২২ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:২১

সময়মতো শিক্ষার্থীদের বই পাওয়া নিয়ে শঙ্কা

সিন্ডিকেটের কবলে নতুন পাঠ্যবই

টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ * বছরের বাকি চার মাস, অর্ধেক বইয়ের টেন্ডার প্রক্রিয়া চলছে * মাধ্যমিকের ১২ বই তৈরি চলছে এখনও, সিডি যায়নি প্রাথমিকের

নতুন বছরে বিনামূল্যের পাঠ্যবই সময় মতো শিক্ষার্থীদের হাতে না যাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। চার মাস পর শুরু হবে শিক্ষাবর্ষ। কিন্তু এখন পর্যন্ত অর্ধেকের বেশি বইয়ের টেন্ডার প্রক্রিয়াই শেষ হয়নি। এখনও চলছে বই লেখা-সংশোধন ও সিডি তৈরির কাজ। প্রথমবারের মতো প্রায় ১৮ কোটি বই এবার নতুন প্রযুক্তিতে বাঁধাই করা হবে। অথচ এ ধরনের মেশিন নেই এমন কিছু প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছে। বিদেশিদের ঠেকাতে টেন্ডারে অংশ নেয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা ভাগবাটোয়ারা করে কাজ নিয়েছে। কয়েক বছর নির্ধারিত সময়ে বই দিতে পারেনি এবং কালো তালিকাভুক্ত বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানও কাজ পেয়েছে। এসব কারণে কাজ ঝুলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।


এ প্রসঙ্গে জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা যুগান্তরকে বলেন, ‘নতুন প্রযুক্তির বাঁধাইয়ের কারখানা নেই- এমন কোনো প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়নি। দু’একটি টেন্ডার বিলম্ব হয়েছে। কিন্তু এ কারণে বই ছাপা ও পৌঁছাতে বিলম্ব হবে না। আমাদের মনিটরিং কমিটি ২৪ ঘণ্টা কাজ করছে। তারা কাজ তুলে আনবে।’ তিনি বলেন, ‘এনসিটিবিতে সার্বিকভাবে কোনো দুর্নীতি নেই। অনেকেই এখানে ছোটখাটো স্বার্থ চায়। যখন পায় না, তখন অভিযোগ করে। টেন্ডারে অনিয়ম হয়েছে আর তা সমাধান হয়নি, এমন রেকর্ড নেই। তবে তারা (দরপত্রদাতা) যেভাবে চায়, সেভাবে অপেক্ষা করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই।’

এনসিটিবি চেয়ারম্যানের সঙ্গে একমত নন অনেক মুদ্রাকর। জানা গেছে, সংস্থাটির ভেতরের অবস্থা, কয়েকজন কর্মকর্তার অপতৎপরতা ইত্যাদি জানিয়ে মুদ্রণ শিল্পসমিতি ১৭ জুলাই শিক্ষামন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়েছে। এর আগেও বই মুদ্রণ কাজে জড়িত চারটি সংগঠন শিক্ষামন্ত্রীর কাছে একই বিষয়ে স্মারকলিপি দেয়। ওইসব সমিতির নেতারা নাম প্রকাশ না করে যুগান্তরকে জানান, তাদের স্মারকলিপিতে অসাধু চক্রের কার্যকলাপ এবং বিরাজমান মৌলিক সমস্যা ও তার সমাধানে প্রস্তাব ছিল। কিন্তু ইতিবাচক পদক্ষেপের পরিবর্তে এনসিটিবিতে দ্বৈত নীতি দেখা গেছে। এবারের বইয়ের টেন্ডার নিয়েও নানা অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। একদিকে কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছে। অপরদিকে উপযুক্ত ও আধুনিক প্রতিষ্ঠানকে বাদ দেয়া হয়।

এ বছর এনসিটিবি বেশ কয়েকটি টেন্ডারে ভাগ করে ৩৫ কোটি ১৩ লাখ ২৬ হাজার ২০৭টি বই ছাপার কাজ করছে। এর মধ্যে নবম শ্রেণীর ১২টি পাঠ্যবই ‘সুখপাঠ্যকরণ’ নাম দিয়ে সংশোধন করে নতুন রূপে তৈরি করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে- বাংলা, ইংরেজি, পদার্থ, রসায়ন, জীববিদ্যা, উচ্চতর গণিত, বিজ্ঞান, বাংলাদেশের ইতিহাস ও সভ্যতা, অর্থনীতি, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, হিসাববিজ্ঞান ইত্যাদি। জানা গেছে, এসব বইয়ের টেন্ডার প্রক্রিয়া এখনও চলছে। অপরদিকে বইগুলো প্রণয়ন প্রক্রিয়া এখনও শেষ হয়নি। ফলে আগামী এক মাসেও এগুলো ছাপা শুরু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, বই তৈরি এবং টেন্ডার প্রক্রিয়া আমরা পাশাপাশি চালাচ্ছি। আশা করছি, সমস্যা হবে না।

প্রাথমিকের বই নিয়ে কেলেঙ্কারির তথ্য পাওয়া গেছে। ৯৮টির মধ্যে ৯৬ লটের কাজ ৪২ দিনে শেষ করার কার্যাদেশ দিয়ে বইয়ের সিডি মুদ্রাকরদের সরবরাহ করা হয়। কিন্তু প্রেসে গিয়ে সিডি খুলে দেখা যায়, প্রাথমিকের নয়, ইবতেদায়ি স্তরের বইয়ের সিডি। এরপর এনসিটিবি ভুল সিডি ফেরত নেয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত আসল বইয়ের সিডি দিতে পারেনি। এসব করতে ৪২ দিনের ৩০ দিন চলে গেছে। এখনও প্রাথমিকের বই ছাপা শুরু হয়নি। এ পরিস্থিতিতে ঈদ চলে আসায় মুদ্রাকররা এনসিটিবির সঙ্গে ১৬ আগস্টের এক বৈঠকে ঈদের আগে সিডি নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। পাশাপাশি সিডি দেয়ার পর ৪২ দিন গণনার দাবি উঠেছে।

যদিও বিষয়টি অস্বীকার করে সংস্থাটির ভারপ্রাপ্ত বিতরণ নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিকের সিডি সরবরাহ করা হয়েছে। মুদ্রণাদেশও দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগ দিতে পারেনি। এ কারণে মুদ্রণ কাজ শুরু হয়নি।

শিক্ষামন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে মুদ্রণ শিল্প সমিতির চেয়ারম্যান তোফায়েল খান বলেন, ‘কার্যাদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের অনিয়ম হচ্ছে বলে আমাদের কাছে সমিতির সদস্যরা অভিযোগ করেছেন। এর সমাধান না করেই কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘টেন্ডার প্রক্রিয়া যেভাবে চলছে তাতে যথাসময়ে পাঠ্যবই সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।’

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, বিদেশি হটাতে ২০১৫ সালের মতো এবারও প্রাথমিকের বই নিয়ে দেশীয় মুদ্রাকররা সিন্ডিকেট করেছেন। জোট বেঁধে তারা প্রাক্কলনের চেয়েও কম দরে কাজ নিয়েছেন। ফলে নিন্মমানের বই যাওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। ২০১৫ সালেও প্রাক্কলনের চেয়ে ২০০ কোটি টাকার কমে কাজ নেয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নিন্মমানের বই সরবরাহ করেছিল। এ ব্যাপারে সিন্ডিকেটভুক্ত একজন মুদ্রাকর নাম প্রকাশ না করে বলেন, প্রাথমিকের বই ৯৮ লটে টেন্ডার হয়েছে। এর মধ্যে আমরা দেশি প্রতিষ্ঠান কে কোনটায় অংশ নেব, সেটা আলোচনা করতেই পারি। এটাকে সিন্ডিকেট বলা ঠিক হবে না।

জানা গেছে, এ প্রক্রিয়ায় যেসব প্রতিষ্ঠান এবার কাজ পেয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগ গত কয়েক বছর নানা অপরাধে চিহ্নিত হয়ে জরিমানা দিয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি নিন্মমানের কাগজে মুদ্রণ, সময় মতো বই না দেয়ার দায়ে অভিযুক্ত। কালো তালিকাভুক্তও আছে কয়েকটি।

২০১৫ সালে ‘ল’ আদ্যাক্ষর নামে একটি প্রতিষ্ঠান বইয়ের মুদ্রণ কাজ নিয়ে কাগজ সংক্রান্ত কেলেঙ্কারির দায়ে কালো তালিকাভুক্ত হয়। গত বছর নিজের স্ত্রীকে মালিক বানিয়ে একই স্থানে একই মেশিনে অন্য নামে কাজ নেয়। বিভিন্ন অপরাধে এই প্রতিষ্ঠানও ফের চিহ্নিত হয়ে জরিমানার শিকার হয়েছে। এরপর একই ঠিকানায় এ বছরও নতুন নামে কাজ পেয়েছে বলে জানা গেছে। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগ তুলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এনসিটিবি মন্ত্রণালয় এবং দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংকে লিখিত অভিযোগ করেছে। নাম প্রকাশ না করে একজন মুদ্রাকর বলেন, নানা অভিযোগের কারণে বিশ্বব্যাংক থেকে প্রাথমিকের ২টি লটের কাজের অনাপত্তি পায়নি এনসিটিবি। ফলে এ দুই লটের কার্যাদেশ দেয়া হয়নি।

এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, জরিমানার শিকার প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ পাবে না, তা আইনের কোথাও বলা নেই। সিডিউলের শর্ত পূরণ করে অনেকেই কাজ পেয়ে যায়। তখন আমরা আইনত বাদা দিতে পারি না। আর এটা ঠিক যে, কালো তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়েছে। এটাকে তুঘলকি কাণ্ডই বলব। কিন্তু যখন নাম পরিবর্তন করে আসে, তখন আর বাদ দিতে পারি না।

জানা গেছে, প্রাক-প্রাথমিক এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় পড়ার বইয়ের টেন্ডার প্রক্রিয়া এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি। এ ব্যাপারে এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী বলেন, প্রাক-প্রাথমিকের মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ওপর বিশ্বব্যাংকের অনাপত্তি আমরা এখনও পাইনি। আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বইয়ের চাহিদা চূড়ান্ত হয়নি। এসব কাজ শেষ হলেই টেন্ডার কাজ শুরু হবে।

এ ব্যাপারে একাধিক মুদ্রাকর জানান, এবার সব বইয়ের কাজ কাছাকাছি সময়ে শুরু হয়েছে। ফলে উৎপাদন বিঘিœত হবে। এ কারণে শেষের দিকে বই সরবরাহ আটকে যাবে। বিশেষ করে বাড়তি চাপে পড়বে ছোট প্রেসগুলো। ওই অবস্থায় নিন্মমানের ছাপা, বাঁধাই ও কাগজে বই সরবরাহ হবে। কেননা শেষের দিকে এনসিটিবি মানের দিকে না তাকিয়ে সংখ্যার দিকে তাকায়। এ সুযোগই নেয় অসৎ মুদ্রাকররা।

 

http://www.jugantor.com/last-page/2017/08/22/150015/