১০ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ৬:০৫

তাহিরপুরে ভাতের কষ্ট

তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুরের বাসিন্দা বকুল মিয়া। স্ত্রী রোকেয়া খাতুন। সাত ছেলে মেয়েসহ এগার জনের পরিবার। শনির হাওরের পাশেই বাড়ি। ভিটামাটি ছাড়া আর কিছুই নেই। অন্যের জমি চুকু (বর্গা/ইজারা) নিয়ে বোরো ফসল করেছিলেন। তবে হাওর ডুবে যাওয়ায় অন্যদের মতো তারও সব ফসল তলিয়ে গেছে। এক মুঠো ধানও ঘরে তুলতে পারেননি। ঘরে তুলতে পারলে অর্ধেক ধান মালিকদের দিয়ে বাকিটা থাকতো। খেয়েপরে বাঁচতে পারতেন। কিন্তু এখন একবেলা খেলে আরেকবেলা না খেয়ে থাকতে হচ্ছে।

শুক্রবার শ্রীপুর গ্রামে কথা হয় বকুল মিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। বকুল মিয়া জানান, সুদে ঋণ নিয়ে ২ হাজার টাকা দিয়ে ছোট নৌকা কিনেছেন। ফসল ঘরে তুলে ঋণ পরিশোধ করার কথা থাকলেও এখন মাসের কিস্তি দিতে পারছেন না। ছোট নৌকা হওয়ায় সবসময় হাওরে মাছ ধরতে পারেন না। আর মাছ না পেলে প্রতিদিনের খাবারের চাহিদা মেটে না।

যেদিন ইচা (চিংড়ি) ধরতে পারেন সেদিন ১০০ টাকা আয় হয়। আর বাজার থেকে চাল কিনলে এই টাকায় আড়াই কেজি চাল পাওয়া যায়। যা এই পরিবারের এক দিনের খাবার। এদিকে প্রায় সত্তর বছরের বৃদ্ধ মায়ের ওষুধ কিনারও টাকা নেই তার। সরকারি ভাবে প্রথম মাসে ৩৮ কেজি এবং পরের মাসে ২৮ কেজি চাল আর ৫০০ টাকা পেয়েছেন। তবে এই চাল দিয়ে ১৪ দিনের বেশি সংসারের খাবার চলে না। বাজারে চালের দাম বেশি হওয়ায় সব সময় চাল কিনতে পারেন না। ‘রোকেয়া খাতুন বলেন, যে বেলা জোরাইতাম পারি ওই বেলা খাইয়র। অহনে এক বেলাত রুটি হাইয়া থাহন লাগে। তিনি জানান, নিজেরা না খেয়ে থাকতে পারি কিন্তু বাচ্চাদের তো না হাওইয়া রাহা যায় না। সরকার যদি আমাদের সাহায্য না করে তাইলে কিভাবে বাঁচব।

এই কাহিনী বকুল মিয়ার একার নয়। একই গ্রামের অনেকেই বেঁচে আছেন খেয়ে না খেয়ে। অনেকের অভিযোগ ফসল ডুবে যাওয়ার আগে ১০ টাকা কেজি দরে চাল পাওয়ায় সরকারি ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তারা। তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা না আসায় তারা সবাইকে দিতে পারছেন না। এইসব এলাকায় মেম্বারদের ২শ’ পরিবারের ত্রাণ দেয়া হয়। কিন্তু এলাকায় ৩শ’ পরিবার থাকলে একশ বাদ পড়ে যায়। তখন যারা আগে পায়নি তাদের দিতে হয়।

তাহিরপুরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে অসহায় মানুষদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে নানা অভিযোগ। ত্রাণ দেয়ার জন্য নাম নিতে গিয়েছি এমনটা ভেবে অনেকেই ভিড় করেন। তারা শোনান, তাদের জীবনের কষ্টঅধ্যায়ের কথা। হাওর ডুবে বোরো ফসল তলিয়ে গেলেও ঋণের কিস্তি থেকে মুক্তি মেলিনে তাহিরপুরের হাওরবাসীর। সরজমিন দেখা গেছে, কৃষক এখনো ঋণের কিস্তি দিচ্ছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা প্রতি সপ্তাহেই যাচ্ছেন কিস্তির টাকা আদায় করতে। তবে স্থানীয় ঋণগ্রহীতারা জানান, আগে যেমন কিস্তির টাকা আদায় করার জন্য চাপ দেয়া হতো। এখন তেমন চাপ দেয়া হয় না। তবে কৃষক পড়েছেন গ্যাঁড়াকলে। তারা বলেন, এখন যদি কিস্তির টাকা না দিই, তবে সামনে ফসল বোনার জন্য যখন টাকা প্রয়োজন হবে, তখন টাকা কোথায় পাবো।

দক্ষিণ শ্রীপুরের ফুলরাজ বলেন, ৬ বছর হলো স্বামী মারা গেছেন। ৩ ছেলে-মেয়ে নিয়ে বড় কষ্টে আছি। হাওর ডোবার পরই বড় মেয়েকে ঢাকায় পাঠিয়েছেন গার্মেন্টে কাজ করার জন্য। ত্রাণ হিসেবে ৩০ কেজি চাল আর ৫০০ টাকা পেলেও সংসার আর চলে না ফুলরাজের। এদিকে এনিজও থেকে টাকা তুলে এখন আর শোধ করতে পারছেন না। আর কিস্তি না দিলে ভবিষ্যতে টাকাও তুলতে পারবেন না। ফুলরাজ বলেন, পেটই চলে না। কিস্তির টাকা দেবো কোথা থেকে। হাজরা বিবি ২০ হাজার টাকা নিয়েছেন মহাজনের কাছ থেকে। প্রতিমাসে সুদের টাকা না দিলে ২০০০ টাকা যোগ হয়। ১২ বছর বয়সের ছোট ছেলে হাওরে মাছ ধরেন। দিনে আয় হয় ৫০-৬০ টাকা। এ দিয়েই চলছে তার সংসার। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে বিপাকে আছেন পপি বেগম। তার স্বামী মাইজুদ্দীন হাওরের ফসল হারিয়ে এখন ভাড়ায় নৌকা নিয়ে চিংড়ি ধরেন। ১৫ দিন পরপর ১৬০০ টাকা কিস্তি দিতে হয়। পপি বলেন, সারা বছর টাকা রোজগার করে হাওরে ঢালি। দুই বছর থেকে ফসল তুলতে পারি না। এখন পেট চালানোই দায়। কিভাবে আবার কিস্তি দেবো।

তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, সরকারি সংস্থা থেকে ঋণ পেতে কৃষকদের সমস্যা হয়। এনজিগুলো সহজে ঋণ দেয় এবং চড়া হারে সুদসহ সেটা উশুল করে। তবে সরকারের নিষেধ সত্ত্বেও এসব এনজিও বাড়ি বাড়ি গিয়ে কিস্তি তুলছে। অসহায় কৃষক পরে টাকা না পাওয়ার ভয়ে নিজে না খেয়েও কিস্তি পরিশোধ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=73384