১৯ জুলাই ২০১৭, বুধবার, ১০:২০

অভিনব আবদার ঋণখেলাপিদের

এক টাকাও পরিশোধ না করে খেলাপির তালিকা থেকে নাম বাদ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দাবি করেছে ৯ প্রতিষ্ঠান

শিথিল শর্তে ঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন সুবিধা নিয়েছে এসএ গ্রুপের মালিকানাধীন সামাননাজ সুপার অয়েল নামে একটি প্রতিষ্ঠান। মাত্র ১ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ঋণের কিস্তি দেওয়ার সময় পার হলেও কোনো টাকা পরিশোধ করা হয়নি। এতে করে আবার খেলাপি হয়ে পড়েছে রূপালী ব্যাংকের গ্রাহক সামাননাজ সুপার অয়েলের ঋণ। এই ঋণ আবার নিয়মিত করতে দৌড়ঝাঁপ করছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মো. শাহাবুদ্দিন আলম। তবে এবার আর কোনো ডাউনপেমেন্টও দিতে চান না তিনি। আগামী এক বছরে কোনো কিস্তিও দিতে রাজি নন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তিনি আবেদন করেছেন, যাতে রূপালী ব্যাংককে নির্দেশ দিয়ে খেলাপির তালিকা থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ রকম অভিনব আবেদনের কোনো যুক্তি ও ভিত্তি নেই। এতে ঋণ-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। গ্রাহকদের আস্থা হারাবে ব্যাংক।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে ওই প্রতিষ্ঠানের এক আবেদনে বলা হয়েছে, রূপালী ব্যাংকে সামাননাজ সুপার অয়েলের ঋণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিআইবিতে (ঋণতথ্য ব্যুরো) খেলাপি হিসেবে প্রদর্শিত হওয়ায় এলসি খোলাসহ ব্যাংকিং লেনদেনে সমস্যা হচ্ছে। ব্যবসা পরিচালনার স্বার্থে রূপালী ব্যাংক যেন নিজ থেকেই ঋণটি পুনঃতফসিল করে দেয়, সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। অথবা পুনর্গঠন করা ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরুর মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি সিআইবিতে খেলাপির


তালিকা থেকে রূপালী ব্যাংক যেন নাম বাদ দেওয়ার ব্যবস্থা করে, সে দাবি জানানো হয়েছে। এভাবে এক টাকাও না দিয়ে খেলাপির তালিকা থেকে নাম কাটার পর তাকে যেন আবার ব্যাংকিং সুবিধা দেওয়া হয়_ সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেন নির্দেশ দেয়।

শুধু সামাননাজ সুপার অয়েল নয়, খেলাপি থেকে নাম বাদ দেওয়ার জন্য প্রায় একই রকম আবদার জানিয়ে আবেদন করেছে আরও আটটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৯(১)(চ) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরাসরি সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে নির্দেশ দিয়ে সিআইবিতে খেলাপির তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার অনুরোধ করেছে। এ তালিকায় রয়েছে_ রয়েল ডেনিম, পেনিনসুলা স্টিল মিলস, ইমপ্রেসিভ অ্যাপারেলস, ব্লুটেক্স নিটওয়্যার, ফাহামী শার্টস, এমএসজি ফ্যাশন ইন্টারন্যাশনাল, সাবিল আইটি, আরাফাত ট্রেডিং সেন্টার ও আল-আরাফাত সোয়েটার্স।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, সিআইবি থেকে এমনি এমনি খেলাপির নাম কেটে দেওয়া অসম্ভব। তবে শর্ত পালন করে ঋণ পুনঃতফসিল কিংবা বিশেষ ব্যবস্থায় পুনঃতফসিল বা পুনর্গঠন হতে পারে, যেভাবে এর আগে বড় ঋণ পুনর্গঠন হয়েছে। তা ছাড়া যে কারও নাম খেলাপির তালিকা থেকে বাদ দিলে ঋণ-শৃঙ্খলা নষ্ট হবে। তাতে ব্যাংক খাত বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। এ ছাড়া সবাই এসে তখন সিআইবি থেকে নাম বাদ দেওয়ার আবেদন করবে। ফলে এ রকম দাবি ভিত্তিহীন।

রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বৈশ্বিক মন্দা বিবেচনায় বড় ঋণ পুনর্গঠনে দেওয়া বিশেষ সুবিধা নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ পুনর্গঠন হয়েছে, তার একটি এসএ গ্রুপ। দেশের ছয়টি ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির ৯২৮ কোটি টাকা পুনর্গঠন হয়। এর মধ্যে সামাননাজ সুপার অয়েলের নামে রূপালী ব্যাংকে পুনর্গঠন করা হয় ২০১ কোটি টাকা। এর আগে গত মার্চে আরেক অভিনব আবেদন নিয়ে এসেছিল এসএ গ্রুপসহ তিনটি প্রতিষ্ঠান। এসএ, রতনপুর ও এমআর গ্রুপের পক্ষ থেকে যৌথভাবে করা আবেদনে বলা হয়, পুনর্গঠিত এসব ঋণে নতুন করে কোনো সুদ আরোপ না করে কিস্তির হিসাব করতে হবে। ঋণের মেয়াদ ১২ বছরের জায়গায় ২০ বছর নির্ধারণ করতে হবে। নতুন করে ব্যাংকিং সুবিধা দিতে হবে। আর কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়াতে হবে। তবে সেই আবেদনও আমলে নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসএ গ্রুপের কর্ণধার ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক মো. শাহাবুদ্দিন আলম সমকালকে বলেন, পুনর্গঠন করা ঋণ পরিশোধের প্রথম শর্ত ছিল ব্যবসা পরিচালনার স্বার্থে ব্যাংকগুলো পুনরায় অর্থায়ন করবে। তবে বেশিরভাগ ব্যাংক তা না করায় ব্যবসা পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে। তারা এখন ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন। নির্দিষ্ট সময়ে যেহেতু বেশিরভাগ ব্যাংক পুনরায় অর্থায়ন করেনি, তাই পরিশোধ শুরুর মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর আবেদন করেছেন। এ ছাড়া ব্যাংক খাতে সুদহার অনেক কমে এলেও এখনও পুনর্গঠিত ঋণে ১২-১৩ শতাংশ করে সুদ নেওয়া হচ্ছে। এ কারণে সুদহার কমানোর দাবি করা হয়েছে। এসব বিষয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৯(১)(চ) ধারায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ না দিলে পুনর্গঠিত ১৫ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ কঠিন হয়ে পড়বে বলে তিনি মনে করছেন।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৯(১)(চ) ধারায় বলা হয়েছে, 'ঋণ-শৃঙ্খলার স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক সাধারণভাবে সকল ব্যাংক কোম্পানি বা কোনো বিশেষ ব্যাংক কোম্পানিকে বা বিশেষ শ্রেণির ব্যাংক কোম্পানির জন্য ঋণ শ্রেণিকরণ ও সঞ্চিতি সংরক্ষণ, ঋণ মওকুফ, পুনঃতফসিলীকরণ কিংবা পুনর্গঠন-সংক্রান্ত বিষয়সমূহ বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণীয় নির্দেশ প্রদান করতে পারবে।'

ঋণখেলাপিদের আবেদনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী সমকালকে বলেন, 'ব্যাংক কোম্পানি আইন মেনেই প্রতিটি ব্যাংক সিআইবিতে খেলাপি হিসেবে রিপোর্ট করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যক্তির নাম এখান থেকে বাদ দিতে বলবে, সেটা হাস্যকর।' তিনি জানান, এ রকম বেশ কয়েকটি আবেদন তাদের কাছে এসেছে। তবে একটিও আমলে নেওয়া হবে না। কিন্তু নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে কেউ ঋণ নিয়মিত করলে খেলাপির তালিকা থেকে এমনিতেই তার নাম বাদ পড়বে।

অভিনব আবেদন করা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েল ডেনিম ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়সংলগ্ন করপোরেট শাখার গ্রাহক। প্রতিষ্ঠানটির আট কোটি ৮৪ লাখ টাকার ঋণ এখন খেলাপি। এই প্রতিষ্ঠানও নিয়ম মেনে ঋণ নবায়ন করতে চায় না। একই কায়দায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্দেশ দিয়ে খেলাপির তালিকা থেকে নাম কাটাতে গত ৩০ মে আবেদন করেছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের পেনিনসুলা স্টিল মিলস লিমিটেড ইস্টার্ন ব্যাংকের আগ্রাবাদ করপোরেট শাখার খেলাপি। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, ব্যাংক খাতে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ রয়েছে এ রকম অনেক প্রতিষ্ঠান বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনর্গঠন করেছে। তবে তাদের ঋণের পরিমাণ এর চেয়ে কম থাকায় ওই সুবিধা পাননি। নানা কারণে প্রতিষ্ঠানটির ঋণ এখন খেলাপি।

উত্তরা ব্যাংকের বিকেএসপি শাখার গ্রাহক আরাফাত ট্রেডিং সেন্টার ও আল-আরাফাত সোয়েটার্সের মালিক মো. খোরশেদ আলম। বর্তমানে পাওনা ৭৫ লাখ টাকা আদায়ের জন্য গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রির নিলাম ডেকেছে উত্তরা ব্যাংক। এরপর নড়েচড়ে বসেছেন তিনি। তবে তিনিও বিশেষ ব্যবস্থায় খেলাপি থেকে নাম বাদ দেওয়ার দাবি করেছেন।

এ ছাড়া সিটি ব্যাংকের বঙ্গবন্ধু এভিনিউ শাখার গ্রাহক ইমপ্রেসিভ অ্যাপারেলস, ইসলামী ব্যাংকের দিলকুশা বৈদেশিক বাণিজ্য শাখার গ্রাহক ব্লুটেক্স নিটওয়্যার, এক্সিম ব্যাংকের গুলশান শাখার গ্রাহক ফাহামী শার্টস, জনতা ব্যাংক ভবন শাখার গ্রাহক এমএস জি ফ্যাশন ইন্টারন্যাশনাল এবং বেসিক ব্যাংকের গ্রাহক সাবিল আইটি একই রকম আবদার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে।

তাদের আবেদন যে গ্রহণযোগ্য নয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে এসব গ্রাহককে তা জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার অনুযায়ী সব ব্যাংকের ঋণ-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ এবং শ্রেণিমান অনুযায়ী সিআইবিতে সংরক্ষণ করা হয়। বর্তমানে ব্যাংকগুলো সরাসরি অনলাইনে তাদের গ্রাহকদের ঋণের তথ্য সিআইবিতে রিপোর্ট করে। আবার অনলাইনেই এসব তথ্য যাচাই করে ঋণগ্রহীতার প্রকৃত অবস্থা নিরূপণ করে সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে আলাদাভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ঋণ ছয় মাস বা তার বেশি মেয়াদোত্তীর্ণ হলে ঋণতথ্য ব্যুরোতে (সিআইবি) তা খেলাপি হিসেবে প্রদর্শিত হয়। আইন অনুযায়ী এ রকম ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নতুন করে কোনো ঋণ নিতে পারে না। খেলাপি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা বা এ ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালক থাকতে পারেন না। এমনকি দেশের প্রতিনিধিত্বমূলক কোনো নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রেও তারা অযোগ্য বিবেচিত হন। তবে বকেয়া পরিশোধের মাধ্যমে ঋণ পুনঃতফসিল তথা নিয়মিত করার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়েও অনেক প্রতিষ্ঠানের ঋণ সিআইবিতে নিয়মিত দেখানোর ঘটনা রয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্দেশ দিয়ে খেলাপি না দেখানোর নজির নেই।

http://bangla.samakal.net/2017/07/19/309450