১৪ আগস্ট ২০১৭, সোমবার, ১০:১১

সিঙ্গাপুরে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে বাংলাদেশি এক ডজন শ্রমিক

সিঙ্গাপুরে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার ১২ বাংলাদেশি নির্মাণ শ্রমিক। বেতন না পেয়ে তারা না পারছেন দেশে আসতে, না পারছেন সিঙ্গাপুরে থাকতে। এসব বাংলাদেশির প্রতিজনের পাওনা কয়েক হাজার সিঙ্গাপুরী ডলার। কিন্তু তাদের নিয়োগকারী এসজেএইচ ট্রেডিংয়ের শাহজাহান এ দাবিকে অস্বীকার করছেন। বাংলাদেশি এসব শ্রমিকের দুর্ভোগকে ইংরেজিতে ‘লিম্বো’ দিয়ে আখ্যায়িত করেছে সিঙ্গাপুরের অনলাইন দ্য স্ট্রেইটস টাইমস। লিম্বো শব্দে অর্থ হতে পারে নরক যন্ত্রণা। তার মানে এসব বাংলাদেশির দুর্ভোগকে স্ট্রেইটস টাইমস নরক যন্ত্রণা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এসব শ্রমিকের মধ্যে কয়েকজন হলেন আমিনুল (৪৬), হাসান মেহেদি (৪৬), সাইজুদ্দিন (৪৮), জামান (৪৬), কাদির (৪৭), শফিকুল (৩৭), মোহাম্মদ লিটন (৪৫) ও মনিরুল ইসলাম (২৯)। প্রথমে বেতনভাতা না পাওয়া এ শ্রমিকরা তাদের বকেয়া বেতন দাবি করে এ বছরের প্রথম দিকে সিঙ্গাপুরের মানবসম্পদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছিলেন। সেখান থেকে এ বিষয়ে মধ্যস্থতা করা হয়। কিন্তু তা ব্যর্থ হওয়ার পর যুক্ত হয় ট্রাইপার্টিট এলায়েন্স ফর ডিসপুট ম্যানেজমেন্ট। তারপর এ বিষয়টি চলে যায় এমপ্লয়মেন্ট ক্লেইমস ট্রাইব্যুনালে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মামলার সুরাহা হয়নি। যেহেতু কর্তৃপক্ষ এ মামলাটি দেখাশোনা করছে তাই বাংলাদেশি এসব শ্রমিকের অন্য কাজের অনুমোদন আপাতত বন্ধ। তারা অন্য কোথাও কাজে যোগ দিতে পারছেন না। এজন্য নিজেদের খরচও জোগাড় করতে পারছেন না। এ অবস্থায় তাদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। তারা এখন মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষা করছেন। দ্য সানডে টাইমস গত শুক্রবার এমপ্লয়মেন্ট ক্লেইমস ট্রাইব্যুনালে শুনানির পর এমন ৮ জন বাংলাদেশি শ্রমিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তাদের বেশির ভাগেরই বয়স ৪০ এর কোটায়। তারা বলেছেন, তাদের সঙ্গে কোম্পানির মাসে ১৬০০ ডলার বেতনের চুক্তি হয়েছে। এর বাইরে রয়েছে ওভারটাইমের বিল। কিন্তু তাদের বেতন দেয়া হয়নি। তাছাড়া কোম্পানির তরফ থেকে বলা হয়েছে, তাদের যে কাজের বিপরীতে যে স্লিপ দেয়া হয়েছে তা ভুয়া। তারা বলেছেন, সিঙ্গাপুরে পৌঁছার পর তাদের জালান সুলতানে অবস্থিত শাহজাহানের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বেতনের ফাঁকা ভাউচারে তাদের আঙুলের ছাপ দিতে বলা হয়। যারা তা দিতে অস্বীকৃতি জানান তাদের ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করার হুমকি দেয়া হয়। বলা হয় তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে। কিন্তু এমন ঝুঁকি নেয়া তাদের অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। কারণ, তারা সিঙ্গাপুরে যেতে প্রায় ৭০০০ ডলার পর্যন্ত ঋণ করেছেন। এদের একজন হাসান মেহেদী (৪৬)। তিনি ১২ই জানুয়ারি সিঙ্গাপুরে পৌঁছেন। তার পরিবারের ৯ সদস্যের তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার দাবি এসজেএইচ ট্রেডিং কোম্পানিতে তার বেতনের ১৬৯১০ ডলার বাকি। এর সঙ্গে রয়েছে ওভারটাইমের বিল। তাকে যখন বেতনের ফাঁকা ভাউচারে আঙুলের ছাপ দিতে বলা হয় তখন তিনি কর্তৃপক্ষকে জানান তিনি আঙুলের ছাপ দিতে পারবেন না। মেহেদী বলেন, আমার সামনে ঝুঁকি ছিল। আমি ভীত হয়ে পড়েছিলাম। কারণ, সিঙ্গাপুরে আসতে আমাকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়েছে। প্রতি মাসে এ জন্য ব্যাংকে আমাকে দিতে হয় ৬০০ ডলার। যদি আমি ওই সময় ওই ফাঁকা ভাউচারে স্বাক্ষর না করতাম তাহলে আমাকে তারা ফেরত পাঠাতো বাংলাদেশে। তাই ওই ভাউচার ফাঁকা থাকলেও তাতে আমি সই, স্বাক্ষর দিই। এসব শ্রমিক বলেছেন, কোম্পানিতে তাদের বস ফাঁকা ভাউচারে পরে লিখে দিয়েছে যে, তাদের পূর্ণ বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। তাই এসব ডকুমেন্টকে শাহজাহান প্রমাণ হিসেবে দেখাতে পারেন। কিন্তু তাও যদি তিনি প্রমাণ হিসেবে দেখান তাতেও তার গরমিল ধরা পড়ে। কারণ, এসব শ্রমিককে মাসে ১৬০০ ডলার বেতন দেয়ার শর্তে সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়েছে। কিন্তু ওই ‘ভুয়া’ ভাউচারে দেখানো হয়েছে এর চেয়েও অনেক কম। মেহেদী হাসান বলেছেন, তাকে জানুয়ারি মাসে দেয়া হয়েছে ২১০ ডলার। ফেব্রুয়ারিতে দেয়া হয়েছে ৩০০ ডলার। মার্চে দেয়া হয়েছে ১৮৭ ডলার। এপ্রিলে দেয়া হয়েছে ১৬৭.৭৫ ডলার। কিন্তু তার পর মে, জুন, জুলাই তিন মাস পেরিয়ে গেছে। আমাদের ১০ সেন্টও বেতন দেয়া হয়নি। কেন বেতন দেয়া হচ্ছে না এটা শাহজাহানকে জিজ্ঞেস করেন মেহেদী। ফলে এরপরের দিন ১১ই জুলাই তার ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে দেয়া হয়। অন্য শ্রমিকরা বলেছেন, তারা অল্প পরিমাণ অর্থের বিপরীতে বেতনের ভাউচারে স্বাক্ষর করেছেন। এর পরিমাণ ৫০ ডলারের মতো। কিন্তু ওই ৫০ ডলারের স্থানে তিনি ১৬৫০ ডলার লিখে নেন পরে। সিঙ্গাপুরের একাউন্টিং অ্যান্ড কর্পোরেট রেগুলেটরি অথরিটির রেকর্ড অনুযায়ী এসজেএইচ ট্রেডিং প্রতিষ্ঠা করা হয় ২০১৫ সালের মার্চে। এর মালিক দু’জন বাংলাদেশি। তাদের একজন এমএ আহমেদ। তিনি বসবাস করেন ঢাকায়। অন্যজন মিসেস সুমাইয়া জাহান। তিনি বসবাস করেন উডল্যান্ডস হাউজিং বোর্ডের একটি ফ্লাটে। এ বিষয়ে টেলিফোনে স্ট্রেইটস টাইমস যোগাযোগ করে শাহজাহানের সঙ্গে। তখন তিনি নিজেকে কোম্পানির ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দেন। সুমাইয়া জাহান তার মেয়ে এবং স্ত্রী লুৎফর নাহার কোম্পানির পরিচালক। শ্রমিকদের কম বেতন দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শাহজাহান। তিনি বলেছেন, আমার কাছে এ বিষয়ে প্রমাণ আছে। উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান শাহজাহান (৫৩)। ১৯৯৮ সালে সেখানকার একজন স্থায়ী অধিবাসীতে পরিণত হন। তিনি বলেছেন, তার নির্মাণ ও নবায়ন বিষয়ক কোম্পানিতে ১৩০ জন শ্রমিক কাজ করেন। তাদের মাত্র ১৩ জন এমন অভিযোগ করেছেন। তার ভাষায়- তারা আমার নামে কলঙ্ক লেপন করতে চায়। এ সময় তিনি বলেন, যদি সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ এসব শ্রমিককে বেতন দেয়ার নির্দেশ দেয় তাহলে আমি তা দিয়ে দেবো। ওদিকে বাংলাদেশি এসব শ্রমিকের অনেকেই শুক্রবার দ্য সানডে টাইমসকে বলেছেন, তাদের হাতে অর্থ না থাকার কারণে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতে পারছেন না। শাহজাহান বলেন, গেলাং রোডে একটি শপহাউজে শ্রমিকদের জন্য রান্না হয়। ওই স্থানে কিছু শ্রমিকও বসবাস করেন। তিনি বলেন, আমি তাদের মানসম্মত খাবার দিই। আমার নিজের জন্য রান্না করা খাবার তাদের দেই। আমার জন্য এসব খাবার রান্না করেন আমারই শ্রমিকদের একজন। আমি তো তাদের পাঁচ তারকা হোটেলের খাবার খাওয়াতে পারবো না। শাহজাহানের দেয়া তথ্যমতে গেলাংয়ে লরোং ১৩ তে ওই শপহাউজ দেখতে যান দ্য সানডে টাইমসের সাংবাদিক। এ সময় তারা দেখতে পান, তরকারি ও ভাত রান্না হচ্ছে। যেখানে রান্না হচ্ছে তা দু’টি টয়লেটের পাশেই। ভাত রান্নার দুটি বড় পাত্র কালি আর ময়লায় কালো হয়ে গেছে। তরলীকৃত গ্যাসের ট্যাংক রাখা রান্নাঘরের এক কোণে। প্লাস্টিকের একটি বাস্কেটে রাখা চাল। আলু রাখা বস্তায়। তার সঙ্গেই ২০ জোড়ার বেশি জুতো। এ সময় সাংবাদিকরা সেখানে দেখতে পান ১২ জন শ্রমিককে। তাদের একজন নিজেকে শুধু ফোরম্যান হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি বলেন, ওই জায়গাটিতে মাত্র ৮ জন মানুষ থাকা যায়। বাকি যারা আছেন তারা বেড়াতে গিয়েছেন।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=78727