২৪ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৬:১৫

ছাত্রলীগের জিজ্ঞাসাবাদে হয়রানির শিকার সাধারণ শিক্ষার্থীরা

বাদ যাচ্ছে না দলীয় নেতাকর্মীরাও

১২ আগস্ট রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মুনিরুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদেও নামে বেধরক মারধর করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রলীগ কর্মী আলী হুসেনের নেতৃত্বে উর্দু বিভাগের ইমরুল কায়সার, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের মাহমুদুল হাসান এবং স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের রেজা। পরে জানা যায় সে শিবিরের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নয়। খবর পেয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে দেখতে যান এবং বলেন আমাদের অবস্থান সবসময় জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে তবে তাতে যেন কোন সাধারণ শিক্ষার্থী যাতে হয়রানী না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। শুধু মুনির নয় ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক এই জিজ্ঞাসাবাদের দরুন হয়রানীর শিকার হচ্ছেন আরো অনেক সাধারণ শিক্ষার্থী। ১৩ আগস্ট রবিবার রাতে বিশ^বিদ্যালয়ের মুহসীন হলে গেস্টরুমে আসতে দেরি করায় উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাইম ইসলামকে চড় মেরে কানের পর্দা ক্ষতিগ্রস্থ করে হল সভাপতি জহির ইসলামের অনুসারী হলের দফতর সম্পাদক আরিফুল ইসলাম। পরে ঐ শিক্ষার্থীকে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করেন তার সহপাঠীরা। একই দিন বিকেলে ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে অংশ না নেওয়ায় ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের দিপু ইসলাম, ফারসি বিভাগের দ্বীন ইসলাম ও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মিলনকে বের করে দেন হল শাখা ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক মেহেদী হাসান মিজান। এরা সবাই দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

এর আগে ৮ আগস্ট মঙ্গলবার রাতে জিয়া হল ছাত্রলীগের সভাপতি ইউসুফ উদ্দিন খানের অনুসারীরা সমাজবিজ্ঞান বিভাগ ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দ্ল্লুাহকে শিবির সন্দেহে মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করে।
সিলেটে দুই ছাত্রলীগ কর্মী আহত হওয়ার পর ছাত্রলীগ নেতারা এই আঘাতের সমুচিত জবাব দেবেন বলে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন। এর পর থেকেই দেশের বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে চলে শিবির বিরোধী কর্মসূচী। ছাত্রলীগের সভাপতি ও সেক্রেটারীর প্রকাশ্য নির্দেশে তারা বিভিন্ন ক্যাম্পাসগুলোতে চালাচ্ছে শিবির বিরোধী অভিযান। আর এর ফলে আতঙ্কে দিন কাটছে হলে অবস্থানরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে। তারা মনে করছেন যারা শিবির করে তারা ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় নিরাপদেই আছে। মাঝখান থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের আক্রোশের শিকার হচ্ছেন।

ছাত্রলীগ সভাপতি-সেক্রেটারীর বক্তব্যের পর দেখা যায় প্রধানত চারটি কারনে নেতা কর্মীরা এতটা অতি উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। প্রথমত, পদ পদবীর আশায় তারা সভাপতি-সেক্রেটারীর কথা মতো কাজ করে নিজেকে শো-অফ করার দিকে ঝুকছেন। দ্বিতীয়ত- আসছে বছরে নতুন ছাত্রদের হলে জায়গা করে দেয়ার জন্য পুরোনোদের বিভিন্ন বেøইম দিয়ে হল ছাড়া করা। তৃতীয়ত, ডিপার্টমেন্ট ও হল কেন্দ্রিক রাজনীতিতে মুখোমুখি কর্মীদের দমন করা। চতুর্থত, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত আক্রোশ মিটানো।
সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রথমে ছাত্রলীগের এই কার্যক্রমকে সানন্দের সাথে গ্রহণ করলেও পরবর্তীতে দেখা যায় এতে হয়রানীর শিকার হন সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের পদধারীরাও। ফলে তাদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে। কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা যায়, আগস্টের বিভিন্ন প্রোগ্রামে যারা অংশগ্রহণ করেনা তাদের নানা ভাবে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়। দর্শন বিভাগের এক ছাত্র জানান, ক্লাস, এ্যাসাইনমেন্ট ও প্রেজেন্টেশনের কারনে নিয়মিত প্রোগ্রামে যাওয়া হয়না এ নিয়ে বড় ভাইরা তাদের নানা ভাবে হয়রানী করেন।

এর পূর্বে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের সভাপতি বোরহান উদ্দিনকে নারী কেলেঙ্কারীর দায়ে মারধর করে তার আবাসিক হল শাখা ছাত্রলীগের সেক্রেটারী শাহেদ খানের অনুসারীরা। কিন্তু পরবর্তীতে হল প্রশাসনের তদন্তে বেরিয়ে আসে সে প্রকৃতভাবে এই ঘটনার সাতে সম্পৃক্ত নয়, এবং নির্দোষ।
৯ আগস্ট বৃহস্পতিবার দুপুরে ব্যক্তিগত শত্রুতার জের ধরে বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা এবং এক সাধারণ শিক্ষার্থীকে ব্যাপক মারধর করে। পরে মারত্মক আহত অবস্থায় তাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হামলায় আহত অন্য একজন হলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ইমরান ফরাহদ ইমু। মারধরে অংশ নেওয়া বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগের নেতা সরদার ইসরাফিল জানান, এর আগে তার ওপরেও হামলা করা হয়। তিনি তার প্রতিশোধ নিয়েছেন।
১২ আগস্ট শনিবার বিভিন্ন হল থেকে শিবির সন্দেহে ৭ শিক্ষার্থীকে পুলিশে সোপর্দ করে ছাত্রলীগ। তারা হলেন, সূর্যসেন হলের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ইমন হোসাইন ও মোহাম্মদ বোরহান। এফ রহমান হলের, আরবি বিভাগের জিল্লুর রহমান ও মাহাবুব আলম একই হলের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের নাজমুল হাসান। বিজয় একাত্তর হলের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি বিভাগের আমিন হাওলাদার এবং জিয়া হলের মনোবিজ্ঞান বিভাগের মুনিরুল ইসলাম।
১৫ আগস্ট শোক দিবসের দিন বিশ^বিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলে বিভিন্ন স্থানে লাগানো শোক দিবসের পোস্টার ছিড়াকে কেন্দ্র করে জিজ্ঞাসাবাদের পর হলের ১১ শিক্ষার্থীকে যৌথভাবে পুলিশে সোপর্দ করে হল ছাত্রলীগ ও হল প্রশাসন। এর মাঝে ৩-৪ জন ছাত্র হলে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে নিয়মিত সক্রিয় ও অন্যরা সাধারণ ছাত্র। হলে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী জানান দিতে হল ছাত্রলীগ এ কাজ করে বলে পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ায় উঠে আসে।

১৮ আগস্ট শুক্রবার রাতে বিশ^বিদ্যালয়ের মুহসিন হলে শিবির সন্দেহে ৫ শিক্ষার্থীকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ করে হল ছাত্রলীগ। এসময় মারধর করে তাদের রক্তাক্ত অবস্থায় পুলিশের হাতে তুলে দেয় তারা। এসময় মারধরে হল ছাত্রলীগের সভাপতি জহির রায়হান সরকার ও সেক্রেটারী মেহেদী হাসান সানীর নেতৃত্বে হলের ছাত্রলীগ নেতারা অংশ নেন। এর মাঝে ৪ জনকে শিবির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে এবং ১ জনকে সন্দেহবশত আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ এইসব ঘটনায় কোন সময়ই হল প্রাধ্যক্ষদের কোন ধরনের কোন সহায়তা পাননা তারা। কোন শিক্ষার্থী শিবির সন্দেহে আটক হলে তাকে ছাত্রলীগের জিজ্ঞাসাবাদের পরে সরাসরি পুলিশে সোপর্দ করেই তারা দায়িত্ব সাড়েন। অথচ ঐ শিক্ষার্থী প্রকৃত অর্থে শিবিরের সাথে সম্পৃক্ত কিনা তা যাচাই করার কোন প্রয়োজন মনে করেন না তারা।
দেখা যায়, কোন কোন শিক্ষার্থী শিবির সন্দেহে আটক হওয়ার পর জানা যায় সে আদৌ শিবিরের কর্মকান্ডে জড়িত নয়, কিন্তু সে পরবর্তীতে হলে উঠতে পারছেনা। আর শিবির সংশ্লিষ্টরা গ্রেফতার হওয়ার পরও ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্র জানান, শিবির এর রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে হল থেকে বের করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে সে তার স্বপক্ষে শিবির সংশ্লিষ্টার কোন প্রমাণ নেই প্রদর্শন করার পরও তাকে হলে উঠতে বাধা পেতে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে এখানে হল প্রাধ্যক্ষ ও বিশ^বিদ্যালয় প্রক্টরের দায় সাড়া ভূমিকাকে দায়ী করেন তিনি।

এইসব ব্যাপারে জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হাসান ইনকিলাবকে বলেন, এইসব ঘটনায় থানায় কোন মামলা দায়ের করা হয়নি। বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের আটক করে আমাদের হাতে তুলে দেয় তারপর মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দিতে বলে। এসময় তার কাছে আটককৃত ছাত্রদের ব্যাপারে তদন্ত করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে মামলা না হলে তো আমরা তদন্ত করতে পারিনা। আর এইসব ব্যাপারে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবে, আমি কিছুই বলতে পারবোনা।

মুহসিন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নিজামুল হক ভূইয়া বলেন, আটককৃত ছাত্রদের ব্যাপারে পুলিশকে বলা হয়েছে তারা এইসব কিছুর সাথে সংশ্লিষ্ট থাকলে ব্যবস্থা নিতে আর কোন ধরনের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ না পাওয়া গেলে তাদের ছেড়ে দিতে। এসময় ছাত্রদের মারধর করা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের কাছে এ ব্যাপারে কেউ অভিযোগ নিয়ে আসেনা। আসল কথা হলো যে মারধরের শিকার হয় সেও কোন অভিযোগ করেনা, কেউ যদি অভিযোগ করে তাহলে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবো।

https://www.dailyinqilab.com/article/93169