৩ জুলাই ২০১৭, সোমবার, ১২:৩৬

খেসারত দিচ্ছে জনগণ

মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভার : দুর্নীতির জন্য সময়ক্ষেপণ

নকশা ত্রুটির অজুহাতে মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভার প্রকল্পের দুর্নীতি শুরু। এলজিইডির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে কোটি কোটি টাকা লোপাটের জন্য কয়েক দফায় বাড়ানো হয় এর নির্মাণ ব্যয়। আর সময় ক্ষেপণ সেই দুর্নীতিরই অংশ। বার বার প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বাড়ানোর কারনে দুর্ভোগ আর ভোগান্তি বেড়েছে ব্যাপক হারে। তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে যার খেসারত দিচ্ছে জনগণ। সর্বশেষ গত ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও এবারও সময় অনির্দ্দিষ্টকালের জন্য সময় বাড়ানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যেভাবে ধীর গতিতে কাজ চলছে তাতে আগামী ৬ মাসেও প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না। যদিও ফ্লাইওভার প্রাক্তন প্রকল্প পরিচালক ও বর্তমানে প্রকল্প উপদেষ্টা নাজমুল আলম দাবি করেছেন, এ মাসের মধ্যেই কাজ শেষ হবে। নাজমুল আলমের এ বক্তব্যের বিরোধীতা করেছেন খোদ এলজিইডির কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশ না করে একজন কর্মকর্তা গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, এটা কথার কথা। তিনি নিজেও চান না তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হোক। কারণ বরাদ্দের টাকা শেষ করতে হলে সময় ক্ষেপণ করতে হবে। নানা অজুহাতে সেটাই করা হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, সরকারী চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পরেও দুর্নীতিকে আড়াল করার জন্য তাকে উপদেষ্টা হিসাবে অবৈধভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এটাও একটা বড় ধরণের দুর্নীতি। একই সাথে প্রকল্প পরিচালক হিসাবে যাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাকে কোনো ক্ষমতা দেয়া হয় নি। এতে করে দুর্নীতির গোমর ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা আছে। এলজিইডি সূত্র জানায়, মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভার নিয়ে দুর্নীতির বীজ বপন করেন এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমান। ওয়াহিদুরের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসাবে সে সময় নাজমুল আলমকে এই মহাপ্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়। চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও বর্তমান প্রধান প্রকৌশলীর বদন্যতায় নাজমুল আলমকেই উপদেষ্টা হিসাবে একই প্রকল্পে পূর্বের চেয়ে অধিকতর ক্ষমতায় নিয়োগ দেয়া হয়। তমা কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সাথে বিশেষ সম্পর্কের কারণেই নাজমুল আলমের এই প্রাপ্তি। যার প্রভাবে এখনও তিনি একাই প্রকল্পের তিনটি গাড়ি ব্যবহার করেন। এলজিইডি সূত্র জানায়, ঈদেও তিনি তিনটি গাড়ি নিয়ে টাঙ্গাইলে গ্রামের বাড়ীতে ঈদ উদযাপন করতে গিয়েছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভার নির্মাণকালে মানুষে ভোগান্তি যাতে অপেক্ষাকৃত কম হয় সেজন্য তিনটি আলাদা প্যাকেজ করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে তিন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মধ্যে চীনের মেটালারজিক্যাল কনস্ট্রাকশন ওভারসিজ কোম্পানি নামক ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে তমা কনস্ট্রাকশন টেন্ডার জমা দিয়ে আরো একটি কাজ ভাগিয়ে নিয়ে একাই দু’টি প্যাকেজের কাজ করছে। তমা পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, চীনের ওই প্রতিষ্ঠান তমাকে এই প্যাকেজটি সাব-কন্টাক্ট দিয়েছে। যদিও চুক্তির শর্তানুযায়ী এক্ষেত্রে সাব কন্টাক্ট সম্পূর্ণ অবৈধ। বিশেষজ্ঞদের মতে, দু’টি প্যাকেজতো দূরে থাকুক একটি প্যাকেজের কাজ করার মতো সক্ষমতা তমার নেই, কখনওই ছিল না। অভিযোগ রয়েছে, তমা এলজিইডির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে গোপন সমঝোতা করে যন্ত্রপাতি কেনার কথা বলে বড় অংকের অর্থ অগ্রিম নিয়েছে সরকারের কাছ থেকে। বাস্তবে তমা কনস্ট্রাকশন ভালো কোন যন্ত্রপাতি ক্রয় করেনি। পুরনো লক্কর-ঝক্কর মার্কা যন্ত্রপাতি দিয়েই চলছে ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ। এতে করে একদিকে যেমন কাজের গুণগত মান রক্ষা হচ্ছে না তেমনি পাইল বোরিং এবং কস্টিংএ ১০ ঘন্টার জায়গায় ২৪ থেকে ৩০ ঘন্টা সময় ব্যয় হয়েছে। যার ফলে কাজ নিম্নমানের হচ্ছে, অথচ ব্যয় হচ্ছে বেশি। যে কারণে বার বার নির্ধারিত সময় ফুরিয়ে এলেও শেষ হচ্ছেনা ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ।
এর মধ্যে গত ১৩ মার্চ রাজধানীর মালিবাগ রেলগেট এলাকায় নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে স্বপন মিয়া নামের এক শ্রমিক নিহত হয়। এ ছাড়া পলাশ (৪০) ও নূর নবী (৪০) নামের দুই ব্যক্তি আহত হয়। ফ্লাইওভারের মালিবাগ অংশে এই দুর্ঘটনা ঘটে যা তমার অধীনে ছিল। গার্ডার তোলার সময় তা ক্রেন থেকে ছিঁড়ে পড়ায় হতাহতের ঘটনা ঘটে। এই দুর্ঘটনার ঘটনার পরও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান তমা কন্সট্রাকশনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এমনকি হতাহতদের পরিবারকে কোনো ক্ষতিপূরণও দেয়া হয়নি। বরং হতাহতের পরিবারকে নানাভাবে হুমকী-ধমকী দিয়ে আড়ালে থাকতে বাধ্য করা হয়। এ বিষয়ে নির্মাণাধীন মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে নিহত শ্রমিক স্বপন মিয়ার পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা এবং আহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। গত ৭ জুন বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল জারি করেন। সূত্র জানায়, রুলে মরহুম স্বপন মিয়ার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা দুই সপ্তাহের মধ্যে আদালতকে অবহিত করতে রমনা থানার ওসিকে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়। এ ছাড়া জনগণের নিরাপত্তা দিতে সরকারের ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রধান প্রকৌশলী, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী, ফ্লাইওভার নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও রমনা থানার ওসিকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়। গত ৩ জুন মানবাধিকার সংগঠন ‘চিলড্রেনস চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’-এর পক্ষে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। এ রিট আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে আদালত এই রুল জারি করেন।


https://www.dailyinqilab.com/article/85930/