১৩ জুলাই ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:৪৮

গুমের রহস্য প্রকাশে আমি ভীত নই

অপহরণের পর গার্ডিয়ানের সঙ্গে ফরহাদ মজহারের সাক্ষাৎকার

রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কবি ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফরহাদ মজহার। অপহরণের ঘটনার পর এই প্রথম তিনি কোনো বিদেশি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বললেন। অপহরণের বিষয়ে তিনি বলেন, আমার সঙ্গে যা হয়েছে তা প্রকাশ করতে আমি ভীত নই। বেশির ভাগ মানুষই গুমের ঘটনা থেকে ফিরে আসার পর রহস্যজনকভাবে নীরব হয়ে যায়। আমি যখন কাজে ফিরব তখন এই বিষয় নিয়ে কাজ করব। আমাদের এই অপহরণ করার সংস্কৃতির সমাপ্তি ঘটাতে হবে।
ঘটনা সম্পর্কে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘তারা কঠোর ভাষা ব্যবহার করেছিল, আমার মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়েছিল এবং চোখ বেঁধে ফেলেছিল। তারা হাঁটু ব্যবহার করে আমাকে গাড়ির মেঝের সাথে চেপে রেখেছিল।’
আজ বুধবার দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে ফরহাদ মজহার বলেন, গত সপ্তাহে ভোর ৫টার দিকে তাঁকে কে বা কারা বাড়ির সামনের রাস্তা থেকে তুলে নেয় তা তিনি বুঝতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘সেদিন সকালে আমার চোখে সমস্যা হচ্ছিল, তাই ওষুধ কিনতে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম। হঠাৎ তিনজন ব্যক্তি আমার পাশে এসে উপস্থিত হয় এবং একটি সাদা মিনিবাসে (মাইক্রোবাস) আমাকে তুলে নেয়।’
এই কবি বলেন, এ সময় তিনি পকেট থেকে মোবাইল ফোনটি বের করার সুযোগ পান এবং তাঁর স্ত্রীকে ফোন করেন। বলেন, ‘এটা ছিল একটা ছোট্ট ফোনকল। আমি ফিসফিস করে বললাম, ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। অপহরণকারীরা বুঝে ওঠার আগেই আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারি।’
এরপর ওই ব্যক্তিরা ফরহাদ মজহারের চোখ বেঁধে ফেলে এবং মোবাইল ফোন নিয়ে নেয় বলে গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান তিনি। এ সময় তিনি অপহরণকারীদের মুক্তিপণও দিতে চান। তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে তারা আমাকে ফোন ব্যবহার করতে দেয় এবং কয়েকবার আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলি।’
‘ঘণ্টার পর ঘণ্টা মিনিবাসটি চলতে থাকে। তারা আমাকে অপমান করে, মাঝেমধ্যে আমাকে উদ্দেশ্য করে গালাগাল করতে থাকে। তারা আমাকে চড়ও মারে,’ বলেন ফরহাদ মজহার। তিনি আরো বলেন, ‘১০ থেকে ১২ ঘণ্টা পর অপহরণকারীরা আমাকে জানায়, তারা আমাকে মুক্ত করে দেবে। এরপর তারা একটি নির্জন ও কিছুটা অন্ধকার স্থানে আমার চোখ খুলে দিয়ে চলে যায়। তারা আমাকে একটি বাসের টিকেট দেয় এবং বলে খুলনা শহর থেকে বাসে চেপে ঢাকায় ফিরে যেতে। আমি কিছুদূর হাঁটি এবং খুলনার একটি বিপণিবিতানে পৌঁছাই, যেখানে রাত সোয়া ৯টার বাসে ওঠার আগে আমি কিছু খাবার খাই।’
গার্ডিয়ানকে ফরহাদ মজহার বলেন, কারা তাঁকে অপহরণ করেছিল সে সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা নেই। বলেন, ‘আমার অপহরণকারীরা সাধারণ পোশাকে ছিল। আমি জানি না তারা কারা বা কোন গোষ্ঠীর সদস্য।’
‘বন্দি অবস্থায় আমি বেশ কয়েকবার আমার স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। আমাকে বহনকারী মাইক্রোবাসটি ঢাকা ছেড়ে আসার পর পুলিশ চাইলে আমার অবস্থান শনাক্ত করতে পারত। আমি অবাক হয়েছি যে কেন পুলিশ খুলনা পৌঁছার আগেই মাইক্রোবাসটিকে আটক করতে পারল না।’
ফরহাদ মজহার জানান, এখনো তিনি মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত অবস্থায় আছেন। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে আরো কিছু সময় লাগবে। তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমার সঙ্গে যা হয়েছে তা প্রকাশ করতে আমি ভীত নই। বেশির ভাগ মানুষই গুমের ঘটনা থেকে ফিরে আসার পর রহস্যজনকভাবে নীরব হয়ে যায়। আমি যখন কাজে ফিরব তখন এই বিষয় নিয়ে কাজ করব। আমাদের এই অপহরণ করার সংস্কৃতির সমাপ্তি ঘটাতে হবে।’
এর আগে গত ৩ জুলাই সোমবার ভোরে ফরহাদ মজহার অপহৃত হয়েছিলেন বলে তাঁর পরিবার থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল। সেদিনই রাতে তাঁকে যশোরের নওয়াপাড়ায় হানিফ পরিবহনের একটি বাস থেকে উদ্ধার করা হয়। পরের দিন তাঁকে ঢাকায় এনে আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে তিনি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জবানবন্দি দেন। ওই দিনই শারীরিক অসুস্থতার কারণে ফরহাদ মজহারকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল থেকে আজ ছাড়া পান তিনি।
এদিকে ফরহাদ মজহারের ঘটনা সম্পর্কে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, কবি ও লেখক ফরহাদ মজহারের জবানবন্দির সঙ্গে প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণের মিল নেই।
আজ ডিএমপি সদর দপ্তরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘ফরহাদ মজহার বিজ্ঞ আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তা তদন্ত করতে গিয়ে আমরা যে ভিডিও ফুটেজ, সিসিটিভি ফুটেজ, কললিস্ট এবং বস্তুগত সাক্ষ্যপ্রমাণ পেয়েছি, তার সঙ্গে উনার বক্তব্যের মিল নেই।’
এ সময় কমিশনার আরো বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে তথ্য সংগ্রহ করেছি। এই তথ্যের বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। তদন্তে সঠিক সিদ্ধান্তে আসার জন্য আমাদের আরো দু-একদিনের মতো সময় লাগবে।’ দুই একদিনের মধ্যে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ বিষয়ে দেশের মানুষকে সুস্পষ্ট তথ্য জানাবেন বলেও জানান তিনি। বাংলা ট্রিবিউন।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/87298/