২৩ আগস্ট ২০১৭, বুধবার, ১:২১

ভয়াবহ হয়ে উঠছে নারী নির্যাতনের চিত্র

আবু সালেহ আকন

ক্রমেই ভয়াবহ আর বীভৎস হয়ে উঠছে নারী নির্যাতনের চিত্র। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ভয়ানক কায়দায় ঘটছে নারীর ওপর নির্যাতন। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যাসহ নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারীরা। স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণ, সন্তানের সামনে মাকে তুলে নেয়া আবার। মাকে বেঁধে রেখে সন্তানকে তুলে নিয়ে পাশবিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে বেশকিছু ক্ষেত্রেই নির্যাতনকারীদের সাথে ক্ষমতাসীনদের যোগাযোগ রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সরাসরি জড়িত এমন লোকজনও এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে।

পাবনার সুজানগরে দুই স্কুলছাত্রীকে স্থানীয় বখাটে হজরত আলী, আল আমিন, শাহীন, মিঠুন, পাঙ্কু ও সোহেল রানা অস্ত্রের মুখে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। দুর্বৃত্তরা এই দৃশ্য আবার মোবাইল ফোনে ভিডিও করে। এই ভিডিও ফাঁস করার ভয় দেখিয়ে ওই ছাত্রীদের আবারো তাদের সাথে যেতে বলে দুর্বৃত্তরা। তাতে দুই ছাত্রী অস্বীকৃতি জানালে সম্প্রতি সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনায় সুজানগর থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। পরে তারা আদালতে মামলা করে।

দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে এক মাদরাসাছাত্রীকে তার চাচাতো দুলাভাই ধর্ষণ করে তা ভিডিও করে। পরে ওই ভিডিও প্রকাশের ভয় দেখিয়ে তার ওপর নিয়মিত পাশবিক নির্যাতন করে আসছিল দুলাভাই দুলাল হোসেন। ওই মেয়েটি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে বিষয়টি জানাজানি হয়। নওগাঁয় এক কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় ১৭ আগস্ট মামলা হয়েছে।
নীলফামারীর ডিমলায় গত শনিবার রাতে মাকে বেঁধে রেখে মেয়েকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা। পরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় প্রায় এক মাইল দূরের একটি মাঠ থেকে ওই নারীকে উদ্ধার করা হয়।
গত ১৭ আগস্ট বরগুনার বেতাগীতে এক স্কুলশিক্ষিকাকে ক্লাসরুমের মধ্যে আটকে পাশবিক নির্যাতন চালায় দুবর্ৃৃত্তরা। ওই স্কুলশিক্ষিকা তার স্বামীর সঙ্গে ক্লাসরুমে বসে কথা বলছিলেন। এ সময় সুমন বিশ্বাস, রাসেল, সুমন কাজী, রবিউল, হাসান ও জুয়েল ক্লাস রুমে ঢুকে স্বামীকে বেঁধে রেখে ওই স্কুলশিক্ষিকাকে গণধর্ষণ করে।

বগুড়ায় শ্রমিক লীগ নেতা তুফান গত ১৭ জুলাই প্রতিবেশী এক মেয়েকে বাসায় ডাকে এবং দিনভর আটকে রেখে কয়েক দফায় তার শ্লীলতাহানি ঘটায়। মেয়েটি রক্তক্ষরণ নিয়ে বাসায় যায় এবং তার মা ঘটনাটি জানতে পারেন। কিন্তু তুফান সরকার মুখ না খুলতে হুমকি দেয়ায় তারা বিচারপ্রার্থী হয়নি। এ দিকে ধর্ষণের কথা জানতে পেরে তুফানের স্ত্রী আশা খাতুন, তার বড় বোন পৌরসভার সংরক্ষিত আসনের নারী কাউন্সিলর মারজিয়া হাসান রুমকি ও মা রুমী বেগম মেয়েটির বাড়িতে যায়। তারা ধর্ষণের বিচার করে দেয়ার কথা বলে মেয়েটি ও তার মাকে রুমকির চকসূত্রাপুরের অফিসে নিয়ে আসে। তারা মা-মেয়ের বিরুদ্ধে যৌন ব্যবসার মিথ্যা অপবাদ দেয়। এরপর তুফান সরকারের লোকজন দুইজনকে লাঠিপেটা করে এবং একপর্যায়ে নাপিত ডাকে। প্রথমে মা-মেয়ের মাথার চুল কেটে দেয়া হয় এবং পরে তুফান সরকারের স্ত্রীর নির্দেশে দুইজনকে ন্যাড়া করে দেয়া হয়। এরপর ২০ মিনিটের মধ্যে বগুড়া শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য শাসিয়ে দুইজনকে রিকশায় তুলে দেয়া হয়।
ময়মনসিংহের নান্দাইলে এক স্কুলছাত্রীকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে পাটক্ষেতে নিয়ে ধর্ষণ করেছে একই এলাকার ইব্রাহীম নামে এক যুবক। রাজধানীর বনানীতে গত ৫ জুলাই জন্মদিনের দাওয়াত দিয়ে বাসায় ডেকে এক তরুণীকে ধর্ষণ করে বাহাউদ্দীন ইভান নামের এক ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান।

গত ৭ জুলাই সাভারের সোবহানবাগে ডিবি পুলিশ অফিসের ৫০ গজ সামনে একটি কলেজের অফিস কক্ষে এক তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়। এভাবে ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে নারী নির্যাতনের চিত্র। পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১১শ’ ৬০টি, ফেব্রুয়ারি মাসে ১১শ’ ৭১টি, মার্চ মাসে ১৪শ’ ৭৭টি, এপ্রিলে ১৩শ’ ৮৬টি, মে মাসে ১৭শ’ ১৯টি, জুন মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১৪শ’ ২১টি এবং জুলাই মাসে ১৬শ’ ৯১টি ঘটনা ঘটেছে।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন বিএইচআরএফের চেয়ারপারসন ও প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেছেন, নারী নির্যাতনের এই ভয়ানক রূপ সৃষ্টির পেছনে নানা কারণ রয়েছে। বিগত দিনগুলোতে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার প্রতিকার হয়নি। মিডিয়ায় না আসলে কোনো ঘটনার প্রতিকার হয় না। মিডিয়ায় আসে না এমনো অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। এলিনা খান বলেন, যারা নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা মনে করে কিছুই হবে না। তখনই এই ধরনের বিপর্যয় ঘটে। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে যখন ঘটনা ঘটে তখন বীভৎসতা প্রকট রূপ নেয়। এলিনা খান বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে এরূপ ঘটনা ঘটবে। তিনি বলেন, নারী নির্যাতনের অনেক মামলা বছরের পর বছর পড়ে আছে। সেদিকে কারো কোনো নজরদারি নেই। সেখানে স্বচ্ছতা নেই। ফলে দুর্বৃত্তরা সবসময়ই ভাবে ঘটনা ঘটালে তারা পার পেয়ে যাবে। কিছুই হবে না। যে কারণে একের পর এক এভাবে ঘটনা ঘটছে।

মানবাধিকারকর্মী আবুল বাসার বলেন, যাদের ঘরে কন্যা সন্তান রয়েছে সেসব অভিভাবকরা সারাক্ষণ দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকেন। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নেই। অনেক সময় দেখা যায় যারা নির্যাতনের শিকার তারা আইনি সহায়তাও পান না।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/246306