন খান বলেন, লাশ দুটি উদ্ধার করে পুলিশের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
মিয়ানমারের আরাকানে দেশটির বাহিনী দমন-পীড়ন ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চালাচ্ছে। এ অবস্থায় গত প্রায় এক সপ্তাহে রাখাইন থেকে প্রায় ৬০ হাজার শরণার্থী বাংলাদেশে এসেছে। এসব শরণার্থীর মধ্যে প্রায় সবাই রোহিঙ্গা মুসলিম। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর গত শনিবার এই তথ্য জানায়।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গুলী ছুড়েছে মায়ানমার
এদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসতবাড়ি লক্ষ্য করে বার্মার সীমান্ত থেকে গুলী ছোড়া হয়েছে। রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলী ছোড়া হয়। এতে হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তবে সীমান্তে বসবাসকারী নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বার্মার হেলিকপ্টার তিন দফায় আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনায় বাংলাদেশের প্রতিবাদ জানানোর এক দিনের মাথায় সীমান্তে আবারো এ ঘটনা ঘটল।
বিজিবি ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু ও কক্সবাজারের ঘুমধুম সীমান্তে কয়েক রাউন্ড গুলীবর্ষণ করে বার্মার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি।
সূত্রের দাবি, বার্মার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির তুমব্রু ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কয়েক রাউন্ড গুলী ছোড়া হয়। এর মধ্যে একটি গুলী তুমব্রুর উত্তরপাড়ার আবদুল করিম সওদাগরের টিনের চাল ভেদ করে ঘরে পড়ে। তবে এতে কেউ হতাহত হয়নি। কিন্তু স্থানীয় বাজার ও আশপাশের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ গণমাধ্যমকে জানান, তুমব্রু বাজারে গুলী এসে পড়ায় স্থানীয়রা আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা কয়েকটি গুলী উদ্ধার করে স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পে জমা দিয়েছি।’ ঘুমধুম এলাকার আবদুর রহিমও একই কথা জানান। পরে বিজিবি ও পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।

এ বিষয়ে বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান বলেন, ‘বার্মার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় রোববার সন্ধ্যায় তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কয়েক রাউন্ড গুলী নিক্ষেপ করেছে।’
উখিয়া টেকনাফের পথে পথে রোহিঙ্গা
এদিকে টেকনাফের প্রধান সড়ক, বেড়ি বাঁধ ও বিস্তীর্ণ বিল জুড়ে রোহিঙ্গা আর রোহিঙ্গা। ঈদের পর দিন রোববার ৩ সেপ্টেম্বর দিনভর এ দৃশ্য দেখা গেছে। স্থানীয় প্রশাসন ও আইন শৃংখলা বাহিনী এদের সামাল দিচ্ছে।

সরেজমিন দেখা গেছে হোয়াইক্যং বিজিবি চেকপোস্টের পাশে মাঠে কয়েক শত রোহিঙ্গাকে বিভিন্ন যানবাহন থেকে নামিয়ে জমায়েত করে রাখা হয়েছে। একইভাবে হ্নীলা চৌধুরীপাড়া বার্মিজ সরকারী প্রাইমারী স্কুলে এবং হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদে কয়েক শত রোহিঙ্গাকে জড়ো করেছে। এ দুই স্থানে বিজিবিকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। আবার সিএনজি, টমটম, মাহিন্দ্রা, ছারপোকা, মিনি ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনযোগে ইচ্ছামত উভয় দিকে চলে যাচ্ছে। তাছাড়া লোকালয় এবং লেদা, নয়াপাড়া, কুতুপালং, বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প সমূহে ঢুকে পড়ছে বলে জানা গেছে। এমনকি অনেক রোহিঙ্গা উপকূলীয় ইউনিয়ন বাহারছড়ার শামলাপুর চলে গেছে। আবার কিছু রোহিঙ্গাকে উঞ্চিপ্রাং সরকারি প্রাইমারী স্কুলে এবং নিকটবর্তী রইক্ষং নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

সব চেয়ে বেশী দেখা গেছে কাঞ্জরপাড়ায়। এখানে নাফ নদীর পাশে ধান ক্ষেতে কয়েক মাইল জুড়েই ছিল আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গা। প্রধান সড়কে বিজিবি ছিল তৎপর। সারা দিন রোদে পুড়ে ঝড়ে ভিজে সন্ধ্যার সময় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা উঞ্চিপ্রাং, কুতুবদিয়াপাড়া, কাঞ্জরপাড়া, ঝিমংখালী, মিনাবাজার প্রধান সড়কের কাছে চলে আসে। এসময় প্রধান সড়কের উভয় দিকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা অবস্থানের কারণে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। সন্ধ্যার পর পুলিশ-বিজিবি’র পদস্থ কর্মকর্তা রোহিঙ্গা জমায়েতের পয়েন্টগুলো পরিদর্শন করেন।

http://www.dailysangram.com/post/298435