গতকাল সোমবার ব্র্যাক সেন্টারে সিপিডির মিডিয়া ব্রিফিং-এ বক্তব্য রাখেন ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
১১ জুলাই ২০১৭, মঙ্গলবার, ৭:৫৮

ব্যাংক লুটপাটের পেছনে দায়ী রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব

ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা তথা লুটপাটের পেছনে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবকে দায়ী করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। তারা বলছে, ব্যাংকিং খাতের ভেতরে সুশাসন না থাকা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ দেখভাল না করা ও অর্থ বিভাগের তদারকির ঘাটতি রয়েছে- এটা ঠিক। কিন্তু এগুলোর বাইরে সবচেয়ে বড় কথা হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। রাজনৈতিক সিগন্যাল না থাকলে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতারও প্রয়োগ করা যায় না।
গতকাল সোমবার সকালে ‘জাতীয় বাজেট ২০১৭-১৮ : অনুমোদন-পরবর্তী পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক এক মিডিয়া ব্রিফিং অনুষ্ঠানে এ কথা বলেছে সিপিডি। রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, প্রতিষ্ঠানটির আরেক বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, পরিচালক (সংলাপ) আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ, গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ব্যাংকিং খাতের এ অবস্থার মূল কারণ হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। এটা ব্যক্তি খাতের বিষয় নয়, এটা একটি গভীর বিষয়। রাজনৈতিক অর্থনীতি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকত তবে মনিটরিংয়ের জন্য যে তিন-চারটা প্রতিষ্ঠান আছে, তারা তাদের কাছে থাকা ক্ষমতার পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারত। সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনও ব্যবস্থা নিতে পারত। কিন্তু ব্যাংকিং খাতে যে সংস্কার হচ্ছে না, এর মূল প্রতিবন্ধকতা ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক না, প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতার ব্যাপার না, এটার ব্যাপারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই। যদি সদিচ্ছা থাকত, তবে এ ধরনের ঘটনা ঘটার কোনো সুযোগ ছিল না। রাজনৈতিক একটা সিগন্যাল না থাকলে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া যায় না।
সিপিডি’র সাবেক এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নভাবে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে সেটা ভালো। কিন্তু এটা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ সব ধরনের ব্যাংকের ক্ষেত্রে সুষমভাবে নেয়া উচিত। নির্বাচনের আগে যদি এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যেত তাহলে জনগণের উপকার হতো, জনগণ খুশি হতো। তার মতে, ব্যাংকিং খাতে আনুপাতিক দায়িত্ব নির্দিষ্ট করতে হবে। সাময়িক সময়ের জন্য হলেও একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে হবে। কমিশনের সুপারিশ পরবর্তীতে বাস্তবায়ন করতে হবে।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, নয়া ভ্যাট আইনের পক্ষে সিপিডি। যদি ১২ শতাংশ একক ভ্যাট হার নিয়ে প্রস্তুতি নেয়া হতো; তবে নতুন আইনের এই পরিণতি হতো না। তিনটি কারণে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি বলে মনে করে সিপিডি। এগুলো হলো প্রস্তুতির অসম্পূর্ণতা; রাজনৈতিক সহমতের অভাব এবং সামাজিক তাৎপর্যের প্রভাব।
দেবপ্রিয় বলেন, নতুন মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন ‘ক্র্যাশ ল্যান্ডিং’ করেছে। নতুন ভ্যাটের প্লেন উড়তে পারেনি; মুখ থুবড়ে পড়েছে। নির্বাচনের পরে যাতে আবার শূন্য থেকে শুরু করতে না হয়, সে জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। তাই অনলাইন-ব্যবস্থাসহ অন্য প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।
সিপিডি আরো বলেছে, একক ভ্যাট হার না থাকায় এত দিন যারা সুবিধা পেয়েছেন, নতুন আইনে তাঁরা অসুবিধায় পড়তেন। আবার রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত অনেক ব্যক্তি এত দিন অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিষয়টি দুই দিক থেকে দেখতে হবে।

চলতি অর্থবছরে (২০১৭-১৮) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য কতটা অর্জিত হবে- এ নিয়ে বিশ্লেষণ করেছে সিপিডি। তারা বলছে, রাজস্ব আদায়ে ৪৩ হাজার কোটি টাকা থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, একদিকে টাকা বিদেশে চলে যাবে, অন্যদিকে সৎ করদাতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হবে- এটা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। টাকা পাচারকারীর নাম-পরিচয় জানার পরও যদি কোনো ব্যবস্থা নেয়া না হয়; আবার সৎ করদাতাদের ওপর করের জন্য চাপ সৃষ্টি করা- এতে ন্যায়বিচার হয় না। সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হতে পারেন। এমনিতেই নির্বাচনের বছরে টাকা পাচার বৃদ্ধি পায়।

পুঁজিবাজারের জন্য বরাদ্দ ব্যবহারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে সিপিডি বলেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পুঁজিবাজারসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগে প্রণোদনা দিতে ১০ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই অর্থ ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা উচিত। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির মতে, অনেক সময় দেখা যায়, সরকারি ব্যয় দিয়ে ব্যক্তি পুঁজিতে লাভ দেয়া হয়। এমন পরিস্থিতি এড়াতে বিভিন্ন খাতে প্রণোদনার জন্য বরাদ্দকৃত ১০ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা ব্যবহারে সরকারকে সর্বোচ্চ সতর্ক হতে হবে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাজেটে অনুন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে অনেক কিছু সংযত করার সুযোগ আছে। এর মধ্যে ব্লক বরাদ্দ ৩ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা রয়েছে। এই টাকা পরিহার করার সুযোগ আছে কি না- সরকার বিবেচনা করতে পারে। এছাড়া পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে দেয়া ১ হাজার ৬৬ কোটি টাকাও সর্তকতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে।

বাজেটে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকের মূলধন জোগানে দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার সমালোচনা করে সিপিডি বলেছে, এই টাকা দেয়া উচিত নয়। সিন্ধুর মধ্যে বিন্দুর মতো তা তলিয়ে যাবে। এর জন্য কাঠামোগত সংস্কার দরকার। তাদের পর্যবেক্ষণ, নতুন ব্যাংকের পাশাপাশি প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকও এখন সমস্যায় পড়েছে। ব্যাংকের অভ্যন্তরে সুশাসনের অভাব আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে নজরদারি করার কথা ছিল, তা হয়নি। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে এ আবর্জনা পরিষ্কার করা সম্ভব নয়। এখনই সংস্কার-প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত।

সিপিডি মনে করে, বাজেটের ঘাটতি পূরণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে বেশি ঋণ নেয়ায় সরকারের দায় বাড়ছে। এতে সরকারের ব্যয় বাড়ছে। এটি মধ্য মেয়াদে টেকসই হবে না। ব্যাংক থেকে কম সুদে ঋণ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি। সিপিডি আরো মনে করেন, সঞ্চয়পত্র সামাজিক সুরক্ষার বিষয় নয়। অন্যভাবে খরচ করে সামাজিক সুরক্ষা দেয়া যেতে পারে।
সিপিডির আরেক সাবেক নির্বাহী পাচিালক ও বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থান সঞ্চারী হতে হবে। এ জন্য অর্থনীতি বহুমুখীকরণ করতে হবে। বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি নিতে হবে। উৎপাদনশীলতা-নির্ভর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে।

http://www.dailysangram.com/post/291141