১২ আগস্ট ২০১৭, শনিবার, ২:১২

দুয়ারে বন্যা

ফুঁসছে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা

ভারতের ঢলে বন্যা কবলিত সিলেট সুনামগঞ্জ হবিগঞ্জ নেত্রকোণাসহ হাওড় জনপদ : নদ-নদীর ৯০টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের মধ্যে ৮০টিতেই পানি বৃদ্ধি : বাড়বে আগামী ৭২ ঘণ্টায়ও : গজলডোবা বাঁধ খুলে দেয়ায় তিস্তা বিপদসীমা ছুঁইছুঁই
শফিউল আলম : অব্যাহতভাবে পানি বৃদ্ধির কারণে ফের ফুলে-ফুঁসে উঠেছে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ। ভারতে অবস্থিত নদ-নদীর উজানভাগে মূল অববাহিকায় (ক্যাচমেন্ট এরিয়া) টানা অতিবৃষ্টিতে পানি অবিরত বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের সন্নিকটে উজানে ভারত থেকে নেমে আসা প্রচÐ ঢলের তোড়ে গতকাল (শুক্রবার) থেকে আবারও বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণাসহ বিস্তীর্ণ হাওড় জনপদ। সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, দেশের নদ-নদীসমূহের মোট ৯০টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের মধ্যে ৮০টিতেই পানির সমতল বৃদ্ধির দিকে রয়েছে। পূর্বাভাস মতে প্রধান নদ-নদীসমূহের পানি বাড়বে আগামী ৭২ ঘণ্টায় তথা তিন দিনেও। এদিকে ভারতে বন্যার চাপ সামাল দিতে গিয়ে তিস্তা নদীর উজানে গজলডোবায় বাঁধের অধিকাংশ গেট খুলে দেয়ায় বাংলাদেশে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা বিপদসীমা ছুঁইছুঁই করছে। ধরলা, তিস্তা, ঘাগটসহ বিভিন্ন নদী উপনদী শাখানদীসমূহের সাথে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সবক’টি পয়েন্টেই ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম জেলাসহ উত্তর জনপদের অনেকগুলো নদ-নদী সংলগ্ন এলাকায় ভাঙন তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারণ করেছে। নদী ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ সূত্র জানায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ গতকাল পর্যন্ত বিপদসীমার নিচে থাকলেও উভয় নদের পানি আগে ধীরে ধীরে, এখন দ্রæতই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারতের উজান থেকে ঢলের পানির চাপ এভাবে অব্যাহত থাকলে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ আগামী দুই বা তিন দিনের মধ্যে বিপদসীমায় পৌঁছে যেতে পারে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদের সাথে যুক্ত শাখানদী উপনদীসমূহেও পানি দ্রæত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তদুপরি দেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণের কারণেও এসব নদ-নদীর বাংলাদেশের প্রান্তে পানি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদী ও এর সাথে যুক্ত শাখা-উপনদীসমূহের পানি সকল পয়েন্টে বাড়ছে। তবে এখনও বিপদসীমা থেকে অনেক নিচে রয়েছে।
এদিকে হিমালয় পাদদেশীয় অঞ্চল, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিম এবং আসাম, মেঘালয়, অরুণাচলসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে অব্যাহত অত্যধিক বৃষ্টিপাতের কারণে ভয়াবহ পাহাড়ি ঢল ও বন্যাজনিত সম্ভাব্য দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় চূড়ান্ত সতর্কতা বা ‘রেড অ্যালার্ট’ গতকালও বজায় থাকে। নাগাল্যান্ড, মনিপুর, মিজোরাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে প্রস্তুতি-সতর্কতা বা ‘অরেঞ্জ অ্যালার্ট’ বলবৎ রয়েছে। এর পাশাপাশি সেসব অঞ্চলে সর্বাত্মক সরকারি প্রস্তুতি, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসরতদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তবে বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলসহ সিলেট ফের বন্যার কবলে পড়লেও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের পরিস্থিতি মোকাবিলায় তেমন কোন প্রস্তুতি বা তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
এদিকে পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত অনুসারে, গতকাল ৫টি নদ-নদী ৬টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। অথচ আগের দিনে (বৃহস্পতিবার) ৪টি নদী ৪টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপরে ছিল। গতকাল বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীসমূহের মধ্যে- বৃহত্তর সিলেটের সুরমা নদী গতকাল কানাইঘাট পয়েন্টে আরও তিন গুণ বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার উপরে এবং গতকাল সুরমা হাওর জনপদ সুনামগঞ্জে হঠাৎ বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার ৫৭ সেমি উপরে প্রবাহিত হচ্ছিল। খোয়াই নদী হবিগঞ্জের বাল্লাহ পয়েন্টে হঠাৎ বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৭০ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ভারতের মেঘালয়ে অতি বর্ষণ ও ব্যাপক ঢলের তোড়ে হাওড় জেলা সুনামগঞ্জের জাদুকাটা নদীর পানি আরও বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার ৩৪ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। অপর হাওর জনপদ ময়মনসিংহের নেত্রকোনা জেলায় জারিয়াজঞ্জাইল পয়েন্টে কংস নদীর পানিও হঠাৎ করে বেড়ে গেছে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ি ঢলের তোড়ে এবং গতকাল কংস বিপদসীমার ১৫ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। আর দক্ষিণাঞ্চলের খুলনায় পশুর নদীর পানি বিপদসীমার ১৫ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। যদিও এ ধরনের সমুদ্র উপকূলীয় নদীর পানি বৃদ্ধি (ফ্লাসিং রিভার) সাময়িক।
অন্যদিকে উত্তর জনপদের অন্যতম প্রধান নদী তিস্তায় পানি বেড়ে গিয়ে নীলফামারী জেলার ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার মাত্র ৪ সেমি নিচে তথা খুব কাছাকাছি অবস্থানে প্রবাহিত হচ্ছিল। কুড়িগ্রাম জেলায় ধরলা নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২৬ সেমি নিচে প্রবাহিত হয়। ব্রহ্মপুত্র নদ কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী পয়েন্টে পানি ক্রমাগত বেড়ে গিয়ে সর্বশেষ বিপদসীমার ৮০ সেমি নিচে দিয়ে প্রবাহিত হয়। অপর প্রধান নদ যমুনার পানি প্রতিটি পয়েন্টে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। যমুনা সিরাজগঞ্জে বিপদসীমার ২৮ সেমি নিচে, জামালপুর জেলার বাহাদুরাবাদে বিপদসীমার ৪৫ সেমি নিচে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
গতকাল দেশের মোট ৯০টি নদ-নদীর পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গতকাল পানি বৃদ্ধি পাচ্ছিল ৮০টি পয়েন্টে। অথচ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পানিবৃদ্ধির পয়েন্ট ছিল ৫৩টি, বুধবার ৪৩টি ও মঙ্গলবার ৩৬টিতে। গতকাল পানি হ্রাস পায় মাত্র ১০টি পয়েন্টে। বৃহস্পতিবার হ্রাস পায় ৩৪টিতে। এ পরিস্থিতি নদ-নদীর পানির সমতল আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি পাওয়ার সূচক বা আলামত নির্দেশ করছে।
নদ-নদীসমূহ প্রবাহের গতকাল সর্বশেষ পূর্বাভাসে জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ, গঙ্গা-পদ্মা এবং সুরমা নদ-নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে কুশিয়ারা নদীর পানির সমতল হ্রাস পাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদের পানির সমতল বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে আগামী ৭২ ঘণ্টায় বা তিন দিনেও। অন্যদিকে গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীর পানির সমতল বৃদ্ধি আগামী ৭২ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। অপরদিকে আগামী ২৪ ঘণ্টায় সুরমা নদীর পানির সমতল বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। এ সময় কুশিয়ারা নদীর পানির সমতল প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে থাকতে পারে। পাউবো সূত্র জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের ৯০টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ৯টিতেই ১০০ মিলিমিটারের ঊর্ধ্বে বৃষ্টিপাত হয়েছে। এরমধ্যে সর্বোচ্চ বর্ষণ হয় ভৈরববাজারে ১৬৮ মিলিমিটার। এরপর রয়েছে ফটিকছড়ির নারায়ণহাটে ১৫৫.৫ মিমি, লরেলগড়ে ১৫০ মিমি, পঞ্চগড়ে ১৪০ মিমি, ডালিয়া পয়েন্টে ১৩২ মিমি, সুনামগঞ্জে ১২৫ মিমি।
এদিকে নদ-নদীর প্রবাহ ও বন্যা পূর্বাভাস সম্পর্কে পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান গতকাল ইণকিলাবকে জানান, দেশের প্রধান নদ-নদীসমূহের পানিবৃদ্ধি আগামী ৭২ ঘণ্টায়ও অব্যাহত থাকতে পারে। অধিকাংশ পয়েন্টেই পানি বৃদ্ধির দিকে রয়েছে। এরমধ্যে ব্রহ্মপুত্র এবং এর পাশাপাশি যমুনা নদের পানি এখন দ্রæতই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে হারে পানি বৃদ্ধি ঘটছে তাতে আগামী তিন দিনের মধ্যে উভয় নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রমের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভারতের গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, অরুণাচলসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে অব্যাহত অতি বর্ষণের কারণে উজান থেকে ঢল নামছে এবং ভাটিতে বাড়ছে পানির চাপ। সেসব অঞ্চলে অত্যধিক ভারী বর্ষণের সতর্কতা বলবৎ রয়েছে। সেই সঙ্গে মৌসুমি বায়ু জোরালো থাকায় দেশের অভ্যন্তরেও ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের কারণে নদ-নদী অববাহিকায় পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন বিভাগে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের সতর্কতা দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। এসব কারণে আগামী ৫ দিনে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির দিকেই থাকতে পারে। উজানের ঢল এবং দেশে অতি বর্ষণের কারণে তিস্তা, ধরলা, ঘাগটসহ বিভিন্ন নদী এবং ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। অবশ্য তিনি জানান, গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীতে পানি বাড়লেও তা এখনো বিপদসীমা থেকে অনেক নিচে রয়েছে।
অন্যদিকে হিমালয় পাদদেশীয় এলাকা ও গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম এবং আসাম, অরুণাচল, মেঘালয়সহ সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতে অতি বর্ষণ অব্যাহত থাকায় পাহাড়ি ঢল, বন্যার পানি ভাটির দিকে ধেয়ে আসায় নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির বর্তমান পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। কেননা বিশেষত যমুনা-ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা-পদ্মা এবং মেঘনা (সুরমা-কুশিয়ারা) এই প্রধান তিনটি ধারায় বা মূল অববাহিকার নদ-নদীসমূহের উৎসের অববাহিকা (ক্যাচমেন্ট এরিয়া) ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিশাল এলাকাজুড়ে অবস্থিত। ভৌগোলিকভাবেই ভাটির দিকে অবস্থানের প্রেক্ষপাটে বাংলাদেশের নদ-নদীর পানির উৎসের ৭০ থেকে ৯০ ভাগই হচ্ছে ভারতের উজানভাগের অববাহিকায়। ব্রহ্মপুত্র নদের ক্ষেত্রে আরেকটি উজানের উৎস হচ্ছে চীন পর্যন্ত।
সাব-হিমালয় পাদদেশীয় অঞ্চলসহ গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ এবং আসাম, অরুণাচল, মেঘালয়সহ উত্তর-পূর্ব ভারতে ভারী থেকে অত্যধিক ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় সেসব অঞ্চলে বন্যাজনিত সম্ভাব্য দুর্যোগের চূড়ান্ত সতর্কতা রেড অ্যালার্ট এবং আরও কিছু অঞ্চলে প্রস্তুতি সতর্কতা বা অরেঞ্জ অ্যালার্ট বলবৎ রাখা হয়েছে আগামী ১৫ আগস্ট মঙ্গলবার পর্যন্ত। উজানের ঢলের পানি বাংলাদেশের ভাটির দিকে নামছে। এতে চলতি সপ্তাহে বৃহত্তর সিলেটসহ বিভিন্ন অঞ্চলে নদ-নদীর পানি আরও বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা অতিক্রম এবং এক ও একাধিকবার বন্যামুক্ত না হতেই ফের বন্যা কবলিত হচ্ছে একের পর এক নতুন এলাকা। সেই সঙ্গে নদী ভাঙনের মুখোমুখি হচ্ছে বিস্তীর্ণ জনপদ।

https://www.dailyinqilab.com/article/91509/