২৪ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১১:৫৩

বাড়ছে হাহাকার

খায়রুল বাশার। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। দুর্গম চরে বসবাস তাদের। বন্যা এলে ঘরে পানি উঠে। প্রতিবারের বন্যাতেই বাবা-মায়ের কষ্টের দৃশ্য দেখে। একটু একটু করে বড় হচ্ছে বাশার। নিজের ভেতরেও কষ্ট অনুভব 

করতে শিখেছে। বন্যার কারণে স্কুলে যাওয়া হয় না টানা ২০-২৫ দিন। ঘরেও পড়ার পরিবেশ নাই। সমবয়সীদের সঙ্গে তাই সারা দিন নদীর পানিতে সময় কাটে তার। নৌকায় অচেনা ভদ্র মানুষের দল দেখলেই ছুটে আসে ত্রাণের আশায়। শহুরে কিছু তরুণ, হৃদয়বান ব্যক্তি, স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনগুলো বরাবরের মতোই তাদের পাশে দাঁড়ায়। এবারো দাঁড়িয়েছে। এক কেজি চিড়া, গুড়, মুড়ি, বিস্কুট এসবের বেশি কিছু থাকে না ত্রাণের প্যাকেটগুলোতে। তার পরেও ক্ষুধা ও পেটের টানেই ছুটে আসে এসবের একটি প্যাকেট পাওয়ার আশায়।
বগুড়াসহ উত্তরের সাত জেলার বন্যার পানি বাড়ি থেকে নামতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই তলিয়ে যাওয়া ৯০ ভাগ ঘরবাড়ি থেকে পানি পুরোপুরি নেমেছে। ১০ ভাগ বাড়িঘরে এখনো সামান্য পানি আছে। পানি নেমে যাওয়া এসব ঘর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে বেশির ভাগ।
বগুড়ার বন্যাদুর্গত ইউনিয়নগুলো হচ্ছে সারিয়াকান্দি উপজেলার কুতুবপুর, কামালপুর, চন্দনবাইশা ও কর্ণিবাড়ি, সোনাতলা উপজেলার মধুপুর, তেকানি চুকাইনগর, পাকুল্লা, ধুনটের ভাণ্ডারবাড়ী, গোসাইবাড়ী ইউনিয়ন। তিন উপজেলার এসব ইউনিয়নগুলোর ১৭ হাজার ২৪৫ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছিলো। বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা ২৫ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। এতে অনেকেই গৃহহারা হয়েছে। দুর্গত অনেক পরিবার এখনো বাঁধের উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়ে আছে। বাড়ি থেকে পানি নেমে গেলেও ঘরগুলো মেরামত ছাড়া বসবাস করা যাচ্ছে না। যেকোনো সময় ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা আছে পানিতে ডোবা অধিকাংশ ঘর।
এদিকে লোকালয় থেকে বন্যার পানি নেমে গেলেও এখনো বিশুদ্ধপানি, খাবার এবং তীব্র জ্বালানি সংকটে আছে বন্যার্তরা।
এদিকে সরজমিন যমুনার দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের অনেকের হাতেই ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছেনি। কথা হয় সারিয়াকান্দির বোহাইল ইউনিয়নের ৬০ বছর বয়সী বৃদ্ধ শাহ জামালের সঙ্গে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এবারের বন্যায় তার দুই ঘরের একটি ঘর একেবারেই ভেঙে গেছে। আরেকটি ঘরও যেকোনো সময় ভেঙে যাবে। পাঁচ বিঘা জমিতে ফসল লাগিয়ে ছিলেন সেই ফসলসহ জমি এখন নদীগর্ভে। এতো কিছুর পরেও সরকারের ত্রাণ কার্যক্রমের কোনো অংশই তিনি পাননি। এমন অভিযোগ করলেন ৫৫ বছর বয়সী খোদেজা বেগমও।
এদিকে ত্রাণ না পাওয়ার অসংখ্য অভিযোগ থাকলেও জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস বলছে পানি কমে যাওয়ায় তাদের ত্রাণ কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। অথচ বগুড়ার বন্যার্তদের জন্য বরাদ্দ ২১৫ টন চাল, ৭ লাখ ৫৫ হাজার নগদ টাকা, ১০০ বান্ডিল ঢেউ টিন ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসে মজুত আছে। কর্মকর্তারা পানি নেমে যাওয়ার দোহাই দিয়ে ত্রাণ কার্যক্রম বন্ধ করেছে। এতে দুর্গত এলাকার মানুষ ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে।
অপরদিকে বগুড়ার সারিয়াকান্দি, ধুনট, সোনাতলা উপজেলায় ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, পুকুরের মাছ, মাঠের ফসলসহ বিভিন্ন ভাবে ৬৩ কোটি ৪৫ লাখ ৩১ হাজার চারশ’ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এসব ক্ষতি মোকাবিলায় ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস বন্যাদুর্গতদের মাঝে ৩৩৫ টন চাল, ৪ লাখ টাকা, ৪০০ বান্ডিল ঢেউ টিন বিতরণ করেছে। এরপরেও দুর্গত মানুষের তুলনায় এই ত্রাণ পর্যাপ্ত নয়। বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ এখনো ত্রাণের জন্য হাহাকার করছে। বাইরের মানুষ দেখলেই ত্রাণের আশায় ছুটে আসছে এসব মানুষ। স্থানীয় চেয়ারম্যানও স্বীকার করলেন ত্রাণ স্বল্পতার কথা।
এদিকে বন্যায় রাস্তাঘাটের চরম ক্ষতি হয়েছে। অনেক রাস্তা ইতিমধ্যেই জেগে উঠলেও তা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এতে ভোগান্তি বেড়েছে এলাকাবাসীর। ফসলের ক্ষতিও পুষে উঠতে হিমশিম খাচ্ছে দুর্গত এলাকার কৃষকরা।
চলতি বন্যায় উত্তরের ৭ জেলা সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রামে ২২ হাজার ৪০৭ হেক্টর ফসলি জমি পানির নিচে ডুবে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা বগুড়ায় ২৪ হাজার ২৫, সিরাজগঞ্জ জেলায় ৬৫ হাজার ৩০৯ জন। রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলা মিলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে। টাকার অঙ্কে এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটি।
এসব জমিতে আউশ ধান, পাট, আমন বীজতলা, রোপা আমন, বোনা আমন, শাকসবজি, মরিচ, আখ, কলার আবাদ ছিল।
এদিকে বাঁধে আশ্রয় নেয়া হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। শুকনা জ্বালানি, বিশুদ্ধ পানির সংকট এসব এলাকায় তীব্র আকার ধারণ করেছে। এখন পর্যন্ত যে ত্রাণ দেয়া হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম। অনেকেই অভিযোগ করেছেন তাদের হাতে এখনো কোনো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছেনি।
সারিয়াকান্দি উপজেলার বোহাইল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, সরকার চলতি বন্যায় কয়েক দফা ত্রাণসামগ্রী দিলেও দুর্গত মানুষের তুলনায় অনেক কম। যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাতে আরো ত্রাণের প্রয়োজন বলে তিনি জানান।
বগুড়া ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা শাহারুল ইসলাম মো. আবু হেনা জানান, বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা এবং ধুনট উপজেলার ১৭ হাজার ২৪৫ পরিবার পানিবন্দি ছিল। এসব বানভাসি মানুষ সারিয়াকান্দি আশ্রয় প্রকল্পে ঠাঁই পেয়েছে ৭৬৫ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৩৫৫ পানিবন্দি পরিবার। তাদের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ত্রাণ সামগ্রী এবং নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে। তিনি আরো জানান, বর্তমানে পানি কমে যাওয়ায় ত্রাণ কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। যদি কোথাও ত্রাণের প্রয়োজন হয় তা হলে মজুতকৃত ত্রাণসামগ্রী থেকে সেই সব জায়গায় বিতরণ করা হবে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=75419&cat=6/