১৫ জুলাই ২০১৭, শনিবার, ৯:৩৪

সমন্বয়হীনতায় চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতির অবনতি

গত দুই মাসে চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। শুরুতে রাজধানীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস বিস্তারের খবর আসছে। চলতি বছরের মার্চ মাস থেকে চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বারে চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত রোগীরা আসতে শুরু করেন। আর জুন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এর পরই চিকুনগুনিয়া নিয়ে দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ করেও সরকার ভয়াবহ হয়ে ওঠা এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এখনও সমর্থ হয়নি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য বিভাগকে দায়ী করেছেন। তাদের মতে, মশা নিধনের জন্য দেশের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোকে প্রতি বছর বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়। কাজেই মশা নিধনের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার বিভাগ সংশ্লিষ্টদের। তারা মশা নিধনে ব্যর্থ হয়েছেন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য বিভাগ আগে থেকে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। দুই বিভাগের সমন্বয়হীনতার কারণে চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি এত ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।


সম্প্রতি সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্ব এবং এক আলোচনা অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, চিকুনগুনিয়ার বাহক মশা নিধন করা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। সিটি করপোরেশন মশা নিধনের জন্য বরাদ্দ পায়। কাজেই মশা নিধনের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং আক্রান্তদের

চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। এ কার্যক্রমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আগে থেকেই পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিয়ে সে অনুযায়ী কাজ করছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী সমকালকে বলেন, চিকুনগুনিয়া নিয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে একযোগে ১০ হাজার মেডিকেল শিক্ষার্থী সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে। গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করা হয়েছে। প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে চিকুনগুনিয়া সহায়তা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। আক্রান্ত রোগীরা যাতে সহজে সেবা পান; সরকার সে ব্যবস্থা করেছে। চিকুনগুনিয়া নিয়ে আতঙ্ক না ছড়াতে মন্ত্রী সবার প্রতি আহ্বান জানান।

এদিকে গতকাল শুক্রবার চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বলেছেন, সিটি করপোরেশনের পক্ষে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মশা মারা সম্ভব নয়। মেয়রের এ বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে মশা নিধনের দায়িত্ব কার?

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী সমকালকে বলেন, মশা নিধনের বিষয়ে উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা যুক্তিযুক্ত নয়। মশা নিধনের জন্য সরকার তাদের বরাদ্দ দেয়। হয়তো সে বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয় তাও বিভিন্নজনের পকেটে চলে যায়। তাই মশা নিধন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।

ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী আরও বলেন, নতুন রোগের বিষয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ সচেতনতামূলক কার্যক্রম বিলম্বে শুরু করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য বিভাগ ও স্থানীয় সরকার বিভাগের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। তাই চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ সমকালকে বলেন, 'বিগত বছরগুলোতে এই সময়টায় ডেঙ্গুর প্রভাব দেখা গেছে। কিন্তু এ বছর চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে কিছু কিছু রোগী আক্রান্ত হয়ে ডাক্তারদের কাছে আসতে শুরু করেন। কিন্তু পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হবে, তা শুরুতে আঁচ করা যায়নি। এপ্রিল এবং মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। জুন থেকে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। চিকুনগুনিয়ার বিস্তার নিয়ে সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য বিভাগ পরস্পরকে দোষারোপ করে লাভ নেই। সিটি করপোরেশনের কাজ মশা নিধন করা। তারা সময়মতো সেটি করেনি। তাই মশার বিস্তার ঘটেছে। মশাবাহিত রোগটি ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন মশা নিধনে সিটি করপোরেশনকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।'

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সিডিসি) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বিলম্বে সচেতনতামূলক কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি জানান, এ বছর আগেভাগে বৃষ্টি শুরুর কারণে ডেঙ্গু বিস্তারের আশঙ্কা করা হয়েছিল। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে মানুষ জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন_ এমন বার্তা তাদের কাছে ছিল। সেটি চিকুনগুনিয়া কি-না তা নিশ্চিত হতে পারেননি তারা। চিকুনগুনিয়া বিস্তারের খবর পাওয়ার পর পরই মে মাস থেকে কার্যক্রম শুরু করা হয় এবং বর্তমানে তা জোরালোভাবে চালানো হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা পরিচালিত এক জরিপে ২৩টি অঞ্চলকে চিকুনগুনিয়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ সমকালকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন পর্যন্ত চিকুনগুনিয়াকে বিপজ্জনক রোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তার পরও সরকার এ বিষয়ে সচেতন রয়েছে। চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। 

http://bangla.samakal.net/2017/07/15/308246