২৫ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ১১:৪৭

খোলা আকাশের নিচে দেড় লাখ টন সার

এক সময় সারের জন্য কৃষককে দৌড়াতে হতো ডিলারের গুদামে। সারের জন্য দিনের পর দিন বসে থাকতে হতো। নেতা ধরেও মিলত না সার। কৃষককে জীবনও দিতে হয়েছে সারের জন্য। তবে সময় পাল্টে গেছে_ কৃষকের সারা বছরের চাহিদা মিটিয়েও উদ্বৃত্ত আছে সার। পর্যাপ্ত আমদানি ও উৎপাদনের ফলে উদৃ্বত্ত সার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে বিসিআইসি। গুদামে জায়গা না থাকায় সারাদেশে দেড় লাখ টন সার খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে। কোথাও কোথাও সার নষ্ট হচ্ছে বন্যার পানিতে। আবার কোথাও রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হচ্ছে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন-বিসিআইসির গুদামে জায়গা না হওয়ায় পরিবহন ঠিকাদাররা সারের একটি অংশ অযত্নে-অবহেলায় ফেলে রাখেন। ঠিকাদাররা এ সারকে বলেন, 'ট্রানজিট সার'। বর্তমানে ট্রানজিট সার হিসেবে সারাদেশে প্রায় ৭ লাখ টন সার রয়েছে। বিসিআইসির বাফার (আপৎকালীন) গুদামে জায়গা না থাকায় এমনটা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোদ-বৃষ্টিতে নষ্ট হওয়া ছাড়াও মাসের পর

মাস পড়ে থাকা সারের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে সংরক্ষণের জন্য নির্ধারিত তাপমাত্রার অভাবে। এ জন্য সার পরিবহনকারী ও ডিলাররা বিসিআইসিকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, রোদ-বৃষ্টি ও বারবার টানাহেঁচড়া করার কারণে বস্তা থেকে সার পড়ে ওজন কমে যাচ্ছে। সার বুঝে নেওয়ার তাগিদ দিলেও বিসিআইসি গুদাম সংকটে সার বুঝে নিচ্ছে না। আরও গুদাম নির্মাণ না করলে এ সমস্যা দূর হবে না। তারা দেশের বিভিন্ন নৌবন্দরে দ্রুত গুদাম নির্মাণের দাবি জানান।

বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন (বাফা) সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রতি বছর সারের চাহিদা থাকে ২৫ থেকে ২৬ লাখ টন। এর মধ্যে বিসিআইসি গড়ে প্রতি বছর আমদানি করে প্রায় ১৪ লাখ টন ইউরিয়া। আরও ১৩ থেকে ১৪ লাখ টন সার দেশের সাতটি সরকারি কারখানায় উৎপাদন হয়। আমদানি ও দেশে উৎপাদন করা সার চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর থেকে পরিবহন ঠিকাদারদের মাধ্যমে সারাদেশে বিসিআইসির ৩৯টি স্থানে গুদামজাত করার জন্য পাঠানো হয়। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তিউনিশিয়া ও কাতার থেকে বিসিআইসি ইউরিয়া সার আমদানি করে।

জানা যায়, কৃষকের কাছে চাহিদা অনুযায়ী সার দিতে বিসিআইসি সারাদেশে ২৪টি বাফার গুদামে ইউরিয়া সার মজুদ করে। এ ছাড়া দেশের সাতটি ইউরিয়া সার কারখানাসহ বিসিআইসির ১৫টি কারখানা মিলিয়ে সারাদেশে ৩৯টি গুদামে প্রায় দুই লাখ টন ইউরিয়া সার মজুদ করা যায়। গুদামের বাইরে খোলা জায়গায় আরও দেড় থেকে দুই লাখ টন সার মজুদ করা হয়। সব মিলিয়ে বিসিআইসির নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সারাদেশে প্রায় পাঁচ লাখ টন সার মজুদ রাখা যায়।

আমদানি করা সার গুদাম পর্যন্ত পরিবহন করা হয় বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। নিয়ম অনুযায়ী, বন্দর থেকে সার বুঝে নেওয়ার পর সর্বোচ্চ ২১ দিনের মধ্যে পরিবহন ঠিকাদারদের সেই সার গুদামে পেঁৗছে দেওয়ার কথা। তবে মাসের পর মাস চলে গেলেও সার বুঝে নেয় না বিসিআইসি।

এ জন্য পরিবহন মালিকরা বিসিআইসির কাছে জরিমানাও দাবি করেন। দেশে সিংহভাগ সার পরিবহন করে মেসার্স পোটন ট্রেডার্স, বাল্ক ট্রেড, রেক্স মোটরস, নবাব অ্যান্ড ট্রেডার্স, সাউথ ডেল্টা এবং গ্রামসিকো লিমিটেড।

জানা গেছে, যশোরের নোয়াপাড়া, পাবনার নগরবাড়ী, সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী, বগুড়ার শান্তাহারে সার মজুদ করে রাখেন পরিবহন ঠিকাদাররা। নগরবাড়ী নৌবন্দর এলাকায় বাফার গুদাম না থাকায় হাজার হাজার টন ইউরিয়া সার খোলা আকাশের নিচে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। মাসের পর মাস এভাবে পড়ে থাকায় সারের গুণগত মান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রতি বস্তায় দুই থেকে তিন কেজি ওজনে কম থাকায় কৃষকরা সার কিনে প্রতারিত হচ্ছেন বলে ডিলাররা অভিযোগ করেছেন।

বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষা করতে সার ত্রিপল ও পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে বাইরের খোলা আবহাওয়ায় রাসায়নিক সার পড়ে থাকায় এর গুণগত মান ও ওজন কমে যায়। সোহাগ ট্রান্সপোর্টের ম্যানেজার ছমির উদ্দিন বলেন, নগরবাড়ী নৌবন্দরে বিসিআইসির কোনো গুদাম বা সার সংরক্ষণাগার নেই। মাসের পর মাস সার খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখায় তীব্র ঝাঁজে চলাফেরাও কঠিন। উত্তরাঞ্চলের জন্য যে পরিমাণ সার নগরবাড়ী বন্দরে আসে, তাতে এখানে বাফার গুদাম নির্মাণ জরুরি।

বাল্ক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের সার পরিবহন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, বিসিআইসির গুদামে ধারণ ক্ষমতা দেড় থেকে দুই লাখ টন। পরিবহন ঠিকাদারদের ডাম্প করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। অনেক সময় ডাম্পেও জায়গা না পাওয়ায় লাইটারেজ জাহাজ সার নিয়ে ভাসতে থাকে। এতে অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হয়। এ ছাড়া রোদ-বৃষ্টি থেকে সার রক্ষা করতে ত্রিপল ও গুদাম ভাড়া এবং অতিরিক্ত লেবার বিল দিতে হয়। তিনি বলেন, আগে সারের জন্য কৃষক কান্নাকাটি করত, এখন পরিবহনকারীরা সার নিয়ে কান্নাকাটি করছেন। বর্ষায় সার রক্ষণাবেক্ষণ করা খুবই কঠিন।

সার পরিবহনকারী সোহাগ ট্রেডার্সের ম্যানেজার সাদেকুর রহমান জানান, বিসিআইসি সময় মতো বুঝে না নেওয়ায় দীর্ঘ সময় সার পথে ও বন্দরে পড়ে থাকে। এতে কিছু অপচয় হয়। বিসিআইসি এর দায় সার পরিবহনকারীদের ওপর চাপিয়ে দেয়।

নবাব অ্যান্ড ট্রেডার্সের জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, 'বর্ষা ও বন্যায় অনেক সার নষ্ট হয়েছে। ঘাটতি কীভাবে পূরণ করব তা নিয়ে আমরা দিশেহারা।'

বিসিআইসির মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) মঞ্জুর রেজা সমকালকে বলেন, 'বিভিন্ন বন্দরে থাকা সার নিয়ে আমরাও সমস্যার মধ্যে থাকি। গুদাম সংকটের কারণে সব সময় সার বুঝে নেওয়া সম্ভব হয় না। সমস্যা দূর করতে সরকার ১৩টি গুদাম নির্মাণ শুরু করেছে। এসব গুদামে এক লাখ ৩০ হাজার টন সারের সংকুলান হবে। আরও ৩৪টি গুদাম নির্মাণের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে আছে। এ ছাড়াও খুলনা ও যশোরের নিউজপ্রিন্ট মিলের খালি জায়গায় গুদাম নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে দ্রুত এ সমস্যা মিটে যাবে।'

এ বিষয়ে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, বিসিআইসির সার আমদানির সময় পরিবহনকালে প্রায় ৭ লাখ টন ইউরিয়া সার সব সময় ট্রানজিটে থাকে। এসব সার ব্যবস্থাপনা নিয়ে সমস্যার অভিযোগ আছে। সুষ্ঠুভাবে এ ট্রানজিট সার ব্যবস্থাপনা করতে চলতি মাসেই বিসিআইসির সঙ্গে মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটকের চুক্তি হয়েছে। এখন ট্রানজিট সারের সঠিক অবস্থান জানা সহজ হবে মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে। ফলে এখন থেকে সার ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে। টেলিটক এ বিষয়ে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দেবে।

http://bangla.samakal.net/2017/08/25/319963