৩১ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১২:০৬

প্রিয় পরিভাষার প্রতি অহেতুক এলার্জি

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী

এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম। এদের ভাষা, মুখের বুলি, আচার-আচরণ, চাল-চলন অসভ্য তথা পিছিয়ে পড়া মানুষের মতো নয়। মুসলিম পুরুষেরা যেমন সুন্দর ও শালীন পোশাক-আশাকে অভ্যস্ত, তেমনই মুসলিম নারীদের পোশাকও অন্যদের থেকে পৃথক। অমুসলিম তথা হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান ও উপজাতীয়দের পোশাকের সঙ্গে মুসলিমদের পোশাকের সাধারণত মিল থাকবার কথা নয়। না থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে বাঙালি মুসলিম ও অমুসলিমের পোশাক প্রায় এক হলেও কিছুতো ফারাক রয়েছেই। এছাড়া পোশাকের পাক-পবিত্রতার ক্ষেত্রেও মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে কিছু ফারাক থাকে।
অপবিত্র পোশাক পরে মুসলিমরা সালাত আদায় করতে পারেন না। অমুসলিমদের পোশাকে পবিত্রতার বিষয় থাকলেও তা মুসলিমদের মতো নয়। জ্ঞান-গরিমা, সভ্যতা ও ভব্যতায় অন্যদের চেয়ে অনেক অগ্রসর মুসলিমরা। তাই তাদের পোশাক-পরিচ্ছদেও সচেতনতা লক্ষণীয়। কিন্তু ভারতীয় ধর্মবিশ্বাসীদের অনেককে বিবস্ত্র থাকতেও দেখা যায়। অনেকেই প্রয়াগে প্রতি ৪ বছর পরপর অনুষ্ঠিত কুম্ভমেলার নাম শুনেছেন। দেখেছেনও হয়তো। লাখ লাখ সন্ন্যাসী সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে গঙ্গা-যমুনার সঙ্গমস্থলে স্নান করে। আর তা পৃথিবীবাসী প্রত্যক্ষ করে। ন্যাংটা সন্ন্যাসীরা সবকিছু দেখিয়ে দেয় নির্লজ্জভাবে। কেউ কেউ এই ন্যাংটোদের দেবতাও ভেবে বসেন। এমন সর্বাঙ্গ প্রদর্শন যদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান বলে গণ্য হয় তাহলে সে ধর্মের মর্মবাণী কী হতে পারে ভেবেছেন কেউ কখনও? অবশ্য যে বিশ্বাসবোধে ন্যাংটোমো আর দেব-দেবীদের অলীক কল্পকাহিনীর বিপুল ব্যাপকতা বিদ্যমান তা কোনও সচেতন মানুষের কাছে গ্রহণীয় আদর্শ হতে পারে বলে মনে হয় না। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলেও সত্য যে, এমন অনাকাক্সিক্ষত ন্যাংটোপনাসহ নানা বিষয়কে বাঙালি সংস্কৃতি বলে তুলে ধরবার চেষ্টা করা হচ্ছে। শুধু কি তাই? এমন জঙ্গলি বিশ্বাসবোধই নাকি সর্বজনীন বাঙালি সংস্কৃতি।
একটি বিষয় হয়তো অনেকের মনে নেই। আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই একটি গোষ্ঠী মুসলিমদের নামের আগে ‘মুহাম্মদ’ (সংক্ষেপে মো:) লেখা পছন্দ করতো না। তাই তারা ‘মুহাম্মদ’ এর উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে দেয়। মুসলিমদের নামের আগে ‘শ্রী’ লেখা শুরু করে। আত্মঘাতী মুসলিমরাও কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে নিজের নামের শ্রীবর্ধনে তৎপর হয়ে ওঠেন। সৌভাগ্যবশত বিষয়টি মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশের গোচরীভূত হয়। সেসময় ‘বজ্রকণ্ঠ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বেরুতো। মুসলিমদের নামের শ্রীবর্ধনের প্রতিবাদ করে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট ছাপা হয় বজ্রকণ্ঠে। হেডিং ছিল ‘শ্রী তুমি ভারতেই থাকো’। পত্রিকাটির সেসময় জনপ্রিয়তা ছিল। এ রিপোর্টের ফলে অনেকের সম্বিত ফেরে। মুসলিমদের নামের আগে মুহাম্মদের পরিবর্তে শ্রী লিখবার বাতিক উবে যায়।
উল্লেখ্য, সেসময় মুসলিমদের নামের আগে যুক্ত ‘মুহম্মদ’ এর উচ্ছেদ অভিযান সম্পন্ন করে শ্রীবর্ধনে যারা তৎপর ছিলেন তারাই নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে মুসলিম ঐতিহ্যের ধারক-বাহক চিহ্নসমূহ মুচ্ছে ফেলতে আবারও সচেষ্ট। এখনই সতর্ক না হলে মরণ ছোবল মারতে কিন্তু পিছপা হবে না আগামিতে এরা।
ইসলামবিদ্বেষী ও তাদের এদেশীয় চামচারা খুব কৌশলে অগ্রসর হয়ে শেকড় গেড়ে বসছে। জাতীয় শিক্ষা কারিকুলাম বোর্ড, বাংলা একাডেমি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও কালচারাল সংস্থাগুলোতে এরাই প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। এমনকি জাতীয় পত্রপত্রিকা, রেডিও এবং টিভি চ্যানেলেও এদের প্রভাব প্রবল। এরা নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করছে। বলতে পারেন, ইসলাম ও মুসলিমদের শেকড় উপড়ে ফেলতে নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে। মাঝেমধ্যে পর্দার সামনে এসে মুসলিমদের নাড়ি টেস্ট করে দেখে। সুযোগ পেলেই স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে ফাইনাল খেলা দেখিয়ে যাবে।
‘আল্লাহ’ শব্দটিকে ভুলিয়ে দেবার জন্য ওরা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। তারা পাঠ্যবইয়ে আল্লাহ্ শব্দ বাদ দিয়ে স্রষ্টা, সৃষ্টিকর্তা, প্রভু, বিধাতা প্রভৃতি শব্দমালা বসিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র অনেকদিন থেকেই করে আসছিল। তাদের যুক্তি হলো: বাংলা আমাদের সমৃদ্ধ ভাষা। স্রষ্টার বহু প্রতিশব্দ থাকতে আমরা বিদেশি ভাষা আরবি কেন ব্যবহার করবো? তাদের এ যুক্তি অনেক সরল বুদ্ধির মানুষ সহজে গ্রহণ করেও ফেলেছেন। এর মধ্যে যে সুগভীর ষড়যন্ত্র কাজ করছে, তা এসব সরলসোজা মুসলিমদের কে বোঝাবে? আপাত দৃষ্টিতে ওদের কথা যৌক্তিক মনে হলেও গভীরে গিয়ে ভাবলে ষড়যন্ত্রের ভয়াবহতা স্পষ্ট হবে সহজেই।
‘আল্লাহ’ হচ্ছে রাব্বুল আল আমিনের জাতনাম। এর কোনও অনুবাদ বা তরজমা হয় না। স্রষ্টা, সৃষ্টিকর্তা, প্রভু, বিধাতা, গড, ঈশ্বর, ভগবান, ক্রিয়েটর এমনতর কোনও শব্দই আল্লাহ্র সমান নয়। আল্লাহ্ আল্লাহ্ই। এর কোনও প্রতিশব্দ নেই। হয় না। আল্লাহ্ সবভাষাতেই আল্লাহ্। এর লিঙ্গান্তর বা লিঙ্গভেদ নেই।
উল্লেখ্য, সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকত্রী, ভগবানের ভগবতী, ঈশ্বরের ঈশ্বরী, বিধাতার বিধাত্রী, গডের গডেজ আছে। কিন্তু আল্লাহর এমন লিঙ্গান্তর নেই। আল্লাহ্ শব্দটি এমনই এবসুলিউট বা নিরঙ্কুশ যে এর কোনও পরিবর্তন, পরিবর্ধন নেই। এছাড়া আরবি আল্লাহ্ শব্দের ‘আলিফ’ বর্ণটি ওহাদানিয়াত বা একত্ববাদের প্রতীক। আল্লাহ্র প্রথম অক্ষর আলিফ বাদ দিলে হয় লিল্লাহ্, দ্বিতীয় অক্ষর লাম বাদ দিলে হয় লাহু এবং তৃতীয় অক্ষর লাম তুলে দিলে থাকে হু। আল্লাহ্ শব্দের প্রতিটি বিচ্ছিন্ন অক্ষর বা হরফ দ্বারাও মহান আল্লাহকে নির্দেশ করে। তাই ‘আল্লাহ’ এমনই একটি নিরবচ্ছিন্ন ও নিরঙ্কুশ শব্দ যার ক্ষয় নেই। ব্যয় নেই। চিরস্থির, চিরস্থায়ী। অক্ষয় ও অব্যয় বলতে যা বোঝায়। কিন্তু আর কোনও শব্দ এমন নিরঙ্কুশ ও নিরবচ্ছিন্ন নয়।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, একশ্রেণির বুদ্ধির জীব (বুদ্ধিজীবী) আল্লাহ, রসূল, ইবাদত, বন্দিগী, সালাত, সিয়াম, সালাম প্রভৃতি শব্দ মুখে উচ্চারণ করতে ভীষণভাবে আড়ষ্ট হয়ে পড়েন। লজ্জিত হন। এসব শব্দ বা পরিভাষা তাদের মুখে উচ্চারিত হলে বা শোনা গেলে তারা মৌলবাদী বলে চিহ্নিত হয়ে যেতে পারেন। একই কারণে অনেক অনুষ্ঠানে সালাম-কালাম উঠে যেতে শুরু করেছে। এই বুদ্ধির জীবসমূহ আল্লাহ্ শব্দকেও সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, যুদ্ধাপরাধী ইত্যাদি ভাবতে শুরু করেছেন। তাই তারা আল্লাহ্কে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করে তদস্থলে স্রষ্টা, সৃষ্টিকর্তা, প্রভু, বিধাতা, ঈশ্বর প্রভৃতি বসাতে বিশেষভাবে তৎপর। আল্লাহ, রসূল, পয়গম্বর, ইবাদত, রহমত প্রভৃতি শব্দমালায় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের উৎকট দুর্গন্ধ আবিষ্কার করছেন। তাই তারা আল্লাহ্, রহমত, বরকত, নাজাত প্রভৃতি মৌলবাদী শব্দ থেকে সহস্র মাইল দূরে থেকে পূতপবিত্র থাকতে সচেষ্ট।
আর একটি কথা আমাদের বুদ্ধির জীবদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, এদেশের সাধারণ মানুষের হৃদয়ে এমন কিছু শব্দ গেঁথে আছে যা কেউ মুছে ফেলবার হাজার চেষ্টা করলেও তা সম্ভব নয়। আর আল্লাহ্, রসূল, রহমত, বরকত, মাগফিরাত, সহি-সালামত, কুদরত, মসজিদ, ঈদগাহ এমন শব্দ বাংলাভাষী মুসলিমদের কাছে বিদেশি নয়। এগুলো হাজার বছর ধরে এদেশবাসীর নিজস্ব ভাষা হয়ে আছে। বুকে হাত রেখে বলুনতো এসব শব্দের অর্থ কেউ বোঝে না এমন কেউ এদেশে আছে কি? অথচ এগুলো খাঁটি বাংলাভাষার শব্দ নয়। এগুলোর বেশির ভাগই আরবি। দুয়েকটা ফারসিও। কিন্তু এদেশের অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষও এগুলো বোঝেন। বুঝতে চান না কেবল আধুনিক তথাকথিত বুদ্ধির জীবেরা। তারা বলেন, এগুলো ‘বিদেশি শব্দ’।
আল্লাহ্ শব্দটি পৃথিবীর সবভাষাতেই আল্লাহ্। এর কোনও অনুবাদ নেই। হয়ও না। যারা আল্লাহ্র অনুবাদ করে তারা জ্ঞানপাপী। ষড়যন্ত্রকারী। উদ্দেশ্যমূলকভাবে তারা আল্লাহ্ শব্দের ভাষান্তর করতে চান। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, বায়তুল্লাহ্ তথা কা'বা শরিফ থেকে টেলিভিশনে পবিত্র কুরআন এবং মসজিদে নববী থেকে হাদিস শরীফের অনুবাদ সম্প্রচারের সময় আল্লাহ্র অনুবাদ করা হয় ‘গড’ যা সঠিক নয়। এমন অবিবেচনাপ্রসূত কর্ম ভবিষ্যতে মুসলিম মিল্লাতের জন্য আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়াতে পারে।
‘আল্লাহু আকবার’। এর অর্থ ‘আল্লাহ সবার বড়’। এটাই হচ্ছে ওদের আপত্তির মূল কারণ। আল্লাহ্কে বড় স্বীকার করে নিলে যে আর কিছু থাকে না। প্রভু, স্রষ্টা, সৃষ্টিকর্তা, বিধাতা সবই শেষ হয়ে যায়। তারা বলতে যান, সব প্রভু আর আল্লাহ্ সমান। কিন্তু আল্লাহ্র সমকক্ষ যে আর কোনওকিছু নেই এটাই কেউ মানতে চান না। সমস্যার সূচনাতো এখানেই। উল্লেখ্য, আল্লাহ্, রসূল, রহমত, বরকত, সালাম, কালাম এসব শব্দ আমদের প্রিয় পরিভাষা। এ পরিভাষা যারা ভুলিয়ে দিতে চান তারা আমাদের বন্ধু নন।
দেশ-বিদেশের বিরাট বিরাট ডিগ্রিধারী বুদ্ধির জীবেরা যখন আল্লাহ্, রসূল, রহমত, বরকত প্রভৃতি মুসলিমদের ব্যবহৃত প্রিয় শব্দমালা উচ্চারণে আড়ষ্টতা বোধ করেন, তখন চয়ন রহমানের মতো টিভি রিপোর্টারের দোষ দিয়ে কী হবে? তিনিতো ওস্তাদের শেখানো বুলিই আওড়াবেন। এর বাইরে যাবার অধিকার কি তার আছে? নেই। তবে চয়নের সঙ্গে ‘রহমান’ এটা বড় বেখাপ্পা। এ রহমানও কিন্তু আল্লাহ্র নাম। তাই এ লেজটুকু ফেলে দিলেই তার ‘আধুুনিক প্রগতিশীল’ নামটি সর্বাঙ্গসুন্দর হয়ে যায় এবং এলার্জিক সংক্রমণের কোনও আশঙ্কা থাকে না।

http://www.dailysangram.com/post/294080-