বাবু বাজার ব্রিজে নির্মিত ডিভাইডার ভেঙে যাওয়ায় ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন : নাসিম সিকদার
১০ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:১১

বাবু বাজার ব্রিজ এখন মৃত্যুফাঁদ

ডিভাইডার করতে ১৬ শ’ পেরেক ঢুকানো হয়েছে ব্রিজে; প্রতিদিন ঘটছে দুর্ঘটনা

রাজধানীর বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতু (বাবুবাজার ব্রিজ) মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন কোনো না কোনো স্পটে দুর্ঘটনা ঘটছে। ব্রিজের মাঝখানে স্টিলের ডিভাইডার দেয়ায় শত শত অবৈধ সিএনজি উল্টো পথে চলছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির নামে লেগুনা ও মিনিবাসের স্ট্যান্ড বসানো হয়েছে ব্রিজে। এ কারণে যানজট লেগেই থাকছে। অভিযোগ রয়েছেÑ এসব পরিবহন ও সিএনজি থেকে নিয়মিত বখরা নেয় পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা।
স্থানীয় সূত্র জানায়, রাজধনীর অন্যতম বুড়িগঙ্গা দ্বিতীয় সেতু (বাবুবাজার ব্রিজ)। প্রতিদিন প্রায় এক লাখ পরিবহন চলে ওই ব্রিজের ওপর দিয়ে। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলগামী মানুষের অন্যতম রুট এই ব্রিজ। গত এক বছর ধরে যানজট লাঘবে ব্রিজের টোল আদায় বন্ধ করেছে সরকার। তারপরেও থেমে নেই যানজট। তা ছাড়া পাল্লা দিয়ে ব্রিজের ওপর দুর্ঘটনা বাড়ছে। প্রতিদিন ব্রিজের কোনো না কোনো স্পটে সিএনজির সঙ্গে ধাক্কা লেগে মোটরসাইকেল আরোহী, লেগুনা, বাস ও রিকশায় থাকা মানুষ দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে। তবে দেখেও না দেখার ভান করছে পুলিশ ও কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, রাজধানীতে ঢাকা মেট্রো থ সিরিয়ালের সিএনজি ছাড়া অন্য জেলা কিংবা সিরিয়ালের সিএনজি চলাচল নিষিদ্ধ। তার পরেও দুই ব্রিজে প্রায় ২ হাজার সিএনজি চলাচল করছে। তার মধ্যে অবৈধ ও চোরাই সিএনজিও রয়েছে। একসময় এই সিএনজি নিয়ন্ত্রণ করত বুড়িগঙ্গা প্রথম ব্রিজ টোল আদায়কারী ওয়াসিম। সারা দেশ থেকে তার নেতৃত্বে ড্রাইভারকে খুন করে চুরি হতো সিএনজি। এ সব সিএনজি চলত কেরানীগঞ্জ, পাগলা, ফতুল্লা ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায়। তবে বছর দুই আগে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ওয়াসিম। তার মরার পরপরই এটি নিয়ন্ত্রণে নেয় ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ নামধারী এক নেতা। তিনি ওই সব অপরাধ না করলেও তার একক নিয়ন্ত্রণে সিএনজি। তা ছাড়া ওই সব সিএনজি থেকে নিয়মিত বখরা নেয় পুলিশের কিছু সদস্য।
ঢাকা জেলা কেরানীগঞ্জ উপজেলার ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ সবুজ মল্লিক নয়া দিগন্তকে বলেন, কেরানীগঞ্জে রাস্তার অবস্থা খুবই বেহালদশা। তবে এসব উত্তোরণে উপজেলা চেয়ারম্যানের দিকনির্দেশনায় বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায় ৩০ ট্রাক ইট সড়কের বিভিন্ন স্পটে ফেলা হয়েছে।
তিনি বলেন, ব্রিজে কিছু সিএনজি চলাচলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের নির্দেশ রয়েছে এমন কাগজপত্র দেখালে তাদের বাধা দেয়া কিংবা আটক না করা। সরেজমিন বাবুবাজার ব্রিজ ছিদ্র করে স্টিলের পাত দিয়ে বেড়া ও লোহার খুঁটি বসিয়ে ডিভাইডার করা হয়েছে। ১২ ইঞ্চি লোহার পেরেক ব্রিজ ছিদ্র করে ঢুকানো হয়েছে। প্রতিটি খুঁটিতে চারটি করে ১৬ শ’ পেরেক ঢুকানো হয়েছে। এতে ব্রিজের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তা ছাড়া ব্রিজের দুই মাথায় ট্রাক, বাস, লেগুনা ও সিএনজির স্ট্যান্ড করা হয়েছে। ব্রিজের দক্ষিণ পাশ কেরানীগঞ্জ থেকে প্রতিদিন এক হাজার সিএনজি ব্রিজের ওপড় আপ-ডাউন করছে। ডিভাইডারের বিভিন্ন স্পটে ট্রাক দিয়ে আঘাত করায় কোনো স্পটে ব্রিজে ঢুকানো নাট থাকলেও নেই খুঁটি। এ ছাড়া মাঝখান দিয়ে বেড়া (ডিভাইডার) কেটে উল্টো দিক দিয়ে নয়াবাজার গোড়ায় স্ট্যান্ড করে যাত্রী পারাপার করা হয়। উল্টো পথে চলা অবৈধ সিএনজিগুলো রুখতে পারছে না পুলিশ। ফলে প্রতিদিন বাড়ছে দুর্ঘটনা।
স্থানীয় সূত্র জানায়, সিএনজি লেগুনা ও বাস থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে ইকবাল, সালাম, পিন্টু ও মুরাদ। তারা ট্রাফিক পুলিশ ও স্থানীয় নেতাদের নামে আদায় করে। সিএনজিপ্রতি ৩০ ও লেগুনা থেকে প্রতিদিন ৫০ করে আদায় করে। এমনকি ব্রিজে ওপর দিয়ে চলাচলরত বাস থেকেও নিয়মিত বখরা নেন পুলিশ বলে জানান ড্রাইভারেরা।
গাঙচিল পরিবহন কোম্পানির চালক জুম্মন এ প্রতিবেদককে জানান, বাবুবাজার ব্রিজের কাছে এলে জ্যাম যেমনি আতঙ্ক, তেমনি সিএনজি ও লেগুনা স্টাফদের ভয়ে এত বড় গাড়ির চালক হয়েও কিছু করতে পারি না। তারা ব্রিজে এসব গাড়ি আটকিয়ে যানজট সৃষ্টি করে যাত্রী ওঠানামা করায়। প্রতিবাদ করলে কেরনীগঞ্জ পৌঁছামাত্র তারা গাড়ির গ্লাস ভাঙচুর ছাড়াও আমাদের মেরে রক্তাক্ত করে। তা ছাড়া গত ৩ আগস্ট নয়াবাজার ব্রিজের গোড়ায় মাওয়া-গুলিস্তান রুটের একটি বাস এক বৃদ্ধাকে ধাক্কা দেয়। ঢাকা জ-১১-৫৫৪ নামের গাড়িটি পুড়িয়ে দেন উৎসুক জনতা।
বাসের মালিক সোহেল এ প্রতিবেদককে জানান, তার একটি মাত্র বাস। এটাই তার সম্বল। এ দিয়ে ছেলেমেয়ের স্কুলের খরচ ছাড়া বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখতে হয়। গত ৩ আগস্ট বাবুবাজার ব্রিজের ওপর গাড়িটা পুড়িয়ে দেয় কে বা কারা। তবে এ ঘটনায় উল্টো আমাকে খুঁজছে পুলিশ। কোন লোকটা আহত হলো তা কেউ হদিস দিতে পারছে না। এটাই আমার দেশের বিচার বলে আক্ষেপ করেন তিনি। এ দিকে প্রতিদিন ব্রিজের কোনো না কোনো স্পটে সিএনজি কিংবা লেগুনার সঙ্গে মোটরসাইকেল ছাড়াও বিভিন্ন গাড়ির ঠোকাঠুকির ঘটনা ঘটে। গত ৩০ জুলাই সন্ধ্যায় উল্টো পথ দিয়ে নয়াবাজারের দিকে যাচ্ছিল সিএনজি। হঠাৎ পথিমধ্যে মোটরসাইকেল আরোহী কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা আমিনুল ইসলামের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তার পা ভেঙে যায়। তবে সিএনজিটি আটক করতে পারেনি পুলিশ। এমন ঘটনা এখন ঘটছে নিত্য। দুই পাড়ের ট্রাফিক পুলিশ দেখেও না দেখার ভান করছে।
ডিএমপি ট্রাফিক দক্ষিণ ডিসি রিফাত রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, বাবুবাজার ব্রিজ যানজট মুক্ত রাখতে কাজ করছে ট্রাফিক পুলিশ। প্রতিদিন আটক করা হচ্ছে অবৈধভাবে ডিএমপিতে চলাচলরত সিএনজি। তার পরও রোধ করা যাচ্ছে না। তা ছাড়া কেরানীগঞ্জে যারা ট্রাফিক বিভাগে আছেন, তারা যদি গুরুত্ব দেয় তাহলে ওইসব সিএনজি এই পাড়ে আসতে পারে না। তিনি বলেন, ট্রাফিক পুলিশের নামে চাঁদা ওঠানো হচ্ছে এমন কথা ঠিক নয়। তার পরেও যদি কোনো ট্রাফিকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ মিলে তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/242845