৭ জুলাই ২০১৭, শুক্রবার, ৫:৪৫

যমুনা-ব্রহ্মপুত্র পাড়ে বন্যা

বৃহত্তর সিলেটের সঙ্গে এবার বন্যা কবলিত হয়েছে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র পাড়ের বিশাল জনপদ। গতকাল বৃহস্পতিবার সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত ও নদী এলাকার বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী, যমুনা-ব্রহ্মপুত্র উভয় নদী, এর শাখানদী ও উপনদীগুলো এই মুহূর্তে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে অথবা করার পর্যায়ে। কোথাও বিপদসীমা বরাবর বইছে। কোথাও খুব কাছাকাছি ছুঁইছুঁই করছে। নদ-নদীতে বাড়ছে পানি প্রতি ঘণ্টা বা প্রহরের ব্যবধানেই। দেশে নদ-নদীমালার অন্যতম প্রধান দুই ধারা যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র। উভয় নদীতে এবং এর সাথে যুক্ত শাখা, উপ-নদীগুলোতে পানির সমতল বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে। গত ৪ থেকে ৫ দিনে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীতে পানি বৃদ্ধির মাত্রা বেশি। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির এই প্রবণতা অব্যাহত থাকায় যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদ-নদী বিভিন্ন পয়েন্টে বিপদসীমা বরাবর অথবা খুব কাছাকাছি কয়েক সেন্টিমিটার ব্যবধানে রয়েছে। কয়েকটি পয়েন্টে গতকাল রাতের মধ্যে ও আজ (শুক্রবার) সকাল নাগাদ বিপদসীমা নিশ্চিতভাবে অতিক্রম করার পর্যায়ে। এতে করে ভয়াবহ বন্যার বিস্তৃতির একেবারেই মুখোমুখি অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যমুনা এবং ব্রহ্মপুত্র নদ-নদী পাড়ের তথা দেশের উত্তর জনপদের বিশাল অঞ্চল। তাছাড়া বন্যায় যুক্ত হয়েছে কংস নদী। নদীটির পানির সমতল গত ২৪ ঘণ্টায় ৭০ সেমি বেড়ে গিয়ে গতকাল বিপদসীমার ৬০ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গতকাল পানি উন্নয়ন বোর্ড ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের সূত্রে তথ্য-উপাত্ত ও পূর্বাভাসে সর্বশেষ এই বন্যা পরিস্থিতি জানা গেছে।

সূত্র আরও জানায়, গতকাল শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ পয়েন্টে পানি বিপদসীমায় অথবা মাত্র কয়েক সেমি নীচে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ অবস্থায় বন্যা ও নদী ভাঙনের আতঙ্কে ও চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন এসব নদ-নদী, শাখা ও উপনদী সংলগ্ন শহর-গ্রাম জনপদের লাখ লাখ মানুষ। গতকাল বিকেল ও সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অবধি ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদ-নদী পাড়ের বন্যার মুখোমুখি বিভিন্ন এলাকার অগণিত মানুষজনের মাঝে জানমাল রক্ষার উপায় নিয়ে ব্যস্ততা ও ছোটাছুটি চলে।
পানি ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো জানায়, প্রধানত ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশ, হিমালয় পাদদেশীয় অঞ্চলসহ বিভিন্ন পার্বত্য অঞ্চলে জোরালো মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ইতোমধ্যে অতিবর্ষণ হয়েছে এবং তা অব্যাহত আছে। তাছাড়া ভারতের সেসব অঞ্চলে নদ-নদীগুলোতে থাকা প্রায় সবক’টি বাঁধ খুলে দেয়া হয়েছে ঢলের চাপ সামাল দিতে গিয়ে। উভয় কারণে ভারতের উজান থেকে প্রবল বেগে ভাটির দিকে ঢল-বানের প্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। এরফলে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীতে পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। তৃতীয়ত দেশের অভ্যন্তরেও মাঝারি থেকে ভারী, কোথাও কোথাও অতিভারী বর্ষণ হচ্ছে। যা নদ-নদীর প্রবাহ ও অববাহিকা এলাকাগুলোকে আরও ফুলিয়ে-ফুঁসিয়ে তুলছে। যা সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ধরা যায় মাত্র ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। উজান থেকে নেমে আসা ঢলের তোড়ই বন্যার মূল কারণ। আবহাওয়া বিভাগ বলছে, আগামী সপ্তাহে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে। তখন নদ-নদীর পানি ফের বৃদ্ধি পেতে পারে। চলতি জুলাই মাসের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে নদ-নদীর সম্ভাব্য অবস্থা সম্পর্কে জানানো হয়েছিল, উত্তরাঞ্চলে বন্যা হতে পারে।

এদিকে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য এলাকার অন্যতম খরস্রোতা নদী উত্তর চট্টগ্রামের হালদা এবং বান্দরবান ও কক্সবাজারের উপর দিয়ে প্রবাহিত মাতামুহুরীর পানি এখন বিপদসীমার নীচে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাহাড়ি এলাকায় বর্ষণ ও ঢল হ্রাসের ফলে এ দু’টি নদীর পানির সমতল দ্রুত সময়ের ব্যবধানে কমে এসেছে। আর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান দু’টি নদী সুরমা ও কুশিয়ারায় পানি কমতে শুরু করেছে। এরফলে বৃহত্তর সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। তবে এ উন্নতি তথা সুরমা-কুশিয়ারার পানি হ্রাসের ধারা স্থিতিশীল থাকবে কিনা তা স্পষ্ট হতে পারে আরও এক থেকে দু’দিন পর। নদ-নদীর পানির হ্রাস ও বৃদ্ধির মধ্যে এসব এলাকার সর্বত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলোতে ভয়াবহ ধস, গ্রাম-জনপদে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
সর্বশেষ বন্যা, নদ-নদীর সমতল পরিস্থিতি সম্পর্কে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন গতকাল ইনকিলাবকে জানান, যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদ-নদীতে পানি ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় এবং কোন কোন পয়েন্টে বিপদসীমার ঠিক বরাবরই রয়েছে। যা উদ্বেগজনক। পানির সমতল বৃদ্ধির প্রবণতা আগামী ৪৮ ঘণ্টায়ও অব্যাহত থাকতে পারে। এতে করে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদ-নদী বিপদসীমা অতিক্রম করার পর্যায়ে কোথাও কোথাও মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার ব্যবধানে রয়েছে। এ অবস্তায় যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদ-নদী সংলগ্ন এলাকাগুলোতে অর্থাৎ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান বন্যা কবলিত হওয়ার মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছে। মূলত বাইরের তথা উজানের অতিবৃষ্টিতে নেমে আসা ঢলের কারণে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু চট্টগ্রাম অঞ্চলের হালদা ও মাতামুহুরী নদীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি ঢলের কারণে পানির সমতল বিপদসীমা অতিক্রম করে। সেখানে বাইরের পানির ঢল নেই। ফলে পাহাড়ি এলাকায় অতিবৃষ্টি কমলে বা বন্ধ হওয়ায় দ্রুত বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তিনি আরও জানান, সিলেটে সুরমা ও কুশিয়ারা দুই নদীর পানি হ্রাস অব্যাহত থাকায় সেখানে বন্যা পরিস্থিতির ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। যদিও এখনো বিভিন্ন পয়েন্টে বিপদসীমার উপরে রয়েছে। বন্যার এই উন্নতি স্থিতিশীল থাকবে কিনা আরও ২৪ বা ৪৮ ঘণ্টা পানির সমতল পর্যŸেক্ষণ থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীসমূহের পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানির সমতল হ্রাস পাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীসমূহের পানির সমতল বৃদ্ধির প্রবণতা আগামী ৪৮ ঘণ্টায়ও অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীসমূহের পানির সমতল বৃদ্ধির বর্তমান প্রবণতা আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় সিলেট অঞ্চলের সুরমা ও কুশিয়ারা উভয় নদীর পানির সমতল হ্রাস পেতে পারে। পাউবোর পর্যবেক্ষণে গতকাল ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদের বিপদসীমার কিছুটা নিচে প্রবাহ বজায় থাকলেও পূর্বাভাস অনুসারে তা আগামী ২৪ ও ৪৮ ঘণ্টায় আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। বিপদসীমা অতিক্রমের পর্যায়ে এসে গেছে।
বিপদসীমার সর্বশেষ পরিস্থিতি
ব্রহ্মপুত্রের বিভিন্ন পয়েন্টে নদীর প্রবাহ ছিল- নুনখাওয়া পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১২৫ সেমি নীচে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। চিলমারী পয়েন্টে ২৪ ঘণ্টায় ৩৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার মাত্র ২৯ সেমি নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল।

অন্যদিকে যমুনা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে প্রবাহ ছিল- বাহাদুরাবাদে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৪ সেমি বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার মাত্র ১২ সেমি নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সারিয়াকান্দি পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৬ সেমি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার মাত্র ৮ সেমি নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। যমুনা সিরাজগঞ্জে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৯ সেমি বৃদ্ধি পেয়ে ২৮ সেমি নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
তবে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যে ব্রহ্মপুত্র নদী নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমা থেকে ১২২ সেমি নীচে এবং চিলমারী পয়েন্টে মাত্র ২৫ সেমি নীচে দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। আর যমুনা নদ বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে মাত্র ৩ সেমি, সারিয়াকান্দি পয়েন্টে মাত্র ৪ সেমি এবং সিরাজগঞ্জে মাত্র ২২ সেমি নীচে দিয়ে প্রবাহি হচ্ছিল। এ অবস্থায় গত রাতে অথবা আজ (শুক্রবার) সকালের দিকে যমুনা নদী বিপদসীমা অতিক্রম করা এবং ফলে সংলগ্ন এলাকাজুড়ে নতুন করে বন্যার বিস্তৃতির আশঙ্কা এখন প্রবল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৃহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর পানির সমতল সবক’টি পয়েন্টে গত কয়েক দিনে বেড়েই চলেছে। এখন বিপদসীমার কিছুটা নীচে দিয়ে প্রবাহিত হলেও ক্রমবর্ধমান প্রবণতার কারণে এসব প্রধান নদ-নদীর বিপদসীমা অতিক্রম এখন মাত্র সময়ের ব্যাপার। আর সেই সাথে বন্যা কবলিত হতে পারে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা।
তাছাড়া গত ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দেশের অধিকাংশ অববাহিকা এলাকায় মাঝারি, ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ হয়েছে। অভ্যন্তরে বর্ষণের সাথে অনেকগুণ বেশি যুক্ত হচ্ছে নদ-নদীতে ঢলের পানির চাপ। ভারতের উজানের ঢল-বানের সঙ্গে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে নদ-নদীর চাপ কমানোর জন্য বাঁধগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। এরফলে ভাটির দেশ বাংলাদেশের উপর ঢল ও বানের চাপ বেড়ে গেছে। চলমান বন্যার এটি মূল কারণ।

এদিকে পাউবোর বন্যা তথ্যকেন্দ্রের সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ অনুসাওে, দেশের মোট ৯০টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় পানি বৃদ্ধি পায় ৫৮টিতে, যা বুধবার ছিল ৬৫টি। এরমধ্যে সর্বশেষ বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল ৫টি পয়েন্টে। অপরিবর্তিত থাকে ২টিতে। হ্রাস পায় ২৪টি পয়েন্টে। গতকাল বিপদসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হচ্ছিল- বৃহত্তর সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদী। বিপদসীমার নীচে নেমে গেছে পার্বত্য বান্দরবান ও কক্সবাজারের মাতামুহুরী নদী। এরআগেই নেমে যায় হালদা নদীও। গতকাল ৪টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী বিপদসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে আগের দু’দিনের তুলনায় তা ছিল কম। সেগুলো হচ্ছে- সুরমা নদী কানাইঘাটে ৫৮ সেন্টিমিটার এবং কুশিয়ারা নদী অমলশীদে ৬৪ সেমি, শেওলায় ৬৫ সেমি, শেরপুর-সিলেটে ১৩ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। অন্যদিকে নতুন করে নদ-নদীর মধ্যে কংস নদী জারিয়াজঞ্জাইল পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ৭০ সেমি বৃদ্ধি পায় এবং বর্তমানে নদীটি বিপদসীমার ৬০ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

ভারতের উজান থেকে ঢল অব্যাহত : খুলে দেয়া হয়েছে সবকটি নদ-নদীর বাঁধ : চরম আতঙ্ক-উৎকণ্ঠায় লাখ লাখ মানুষ শফিউল আলম : বৃহত্তর সিলেটের সঙ্গে এবার বন্যা কবলিত হয়েছে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র পাড়ের বিশাল জনপদ। গতকাল বৃহস্পতিবার সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত ও নদী এলাকার বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী, যমুনা-ব্রহ্মপুত্র উভয় নদী, এর শাখানদী ও উপনদীগুলো এই মুহূর্তে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে অথবা করার পর্যায়ে। কোথাও বিপদসীমা বরাবর বইছে। কোথাও খুব কাছাকাছি ছুঁইছুঁই করছে। নদ-নদীতে বাড়ছে পানি প্রতি ঘণ্টা বা প্রহরের ব্যবধানেই। দেশে নদ-নদীমালার অন্যতম প্রধান দুই ধারা যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র। উভয় নদীতে এবং এর সাথে যুক্ত শাখা, উপ-নদীগুলোতে পানির সমতল বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে। গত ৪ থেকে ৫ দিনে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীতে পানি বৃদ্ধির মাত্রা বেশি। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির এই প্রবণতা অব্যাহত থাকায় যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদ-নদী বিভিন্ন পয়েন্টে বিপদসীমা বরাবর অথবা খুব কাছাকাছি কয়েক সেন্টিমিটার ব্যবধানে রয়েছে। কয়েকটি পয়েন্টে গতকাল রাতের মধ্যে ও আজ (শুক্রবার) সকাল নাগাদ বিপদসীমা নিশ্চিতভাবে অতিক্রম করার পর্যায়ে। এতে করে ভয়াবহ বন্যার বিস্তৃতির একেবারেই মুখোমুখি অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যমুনা এবং ব্রহ্মপুত্র নদ-নদী পাড়ের তথা দেশের উত্তর জনপদের বিশাল অঞ্চল। তাছাড়া বন্যায় যুক্ত হয়েছে কংস নদী। নদীটির পানির সমতল গত ২৪ ঘণ্টায় ৭০ সেমি বেড়ে গিয়ে গতকাল বিপদসীমার ৬০ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গতকাল পানি উন্নয়ন বোর্ড ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের সূত্রে তথ্য-উপাত্ত ও পূর্বাভাসে সর্বশেষ এই বন্যা পরিস্থিতি জানা গেছে। সূত্র আরও জানায়, গতকাল শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ পয়েন্টে পানি বিপদসীমায় অথবা মাত্র কয়েক সেমি নীচে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ অবস্থায় বন্যা ও নদী ভাঙনের আতঙ্কে ও চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন এসব নদ-নদী, শাখা ও উপনদী সংলগ্ন শহর-গ্রাম জনপদের লাখ লাখ মানুষ। গতকাল বিকেল ও সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অবধি ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদ-নদী পাড়ের বন্যার মুখোমুখি বিভিন্ন এলাকার অগণিত মানুষজনের মাঝে জানমাল রক্ষার উপায় নিয়ে ব্যস্ততা ও ছোটাছুটি চলে। পানি ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো জানায়, প্রধানত ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশ, হিমালয় পাদদেশীয় অঞ্চলসহ বিভিন্ন পার্বত্য অঞ্চলে জোরালো মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ইতোমধ্যে অতিবর্ষণ হয়েছে এবং তা অব্যাহত আছে। তাছাড়া ভারতের সেসব অঞ্চলে নদ-নদীগুলোতে থাকা প্রায় সবক’টি বাঁধ খুলে দেয়া হয়েছে ঢলের চাপ সামাল দিতে গিয়ে। উভয় কারণে ভারতের উজান থেকে প্রবল বেগে ভাটির দিকে ঢল-বানের প্রবাহ অব্যাহত রয়েছে। এরফলে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীতে পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। তৃতীয়ত দেশের অভ্যন্তরেও মাঝারি থেকে ভারী, কোথাও কোথাও অতিভারী বর্ষণ হচ্ছে। যা নদ-নদীর প্রবাহ ও অববাহিকা এলাকাগুলোকে আরও ফুলিয়ে-ফুঁসিয়ে তুলছে। যা সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ধরা যায় মাত্র ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। উজান থেকে নেমে আসা ঢলের তোড়ই বন্যার মূল কারণ। আবহাওয়া বিভাগ বলছে, আগামী সপ্তাহে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে। তখন নদ-নদীর পানি ফের বৃদ্ধি পেতে পারে। চলতি জুলাই মাসের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে নদ-নদীর সম্ভাব্য অবস্থা সম্পর্কে জানানো হয়েছিল, উত্তরাঞ্চলে বন্যা হতে পারে। এদিকে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য এলাকার অন্যতম খরস্রোতা নদী উত্তর চট্টগ্রামের হালদা এবং বান্দরবান ও কক্সবাজারের উপর দিয়ে প্রবাহিত মাতামুহুরীর পানি এখন বিপদসীমার নীচে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাহাড়ি এলাকায় বর্ষণ ও ঢল হ্রাসের ফলে এ দু’টি নদীর পানির সমতল দ্রুত সময়ের ব্যবধানে কমে এসেছে। আর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রধান দু’টি নদী সুরমা ও কুশিয়ারায় পানি কমতে শুরু করেছে। এরফলে বৃহত্তর সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। তবে এ উন্নতি তথা সুরমা-কুশিয়ারার পানি হ্রাসের ধারা স্থিতিশীল থাকবে কিনা তা স্পষ্ট হতে পারে আরও এক থেকে দু’দিন পর। নদ-নদীর পানির হ্রাস ও বৃদ্ধির মধ্যে এসব এলাকার সর্বত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলোতে ভয়াবহ ধস, গ্রাম-জনপদে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সর্বশেষ বন্যা, নদ-নদীর সমতল পরিস্থিতি সম্পর্কে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন গতকাল ইনকিলাবকে জানান, যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদ-নদীতে পানি ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় এবং কোন কোন পয়েন্টে বিপদসীমার ঠিক বরাবরই রয়েছে। যা উদ্বেগজনক। পানির সমতল বৃদ্ধির প্রবণতা আগামী ৪৮ ঘণ্টায়ও অব্যাহত থাকতে পারে। এতে করে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদ-নদী বিপদসীমা অতিক্রম করার পর্যায়ে কোথাও কোথাও মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার ব্যবধানে রয়েছে। এ অবস্তায় যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদ-নদী সংলগ্ন এলাকাগুলোতে অর্থাৎ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান বন্যা কবলিত হওয়ার মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছে। মূলত বাইরের তথা উজানের অতিবৃষ্টিতে নেমে আসা ঢলের কারণে যমুনা-ব্রহ্মপুত্র নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু চট্টগ্রাম অঞ্চলের হালদা ও মাতামুহুরী নদীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি ঢলের কারণে পানির সমতল বিপদসীমা অতিক্রম করে। সেখানে বাইরের পানির ঢল নেই। ফলে পাহাড়ি এলাকায় অতিবৃষ্টি কমলে বা বন্ধ হওয়ায় দ্রুত বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তিনি আরও জানান, সিলেটে সুরমা ও কুশিয়ারা দুই নদীর পানি হ্রাস অব্যাহত থাকায় সেখানে বন্যা পরিস্থিতির ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। যদিও এখনো বিভিন্ন পয়েন্টে বিপদসীমার উপরে রয়েছে। বন্যার এই উন্নতি স্থিতিশীল থাকবে কিনা আরও ২৪ বা ৪৮ ঘণ্টা পানির সমতল পর্যŸেক্ষণ থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীসমূহের পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানির সমতল হ্রাস পাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীসমূহের পানির সমতল বৃদ্ধির প্রবণতা আগামী ৪৮ ঘণ্টায়ও অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীসমূহের পানির সমতল বৃদ্ধির বর্তমান প্রবণতা আগামী ৪৮ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় সিলেট অঞ্চলের সুরমা ও কুশিয়ারা উভয় নদীর পানির সমতল হ্রাস পেতে পারে। পাউবোর পর্যবেক্ষণে গতকাল ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদের বিপদসীমার কিছুটা নিচে প্রবাহ বজায় থাকলেও পূর্বাভাস অনুসারে তা আগামী ২৪ ও ৪৮ ঘণ্টায় আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। বিপদসীমা অতিক্রমের পর্যায়ে এসে গেছে। বিপদসীমার সর্বশেষ পরিস্থিতি ব্রহ্মপুত্রের বিভিন্ন পয়েন্টে নদীর প্রবাহ ছিল- নুনখাওয়া পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১২৫ সেমি নীচে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। চিলমারী পয়েন্টে ২৪ ঘণ্টায় ৩৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার মাত্র ২৯ সেমি নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। অন্যদিকে যমুনা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে প্রবাহ ছিল- বাহাদুরাবাদে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৪ সেমি বেড়ে গিয়ে বিপদসীমার মাত্র ১২ সেমি নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সারিয়াকান্দি পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৬ সেমি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার মাত্র ৮ সেমি নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। যমুনা সিরাজগঞ্জে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৯ সেমি বৃদ্ধি পেয়ে ২৮ সেমি নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যে ব্রহ্মপুত্র নদী নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমা থেকে ১২২ সেমি নীচে এবং চিলমারী পয়েন্টে মাত্র ২৫ সেমি নীচে দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। আর যমুনা নদ বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে মাত্র ৩ সেমি, সারিয়াকান্দি পয়েন্টে মাত্র ৪ সেমি এবং সিরাজগঞ্জে মাত্র ২২ সেমি নীচে দিয়ে প্রবাহি হচ্ছিল। এ অবস্থায় গত রাতে অথবা আজ (শুক্রবার) সকালের দিকে যমুনা নদী বিপদসীমা অতিক্রম করা এবং ফলে সংলগ্ন এলাকাজুড়ে নতুন করে বন্যার বিস্তৃতির আশঙ্কা এখন প্রবল। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বৃহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর পানির সমতল সবক’টি পয়েন্টে গত কয়েক দিনে বেড়েই চলেছে। এখন বিপদসীমার কিছুটা নীচে দিয়ে প্রবাহিত হলেও ক্রমবর্ধমান প্রবণতার কারণে এসব প্রধান নদ-নদীর বিপদসীমা অতিক্রম এখন মাত্র সময়ের ব্যাপার। আর সেই সাথে বন্যা কবলিত হতে পারে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা। তাছাড়া গত ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দেশের অধিকাংশ অববাহিকা এলাকায় মাঝারি, ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ হয়েছে। অভ্যন্তরে বর্ষণের সাথে অনেকগুণ বেশি যুক্ত হচ্ছে নদ-নদীতে ঢলের পানির চাপ। ভারতের উজানের ঢল-বানের সঙ্গে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে নদ-নদীর চাপ কমানোর জন্য বাঁধগুলো খুলে দেয়া হয়েছে। এরফলে ভাটির দেশ বাংলাদেশের উপর ঢল ও বানের চাপ বেড়ে গেছে। চলমান বন্যার এটি মূল কারণ। এদিকে পাউবোর বন্যা তথ্যকেন্দ্রের সর্বশেষ পর্যবেক্ষণ অনুসাওে, দেশের মোট ৯০টি পানির সমতল পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় পানি বৃদ্ধি পায় ৫৮টিতে, যা বুধবার ছিল ৬৫টি। এরমধ্যে সর্বশেষ বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল ৫টি পয়েন্টে। অপরিবর্তিত থাকে ২টিতে। হ্রাস পায় ২৪টি পয়েন্টে। গতকাল বিপদসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হচ্ছিল- বৃহত্তর সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদী। বিপদসীমার নীচে নেমে গেছে পার্বত্য বান্দরবান ও কক্সবাজারের মাতামুহুরী নদী। এরআগেই নেমে যায় হালদা নদীও। গতকাল ৪টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী বিপদসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে আগের দু’দিনের তুলনায় তা ছিল কম। সেগুলো হচ্ছে- সুরমা নদী কানাইঘাটে ৫৮ সেন্টিমিটার এবং কুশিয়ারা নদী অমলশীদে ৬৪ সেমি, শেওলায় ৬৫ সেমি, শেরপুর-সিলেটে ১৩ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। অন্যদিকে নতুন করে নদ-নদীর মধ্যে কংস নদী জারিয়াজঞ্জাইল পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ৭০ সেমি বৃদ্ধি পায় এবং বর্তমানে নদীটি বিপদসীমার ৬০ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।

https://www.dailyinqilab.com/article/86468