১ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:২৫

জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সার্ভে রিপোর্ট

সবজিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক

তেল-ঘিয়ে ভেজাল * সেমাইয়ে বেশি আর্দ্রতা * কিডনি, লিভার অকার্যকরের পাশাপাশি ক্যান্সারের ঝুঁকি * বেশি হুমকিতে শিশু

দেশের বিভিন্ন বাজার থেকে সবজি নিয়ে পরীক্ষা করে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। পরীক্ষায় সরিষা ও সয়াবিন তেল এবং ঘিয়ে মিলেছে ভেজাল। এছাড়া ১৫টি লাচ্ছা সেমাইয়ের মধ্যে ১০টিতেই পাওয়া গেছে বেশি আর্দ্রতা। জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট এ পরীক্ষা চালায়।


জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, ফসলে বা সবজিতে কীটনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয় এ ধরনের রাসায়নিক অর্গানিক কমপাউন্ড। আর যে কোনো অর্গানিক কমপাউন্ডেরই নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত মাত্রা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এক্ষেত্রে রাসায়নিক ব্যবহারের মাত্রা যত বাড়বে, ক্ষতির পরিমাণও তত বেশি হবে। এ কীটনাশক মানবদেহের কিডনি, লিভার অকার্যকর করে দেয়ার পাশাপাশি স্নায়োবিক দুর্বলতা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া খাবারে আর্দ্রতা নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে কম বা বেশি হলে তাতে ফাঙ্গাস পড়ে। ফলে খাবারে নানা ধরনের জীবাণুর আক্রমণ ঘটতে পারে।

জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি ‘মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন অব হর্টিকালচার প্রডাক্টস অ্যান্ড আদার ফুড কমোডিটিস অব কেমিক্যাল কন্টামিনাশন অ্যান্ড অ্যাট এনএএসএল : এন এপ্রিসাল অব ফুড সেফটি সার্ভে ইন বাংলাদেশ সেকেন্ড রাউন্ড’ শীর্ষক সার্ভের আওতায় ২০১৬-১৭ সময়ে সবজিসহ বিভিন্ন খাবারের ৪৬৫টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরে এসব নমুনার পেস্টিসাইড, রং, আফলা টক্সিনের উপস্থিতি এবং মাইক্রোবায়োলজিক্যাল পরীক্ষা করা হয়।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে পরিচালিত সার্ভে কার্যক্রমে ৩৮টি ঘি পরীক্ষা করা হয়। যার মধ্যে ২৭টিতে বিআর, ১৭টিতে সাবানিমান এবং ২০টিতে আর্দ্রতার মানের তারতম্য রয়েছে। ৩১টি সরিষার তেলের মধ্যে ১৮টিতে সাবানিমান, ২৭টিতে মুক্ত এসিড, ১২টিতে আয়োডিনের মান এবং ৮টিতে আয়রনের মানের তারতম্য পাওয়া গেছে। এছাড়া ২৭টি সয়াবিন তেলের মধ্যে ১৭টিতে বিআর, ১৩টিতে সাবানিমান এবং ১২টিতে আয়োডিনের তারতম্য পাওয়া গেছে।

এ সময় পাঁচটি জেলা শহর এবং রাজধানী ঢাকার পাইকারি ও খুচরা বাজার থেকে টমেটো, বেগুন, ফুলকপি, শিম, কাঁচা মরিচ, নুডলস ও সেমাই পরীক্ষা করা হয়। সংগৃহীত ৩০টি টমেটোর নমুনা পরীক্ষা করে ২টিতে স্বাভাবিক মাত্রার দ্বিগুণের বেশি ক্ষতিকর ক্লোরোপাইরিফস কীটনাশক পাওয়া গেছে। ৩০টি বেগুনের নমুনা পরীক্ষা করে একটিতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার বেশি ডাইমেথয়েট কীটনাশক পাওয়া গেছে। ৩০টি ফুলকপির নমুনায় ১২টিতে ক্লোরোপাইরিফস পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ২টি অতিরিক্ত মাত্রায় বিদ্যমান। ৩০টি শিমের নমুনায় ১৫টিতে ক্লোরোপাইরিফস পাওয়া গেছে। এছাড়া কাঁচা মরিচের ১৫টিতে ক্লোরোপাইরিফস বেশি মাত্রায় পাওয়া গেছে।

নুডলস ও সেমাই বর্তমানে নগরবাসীর দৈনন্দিন খাদ্য তালিকার অংশ হিসেবে পরিণত হয়েছে। ৫৫টি ব্র্যান্ডের নুডলসের নমুনা পরীক্ষায় ১৩টিতেই নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে কম পরিমাণে প্রোটিন পাওয়া গেছে। সবকটিতেই সিসার উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। তাবে তা সহনীয় মাত্রার চেয়ে কম। অন্যদিকে সার্ভেতে ১৫টি সাধারণ ও ১৫টি লাচ্ছা সেমাই পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১টি সাধারণ সেমাই এবং ১০টি ব্র্যান্ডের লাচ্ছা সেমাইয়ে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণ আর্দ্রতা পাওয়া গেছে।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. একেএম শামসুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘খাবারে অধিক আর্দ্রতার কারণে এক ধরনের ফাঙ্গাস সৃষ্টি হয়। ‘এসপারজাইলাস ফ্লেভাস’ নামক এ ফাঙ্গাস খাবারে আফলাটক্সিন নামক বিষাক্ত পদার্থ নিঃসরণ করে। এসব খাবার খেলে মানুষের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এছাড়া আর্দ্রতায় এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ ঘটে। এসব ব্যাকটেরিয়া খাবারে ‘বেসিলাস সিরিয়াস’ তৈরি করে, যা মূলত এক ধরনের সাইটোটক্সিন। এ ধরনের সাইটোটক্সিন খাদ্যে বিষক্রিয়া ঘটিয়ে মারাত্মক আমাশয় ঘটায়।’ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পোকা-মাকড়ের কবল থেকে সবজি রক্ষার্থে কৃষক অবাধে ক্ষেতে কীটনাশক স্প্রে করেন। রকমারি কীটনাশক প্রয়োগের ক্ষেত্রে তারা কোনো নিয়মনীতিই মানছেন না। অথচ এসব কীটনাশক জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বিশেষ করে এ কীটনাশক শিশুর জন্য হুমকি। পোকা-মাকড়ের কবল থেকে শাকসবজি রক্ষা করতে তারা ক্ষেতে অবাধে কীটনাশক স্প্রে করে সেই দিন অথবা পরদিন বাজারজাত করছেন। এসব শাকসবজি নিয়মিত খেলে মানব শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

 

মানবদেহে কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাবেক পরিচালক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘উল্লিখিত কীটনাশকগুলো মানবদেহের জন্য যে মারাত্মক ক্ষতিকর, তা প্রমাণিত। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকযুক্ত এসব সবজি শিশুর পেটে গেলে ক্ষেত্রবিশেষ মৃত্যু হতে পারে। এর আগে এ ধরনের কীটনাশকযুক্ত লিচু খেয়ে কয়েক শিশুর মৃত্যু হয়েছে, যা পরে পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমাদের দেশে সবজি পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে খাওয়া হয়, তাই ক্ষতির মাত্রা কিছুটা হ্রাস পায়। তবে ধোয়ার পর এসব কীটনাশক স্লো-পয়জন হিসেবে শরীরে কাজ করে। বিশেষ করে এ ধরনের কীটনাশক মানুষের স্নায়ুকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে দেয়। এছাড়া কিডনি ও লিভারকেও সরসরি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এমনকি এসব অঙ্গ স্থায়ীভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/08/01/144429/