২ আগস্ট ২০১৭, বুধবার, ৯:৪৬

রাজধানীর সড়কে ভোগান্তি

খানাখন্দকে বেহাল অবস্থা রাজধানীর প্রায় সব সড়কেরই। এর মধ্যে দুয়েকটি দিয়ে কোন রকম চলাফেরা করা গেলেও অনেক রাস্তাই এখন চলাচলের অনুপযুক্ত। সামান্য বৃষ্টিতেই সড়কগুলোতে কাদা আর পানি মিলে একাকার হয়ে যায়। এতে বুঝার কোন উপায় থাকে না কোথায় খানখন্দক আর কোথায় সমতল। এ অবস্থায় চলাচল করতে প্রতিনিয়তই সড়কে ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে গাবতলী দিয়ে ঢাকায় প্রবেশের প্রধান সড়কটি এখন চলাচলের প্রায় আযোগ্যই বলা চলে। গাবতলী ব্রীজ থেকে শ্যামলী পর্যন্ত পুরোটা পথেই বড় বড় গর্ত হয়ে আছে। দারুস সালাম মসজিদের সামনে, টেকনিক্যাল মোড়ের কাছে, মাজার রোড ও গাবতলী সেতুর মুখে সড়কের দুই দিকেই বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়ে আছে। কোথাও মাটি কেটে গর্ত করে রাখা হয়েছে, কিছু স্থানে গর্ত ভরাট হলেও তা এখন আগের অবস্থানে যায়নি। আর পুরো পথেই সড়কে পানি, কাদামাটি ও নির্মাণসামগ্রী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।
এ সড়কটি দিয়ে সিটি পরিবহনসহ প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকা শহরে প্রবেশ করে। ভাঙ্গাচুরা এ সড়কটি দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে প্রতিদিনই কোন না কোন যানবাহন বিকল হয়ে পড়ছে। ঘটছে ছোট বড় দুর্ঘটনা। ধীর গতিতে চলতে গিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাত্রীদেরকে রাস্তায় পড়ে পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ। নষ্ট হচ্ছে মানুষের হাজার হাজার কর্মঘণ্টা।
গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, সকাল ১০টার দিকে সাভারের হেমায়েতপুর থেকে রাজধানীর কল্যাণপুর পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটারজুড়ে যানজট সৃষ্টি হয়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জুনায়েদুর রহমান বলেন, সাভার বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে চেপে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতে আগে যেখানে দেড় ঘণ্টা সময় লাগতো এখন সেখানে তার পাঁচ ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশন যদি এখনি এ সড়কটি মেরামতের উদ্যোগ না নেয় তাহলে এটি দিয়ে আর যানবাহন চলাচলের উপায় থাকবে না। গাবতলী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ঢাকামুখী যানবাহনগুলো গাবতলী সেতু থেকে নেমেই বড় গর্তের কারণে আটকে যাচ্ছে। একই অবস্থা মাজার রোডেও। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোশেনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মেসবাহুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, এ রাস্তাটির ব্যপারে আমরা অবগত আছি। তিনি বলেন, আমি গতকালই খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এ রাস্তাটির নিয়মিত মেরামতের কাজ এগিয়ে চলছে। এই কর্মকর্তা বলেন, যারা এ রাস্তাটির মেরামতের কাজ করছেন তারা আমাকে জানিয়েছেন যে, বৃষ্টির কারণে তারা নিয়মিত কাজ করতে পারছে না। তবে অল্পদিনের মধ্যে এ সড়কটির মেরামতের কাজ শেষ করা হবে বলে তিনি জানান। আবার দু’য়েকদিন বৃষ্টি না হলে কিংবা রোদ উঠলেই বাতাসে ধুলা-বালি উড়ে চোখ-মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়া অবস্থা হচ্ছে। নিশ্বাসের সাথে ধুলা-বালি নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট ও এজমাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী।
এদিকে শুষ্ক মৌসুমে রাজধানীর উন্নয়ন কাজের জন্য বিভিন্ন সেবদানকারী সংস্থাকে রাস্তা কাটার সীমিত পরিসরে অনুমোদন দেয়ার কথা থাকলেও এ জন্য রয়েছে কঠোর নিয়ম নীতি। এ নিয়ম নীতি তদারকি করার মূল দায়িত্বে রয়েছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। গত কয়েকদিন ধরে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকার চলমান উন্নয়ন কাজ সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, উন্নয়ন কাজের নেই কোন সুনির্দিষ্ট তদারকি। যে কারণে নগরবাসী পড়েছে চরম দুর্ভোগে।
রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন সড়ক ও অলি-গলিতে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। এছাড়ও ভাঙাচুরা রাস্তা মেরামতের কাজ করছে সিটি কর্পোরেশন। যে কারণে রাজধানীর প্রায় সবগুলো রাস্তাই এখন খোঁড়াখুঁড়ির কবলে পড়েছে। প্রতি বছর ৩১ মে’র মধ্যে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শেষ করার নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর কার্যলয় থেকে থাকলেও তা কেউ মানেনি। কারণ এ বছর ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনই বিভিন্ন সড়ক মেরামত ও উন্নয়ন স্স্থংাগুলো তাদের নিয়মিত রাস্তা কাটার কাজ ধরেছে।
এদিকে অতিগুরুত্বপূর্ণ কোন কারণ ছাড়া বর্ষা মৌসুমে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির অনুমোদন না দেয়ার জন্যও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা দেয়া আছে। এছাড়া সরকারী নিয়ম অনুযায়ী ২৮দিনের মধ্যে উন্নয়ন কাজ শেষ করে পূনরায় রাস্তা মেরামত করেদেয়ার কথা থাকলেও উন্নয়ন কাজ শেষে মাসের পর মাস রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা বেহাল অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা কর্মীরা এ সমস্ত উন্নয়ন কাজের ঠিকাদারি করে থাকেন। তাদের খেয়াল খুশি মতোই এ কাজগুলো শুরু ও শেষ হয়। বিষয়টি এমন হয়ে গেছে যে, তারা সরকারী নিয়ম-নীতি না মানলেও চলে। এ নিয়ে প্রতিবাদ করা সাহস আছে কার! আবার যদিও কেউ ভুল করে প্রতিবাদ করে ফেলে তিনি নিজ দায়িত্বেই নাজেহাল হতে হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন ইনকিলাবকে বলেন, নগরবাসীর নাগরীক সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেইতো সিটি কর্পোরেশনকে এ উন্নয়নমূলক কাজ করতে হচ্ছে। এধরণের কাজ করতে গেলে কিছু সমস্যাতো হতেই পারে। এ জন্য নগরবাসীকেও কিছুটা ভোগান্তি সহ্য করতে হবে। উন্নয়ন কাজ চলা সময়ের ভোগান্তির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে মেয়র নগরবাসীর সহযোগিতা কামনা করেন। রাজধানীল বিভিন্ন সড়ক ঘুরে সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সুনির্দিষ্ট কিছু ভিআইপি সড়ক ছাড়া প্রায় সব সড়কেরই বেহাল দশা। দুই সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন সড়কগুলোর মধ্যে অর্ধেকের বেশি সড়কের অবস্থাই বেহাল। বিভিন্ন কারণে ভিআইপি সড়কগুলোর নিয়মিত সংস্কার কাজ করা হয়ে থাকে। এর বাইরের মূল রাস্তা ও তার আশপাশের অলিগলির অনেক রাস্তাই ভাঙাচোরা। প্রায় প্রতিটি সড়কেই ছোট-বড় অসংখ্য গর্ত সৃষ্টি হয়ে আছে। রাস্তার অবস্থা বেহাল হওয়ায় অফিস শুরু ও ছুটির সময় প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলি-গলি পর্যন্ত লেগে থাকছে দীর্ঘ যানজট। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রেকৌশলী মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, ভাঙ্গাচুরা সড়ক মেরামতের নিয়মিত কাজ চলছে। বৃষ্টির জন্য নিয়মিত কাজ করতে একটু সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে মৌচাক-মগবাজার উড়াল সড়কের নির্মাণকাজ চলায় সড়কগুলো এমনিতেই সরু হয়ে আছে। এতে রাস্তায় যানজট লেগেই থাকে। তার ওপর নতুন করে ওয়াসা ও ডিপিডিসিসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ভূগর্ভস্থ লাইন স্থাপনের কাজ শুরু করায় মানুষের ভোগান্তি আরও বেড়েছে। তারা বলেন, সরকারি সংস্থাগুলো জনগণের ভোগান্তির বিষয়টি চিন্তা না করেই নিজেদের খেয়ালখুশিমতো খোঁড়াখুঁড়ি করছে, আবার নির্মাণকাজ সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি সড়ক ও ফুটপাতের ওপর ফেলে রাখায় চলাচলের পথ সরু হয়ে আছে। এতে নির্মাণকাজ চলা কোনো কোনো এলাকার মানুষ যানবাহন ছেড়ে হেঁটেই কর্মস্থলে যাতায়াত করছেন। রামপুরার বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, মগবাজার-মৌচাক সড়কে ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ চলছে অনেক দিন ধরে। এ কারণে রামপুরা থেকে শান্তিনগর পর্যন্ত তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। অনেক সময় বাস থেকে নেমে হেঁটে অফিসে যেতে হয়। তিন বছর ধরে এই সড়কে চলাচল করতে গিয়ে নানা ঝক্কিঝামেলা পোহাচ্ছি। এখন শুরু হয়েছে সড়ক খুঁড়ে বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন। ব্যস্ততম সড়কে দিনের বেলায় খোঁড়াখুঁড়ি করা নিষেধ থাকলেও এসব কেউ মানছে না। এই খোঁড়াখুঁড়ি করে যেসব মাটি, ইট ও পাথর তোলা হয়, সেগুলো এবং খোঁড়াখুঁড়ির কাজে যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়, সেগুলো এলোমেলোভাবে ফেলে রাখা হয় ফুটপাতসহ সড়কের ওপর। ফলে রাস্তা বা ফুটপাত- কোথা দিয়েও হাঁটার পথ থাকে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উন্নয়নের খোঁড়াখুঁড়িতে অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে মিরপুর ১২ নম্বও সেকশন থেকে ১১ নম্বও সেকশন পর্যন্ত সড়ক। এ সড়ক দিয়ে যাতায়াকারী মানুষের ভোগান্তি এখন চরমে। আবার ব্যস্ততম এ প্রধান সড়ক বাদ দিয়ে অলি-গলি দিয়ে যাতায়াতের কোনো ব্যবস্থাও নেই। সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি না থাকলেও দীর্ঘ সময় মেরামত না করায় চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। মিরপুর ১০ নম্বর বেনারসী পল্লীর কয়েকটি সড়কও বেহাল অবস্থায় রয়েছে। একই অবস্থা ৬ ও ৭ নম্বর সেকশনের। সেখানে বেশ কয়েকটি গলির রাস্তা ভেঙে আছে। মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের বেশকিছু গলির সড়কের অবস্থা নাজুক। স্থানীয় বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন জানান, মিরপুর-১০ ও বেনারসী পল্লীসহ এ এলাকার রাস্তাগুলোর সমস্যা অনেক পুরনো। মাঝেমাঝে সিটি কর্পোরেশনের লোকজন এসে কাজ করলেও কয়েকদিন পর আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। এছাড়া বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। এছাড়া রাজধানীর মগবাজার, সেগুনবাগিচা, কামরাঙ্গীরচর, নন্দীপাড়া, বাসাবো, মাদারটেক, মানিকনগর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, শ্যামপুর, গেন্ডারিয়া, পোস্তগোলা, লালবাগ, সূত্রাপুর, কোতোয়ালি, ওয়ারী, চকবাজার, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, মিরপুর, কাফরুল, দক্ষিণখান এলাকাগুলোতেও বেশকিছু সড়কের বেহাল দশা।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান সৈয়দ কুদরাতুল্লাহ বলেন, বিশেষ প্রয়োজনে সড়ক খননের অনুমোদন দেয় ওয়ানস্টপ সেল থেকে। তবে সেল থেকে এই দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়, খননের কারণে যেন জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না হয়।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/90027/