১৬ জুলাই ২০১৭, রবিবার, ৭:৪৯

আটা-ময়দার মূল্য আকাশছোঁয়া

চট্টগ্রাম বন্দরে অব্যাহত খালাস কোথাও ঘাটতি নেই : আন্তর্জাতিক দরের তুলনায় অযৌক্তিক চড়া : বেকারী খাদ্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী: স্বাস্থ্য সচেতনতায় খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন

দেশে সাধারণত গমের ঘাটতি হয় না। গত একনাগাড়ে প্রায় ৫ বছর ধরে চাহিদার বিপরীতে আমদানি ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন মিলিয়ে যোগান বা সরবরাহ পর্যাপ্ত এমনকি কোন কোন সময় কিছুটা বেশিই হয়ে থাকে। সরকারি ও বেসরকারি তথ্য-পরিসংখ্যান তাই বলছে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে গতকাল (শনিবার) দেশি-বিদেশি ১২টি বৃহৎ জাহাজ থেকে সাড়ে ৪ লাখ মেট্রিক টনেরও বেশি পরিমাণ গম খালাসের কাজ চলছিল। এ মাসেই আরও সমপরিমাণ আমদানি চালান পৌঁছানোর কথা রয়েছে। অথচ বাজারে আটা ও ময়দার মূল্য আকাশছোঁয়া। চালের মূল্যের সাথে পাল্লা দিয়ে আটা ও ময়দার বাড়তি দাম যথেচ্ছ উসুল করে নিচ্ছে অতি মুনাফালোভী সিন্ডিকেট। আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে গমের মূল্যস্তর স্থিতিশীল রয়েছে। কিন্তু দেশে অযৌক্তিক বেশি দরেই আটা-ময়দা বিক্রি হচ্ছে পাইকারি ও খুচরায়। আবার আটা-ময়দার মূল্য আকাশছোঁয়া থাকার কারণে প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে বেকারী খাদ্যপণ্যসহ হোটেল-রেস্তোঁরার খাবারের দামও। তাছাড়া অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং খাদ্যাভ্যাসে ক্রমাগত পরিবর্তন আসার ফলে আটা-ময়দার রুটি কিংবা এ জাতীয় হালকা ও শুকনো খাবার-দাবারের উপর নির্ভরতা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। এই সুবাদে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বাড়তি দাম হাতিয়ে নিচ্ছে। এরফলে ভুক্তভোগী হয়ে অকারণে ঠকছেন ক্রেতা সাধারণ। অথচ আটা-ময়দার লাগামহীন চড়ামূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে নামানোর কোন উদ্যোগ সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের নেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে বর্তমানে গমের চাহিদা বার্ষিক ৪০ থেকে ৪২ লাখ মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়। অভ্যন্তরীণভাবে ৪ থেকে ৬ লাখ মেট্রিক টন পর্যন্ত গম উৎপাদিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর, কাস্টমস ও আমদানিকারকদের হিসাবে গত এক বছরে দেশে গম আমদানি করা হয়েছে প্রায় ৩৭ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমানে বছরে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ মেট্রিক টন গম সরকারিভাবে এবং বাদবাকি সিংহভাগই বেসরকারি খাতে আমদানি করা হয়। সেই নিরিখে দেশে গমের মজুদ থাকার কথা পর্যাপ্ত এমনকি চাহিদার চেয়ে কিছু বেশি। তাছাড়া আমদানির পাইপলাইনে আছে আরও প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন গম। গুদামে আর জায়গা খালি না পেয়ে কোন কোন আমদানিকারক গম মজুদ রাখছেন পাহাড়তলীসহ বিভিন্ন স্থানে শিল্প-কারখানার গোডাউন ও আঙিনায়।
সর্বশেষ হিসাব ও তথ্যমতে, আগে গম আমদানি করা হতো আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে। সেখানে ক্রয়মূল্য অনেক বেড়ে গেছে। তাই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গম আমদানি করা হচ্ছে তাজাকিস্তান, উজবেকিস্তানসহ প্রধানত রুশবøকভূক্ত দেশগুলো থেকে। এতে করে আমদানি মূল্য পড়ছে তুলনামূলকভাবে কম। আমদানিকৃত গম বন্দর থেকে খালাস সম্পন্ন করার পর্যায়ে পর্যন্ত প্রতিকেজির দাম পড়ছে প্রকারভেদে ১৬ টাকা থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত। অথচ বাজারে আটা বেচাকেনা হচ্ছে ব্রান্ডভেদে প্রতিকেজি (প্যাকেট) ৩০ থেকে ৫৮ টাকা, খোলা আটা ২৬ থেকে ৩০ টাকা কেজি। আর ময়দা বিক্রি হচ্ছে তাও ভিন্ন ভিন্ন ব্রান্ডভেদে কেজি (প্যাকেট) ৪০ থেকে ৫৬ টাকা পর্যন্ত। খোলা ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৩৪ থেকে ৩৮ টাকা। গম থেকে তৈরি সুজি বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৫৬ থেকে ৬৪ টাকা দরে। উচ্চ ও মধ্যবিত্তের ক্রেতাদের টার্গেট করে ‘স্পেশাল লাল আটা’র বিশেষ বিশেষ ব্রান্ডের আটা অত্যন্ত অযৌক্তিক ও যথেচ্ছ চড়া মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে চেইনশপ ও ডিফারমেন্ট স্টোরগুলোতে। গতকালের টিসিবির বাজারদরে জানানো হয়েছে, প্রতিকেজি (প্যাকেটজাত) আটা ৩০ থেকে ৩২ টাকা এবং ময়দা কেজি (প্যাকেট) ৪০ থেকে ৪২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে গমের চলমান দর স্থিতিশীল থাকায় প্রতি মেট্রিক টন সিএন্ডএফ ভ্যালু হচ্ছে ১৮৫ ডলার থেকে ২০০ ডলার পর্যন্ত। সেই হিসাবের নিরিখে বাজারে আটা প্রতিকেজি সর্বোচ্চ ২২ টাকা এবং ময়দা সর্বোচ্চ কেজি ৩০ টাকায় বিক্রি করা যৌক্তিক হতে পারে। যা এখন আকাশছোঁয়া মূল্যেই বেচাকেনা হচ্ছে। পকেট কাটা যাচ্ছে বিশেষত সীমিত আয়ের মানুষের।
এদিকে খাদ্য অধিদপ্তরের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা ও ইউএসএইডের বিশেষজ্ঞ মোহাফেজ আলী গতকাল ইনকিলাবকে জানান, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও স্বাস্থ্য সচেতনতা বেড়ে যাচ্ছে। খাদ্যপণ্য ও খাদ্যশস্যের গুণগত মানের উপর নানাবিধ পরীক্ষা-নীরিক্ষা, গবেষণা চলছে। আর খাদ্যাভ্যাসেও আসছে পরিবর্তন। বাংলাদেশেও ডায়াবেটিকস, হৃদরোগ ও অন্যান্য জটিল ধরনের রোগব্যাধি থেকে নিরাপদ থাকতে অথবা রোগকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণের জন্য ভাতের পরিবর্তে আটার রুটি খাওয়া রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এমন উচ্চ ও মধ্যবিত্তের হার অনেক বেড়ে গেছে। শহর-নগরে এর হার বেশি। আবার বেকারী খাদ্যপণ্য সামগ্রীর চাহিদা ও উৎপাদনের মাত্রাও বেড়ে গেছে। এরজন্য ময়দার চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে গম বা আটা-ময়দাভিত্তিক খাদ্যশিল্প খাতে প্রচুর সম্ভাবনা রয়ে গেছে। তবে উপযুক্ত প্রযুক্তি ও উদ্যোগের অভাবে তা তেমন বিকশিত হচ্ছে না।
তিনি আরও জানান, স্বাস্থ্যের জন্য ভাতের চেয়ে গম তথা আটাকে বেশি উপযোগী মনে করেন চিকিৎসকরাও। কেননা চালে প্রোটিন রয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ। আর আটায় বা গমে তা ৯ থেকে ১৪ শতাংশ। আবার ভাতের চেয়ে আটায় কার্বোহাইড্রেটের মাত্রা কম। তাছাড়া আটা-ময়দা থেকে তৈরি রুটি ও অন্যান্য খাবার শুকনো, পরিমাণে স্বল্প ও নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি কম। তাই মানুষ আগের তুলনায় স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে সেদিকেই ঝুঁকছে। তবে নি¤œআয়ের মানুষ ভাতের উপর মূলত নির্ভর করছে। কিন্তু মধ্য ও উচ্চবিত্তের রোগব্যাধি একইসাথে সচেনতা বেড়ে যাবার ফলে রুটির উপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেন, এসব কারণে দেশে গমের চাহিদা এবং আমদানির পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৮৫-৮৬ সাল পর্যন্ত দেশে যেখানে ২০ লাখ মেট্রিক টন গমের চাহিদা ছিল সেখানে বর্তমানে ৪০ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। এরমধ্যে ৫ লাখ টনের মতো দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। তবে ১৯৯৮ সালে সর্বোচ্চ প্রায় ২০ লাখ মেট্রিক টন গমের উৎপাদন হয়। এরপর বছর বছর হ্রাস পাওয়ার কারণ হলো, কৃষকদের গম আবাদে খরচ অনেক বেড়ে গেছে। তারা ভিন্ন অথচ তুলনামূলক কম খরচে ফসল আবাদের দিকেই বেশি আগ্রহী।
এদিকে লাইটারেজ কার্গোজাহাজ মালিকদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন সেলের নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশীদ ইনকিলাবকে জানান, চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙরে গতকাল গম বোঝাই ১২টি মাদার ভেসেল থেকে খালাস কাজ পুরোদমে চলে। এসব জাহাজে রয়েছে ৪ লাখ ৫৭ হাজার মেট্রিক টন আমদানিকৃত গম। এরমধ্যে এ যাবত খালাস করা হয়েছে ২ লাখ ৪৬ হাজার ৫শ’ মেট্রিক টন।

https://www.dailyinqilab.com/article/87697/