২৯ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:৪৯

হজে যেতে পারেননি অনেকে

বঞ্চিতদের আহাজারি

রাজশাহীর পুঠিয়ার কৃষক আলমাছ আলী। ২০১৬ সালে ইকো এভিয়েশন অ্যান্ড ট্যুরিজম থেকে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে হজের প্রাক-নিবন্ধন করেন। কিন্তু গত বছর তাকে হজে পাঠাতে পারেননি এজেন্সি মালিক রুহুল কুদ্দুস। এ বছর তার ভিসা হয়েছে। সারা জীবনের একান্ত বাসনা মক্কার পবিত্র মাটিতে মহান প্রভুর ইবাদতের আশায় গত ২৪ আগস্ট বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাজধানীর আশকোনা হজ ক্যাম্পে আসেন। কিন্তু পাঁচ দিনেও তার বিমান টিকিট দেয়নি এজেন্সি মালিক। আলমাছ আলী বলেন, ‘এজেন্সি মালিক তার কাছে আরো ৫০ হাজার টাকা দাবি করছে। কিন্তু এখন হঠাৎ করে এত টাকা পাবো কোথায়। তাই দিতে পারিনি। এ জন্য টিকিটও দেয়নি এজেন্সি।’ ফলে আর হজে যাওয়াও হলো না তার। এ কথা বলেই অঝোর ধারায় কেঁদে চলেন আলমাছ। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, এজেন্সির প্রতিনিধি আতাউর রহমানের কাছে তিনি টাকা দিয়েছিলেন। আরো অনেকেই তার প্রতারণার শিকার। গত পরশু তাদের কেউ কেউ অতিরিক্ত টাকা দিলে তাদের টিকিট দেয়া হয়েছে। আর যারা দেননি তাদের টিকিট দেয়নি এজেন্সি। এ বিষয়ে হজ অফিসে অভিযোগ দেয়া হয়। কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তারা আতাউরকে আটক করেন। জানা যায়, বেসরকারি এজেন্সি ইকো এভিয়েশন অ্যান্ড ট্যুরিজম এমন ২১ জনের সাথে প্রতারণা করেছে। এ কারণে ওই এজেন্সির দালাল আতাউরসহ তিনজনকে আটক করেছে বিমানবন্দর থানা পুলিশ। আটক অন্য দু’জন হলেন, ফরিদুর রহমান ও সুমনা। গতকাল আশকোনা হজ ক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, শতাধিক হজযাত্রী ভিসা হওয়ার পরও হজে যেতে না পারায় আহাজারি করছেন। কুড়িগ্রামের উলিপুর থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাজ করতেন নুরন্নাহার। তিনি সাউথ এশিয়ান ট্রাভেলসে হজে যেতে জমা দিয়েছেন তিন লাখ ২০ হাজার টাকা। নুরন্নাহার বলেন, এখন হজ এজেন্সির লোকজনকে খুঁজে পাচ্ছি না। এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। প্রতারণার শিকার হয়ে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করলেও তাদের অভিযোগ শোনার মতো কোনো কর্মকর্তাকে হজ অফিসে দেখা যায়নি। ধর্মমন্ত্রী তিন দিন আগেই সৌদি আরব পাড়ি জমিয়েছেন। আর যিনি হজযাত্রীদের জন্য দেনদরবার করছিলেন সেই হাব মহাসচিবও এক দিন আগে চলে গেছেন হজে। যার কাছে অভিযোগ দেয়ার নিয়ম সেই হজ পরিচালকও গতকাল ভোররাতের ফ্লাইটে সৌদি চলে যান। অগত্যা কর্মরত পুলিশ প্রতারণার শিকার হজযাত্রীদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে। এতে ক্যাম্পে অবস্থানরত ১২৩ জন তাদের নাম-ঠিকানা লিপিবদ্ধ করেন। প্রতারণা করা হজ এজেন্সিগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলোÑ আল সাফার ১৬ জন, সাউথ এশিয়ার ১৬ জন, গোন্ডেন এয়ারের আটজন, গুলশান মোহাম্মদীয়ার সাতজন, ওলামা আউলিয়া হজ গ্রপের সাতজন, আল মদিনার ছয়জন, আশা এজেন্সির ছয়জন, সাঈদ এয়ার ট্রাভেলসের তিনজন, ইউরেশিয়ার দুইজন, আল বালাদের একজন, আবাবিল এজেন্সির একজন উল্লেখযোগ্য। তবে হজযাত্রীদের সূত্রে জানা যায়, এর আগেই হজ এজেন্সির প্রতারণা ধরতে পেরে ক্যাম্পে তিন-চার দিন থেকে চলে যান আরো কয়েক শ’ হজযাত্রী।

এ দিকে গতকাল বিকেলে বিমান মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বেসামরিক বিমান পরিবহনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন জানান, হজ এজেন্সিগুলোর অব্যবস্থাপনা, গাফিলতি ও নানা জটিলতার কারণে এবার ৩৯৭ জন যাত্রী হজে যেতে পারছেন না। তিনি বলেন, এবার এক লাখ ২৭ হাজার ৫০০ জন হজযাত্রী পাঠানোর কথা ছিল। সেখানে সরকারিভাবে যাওয়ার কথা ছিল চার হাজার ২০০ জন। এজেন্সিগুলোর পাঠানোর কথা এক লাখ ২২ হাজার, আর ডেলিগেট যাবে এক হাজার ২৫০ জন। চুক্তি অনুযায়ী ৫০ ভাগ পাঠাবে সাউদিয়া এয়ারলাইন্স আর বাকি ৫০ ভাগ পাঠাবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। সেই হিসাবে বিমান ও সাউদিয়ার ৬৩ হাজার ১২৫ জন করে হজযাত্রী বহনের কথা। তবে বিমানের যাত্রীর মধ্যে সরকারি ডেলিগেটের এক হাজার ২৫০ জন যুক্ত ছিল।
তিনি বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ৬৪ হাজার ৮৭৩ জন যাত্রী বহন করেছে। সাউদিয়া ৬২ হাজার ২৩০ জন যাত্রী পরিবহন করেছে, যেখানে তাদের ৬৩ হাজার ১২৫ জন পাঠানোর কথা ছিল। বিমান ও সাউদিয়া এয়ারলাইন্স মিলে এক লাখ ২৭ হাজার ১০৩ জন হজযাত্রী পাঠিয়েছে। ৩৯৭ জন রয়েছেন যাদের সবারই ভিসা হয়নি, কিংবা তারা পাসপোর্ট করেননি বা টিকিট করেননি, তারা রয়ে গেছেন, তারা আমাদের হিসাবের মধ্যে আসেননি।

মন্ত্রী বলেন, শেষ পর্যন্ত আমাদের হজ এজেন্সি ধরে আনতে র্যাব ব্যবহার করতে হয়েছে। তাদের ধরে আনা হয়েছে টাকা আদায়ের জন্য। এবার আমরা চিহ্নিত করতে যাচ্ছি, যেসব হজ এজেন্ট, যারা এ ধরনের প্রতারণা করেছে, তাদের লাইসেন্স বাতিলের বিষয়ে। এটা মূলত ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। যেসব ট্রাভেল এজেন্ট টিকিট নিয়ে যাত্রী দেয়নি তাদের লাইসেন্স বাতিল করার পদক্ষেপ গ্রহণ করব। এজেন্সিগুলোকে জরিমানাও করা হবে। আমরা ধর্ম মন্ত্রণালয়কে বলেছি আবশ্যিকভাবে লাইসেন্স বাতিল করতে হবে।

সোমবার রাতে হজে যাওয়ার ফ্লাইট শেষ হচ্ছে জানিয়ে বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী বলেন, ২৬ আগস্ট পর্যন্ত হজে যাওয়ার ফ্লাইট পরিচালনার কথা থাকলেও বিমানের অক্লান্ত পরিশ্রমে পরে আরো আটটি স্লøট নিয়ে আসা হয়। এর দু’টো স্লট এখনো আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। আমরা আরো ৮১৯ জন যাত্রী পাঠাতে পারতাম। পরপর দু’বছর হজ পালনকারীদের কাছে বাড়তি দুই হাজার রিয়াল দাবি, ই-ভিসার প্রিন্ট জটিলতা, মোয়াল্লিম ফি বৃদ্ধির কারণে এবার হজযাত্রী পরিবহনে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে আমাদের হজ এজেন্সিগুলোর প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড। এরমধ্যে প্রধান বিষয়টি হচ্ছে বাড়িভাড়া। ইচ্ছাকৃতভাবে তারা আগে বাড়ি ভাড়া করেনি। অনেক হজ এজেন্সি যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে টিকিট না করে পালিয়ে গেছে। তাই সময়মতো হজযাত্রী সরবরাহ করতে না পারার কারণে বিমান ও সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের ক্যাপাসিটি লস হয়। বিমানকে ২৪টি ও সৌদিয়াকে চারটি ফ্লাইট বাতিল করতে হয়েছে। এটা অত্যন্ত অস্বাভাবিক বলেই আমরা মনে করি। হজযাত্রী পরিবহনে সৃষ্ট সঙ্কটের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অবহিত করা হয়েছে জানিয়ে বিমানমন্ত্রী বলেন, এবার যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে সেই অভিজ্ঞতার আলোকে আগামী বছর থেকে ধর্ম মন্ত্রণালয়, বিমান মন্ত্রণালয়সহ সবাইকে নিয়ে পরিকল্পনা করার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। হজ শেষে ফিরতি ফ্লাইটগুলো নির্বিঘœ হওয়ার আশাবাদ জানিয়ে মেনন বলেন, গত কিছু দিন আমরা সবাই উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলাম। সব উৎকণ্ঠা দূর করে শেষ পর্যন্ত আমরা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছি। হজ ফ্লাইট বাতিলের কারণে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানমন্ত্রী বলেন, ক্ষয়ক্ষতির হিসাব আমরা করব, তা কিভাবে পুষিয়ে নেয়া যায় সেই ব্যবস্থাও করব। সংবাদ সম্মেলনে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোসাদ্দেক আহমেদসহ মন্ত্রণালয় ও বিমানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

হিসাবের গরমিল : বিমানমন্ত্রী গতকাল জানিয়েছেন, এ বছর হজযাত্রী এক লাখ ২৭ হাজার ৫০০ জন। সেখানে সরকারিভাবে যাওয়ার কথা ছিল চার হাজার ২০০ জন। এজেন্সিগুলোর পাঠানোর কথা এক লাখ ২২ হাজার, আর ডেলিগেট যাবে এক হাজার ২৫০ জন। তবে ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, এ বছর হজের কোটা ছিল এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন। এ ছাড়া আরো এক ২৭০ জন সরকারি ডেলিগেট সৌদি গেছেন। সে হিসাবে মোট যাত্রী ছিলে এক লাখ ২৮ হাজার ৪৬৮ জন। এর মধ্যে ভিসা হয়েছে এক লাখ ২৭ হাজার ৫৯৬ জনের। অর্থাৎ ৮৭২ জনের ভিসাই হয়নি। হজ পরিচালক সাইফুল ইসলামের মতে, হয় তারা নিজেরা ভিসা করেননি অথবা তারা আগেই প্রতারণার শিকার হয়ে ভিসার আবেদন করেননি। ফলে কোটার ৮৭২ জন আগেই তালিকা থেকে বাদ গেছেন।

বিমানমন্ত্রীর দেয়া তথ্য মতে, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ৬৪ হাজার ৮৭৩ জন যাত্রী বহন করেছে। সাউদিয়া ৬২ হাজার ২৩০ জন যাত্রী পরিবহন করেছে। বিমান ও সাউদিয়া এয়ারলাইন্স মিলিয়ে এক লাখ ২৭ হাজার ১০৩ জন হজযাত্রী পাঠিয়েছে। সে হিসাবে ৪৯৩ জন হজযাত্রী হজে যেতে পারেননি। বিমানমন্ত্রীর তথ্য মতে, বিমান বাংলাদেশ হজযাত্রীদের পাশাপাশি এক হাজার ২৫০ জন সরকারি ডেলিগেট বহন করেছে। তবে হজ অফিস জানিয়েছে, ডেলিগেট গেছেন এক হাজার ৭০ জন। এ ডেলিগেটরা হজ কোটার বাইরে থাকেন। ফলে হজযাত্রী কম গেছে আরো এক হাজার ২৭০ জন। ফলে মোট হজযাত্রী কম গেছেন এক হাজার ৭৬৩ জন। আর না হওয়া যাত্রী মিলে এ বছর কোটা থেকে মোট যাত্রী কম গেছেন দুই হাজার ৬৩৫ জন।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/248060