২৪ জুন ২০১৭, শনিবার, ১২:১৬

সদরঘাটে যাত্রীদের চরম ভোগান্তি

রাজধানীর সদরঘাটে চরম ভোগান্তিতে দক্ষিণাঞ্চলগামী ছাড়াও ৪১টি রুটে ঈদে ঘরমুখো যাত্রীরা। টার্মিনালের আশপাশের রাস্তায় যানজট, কুলি হয়রানি, পন্টুনে হকার ও লঞ্চে যাত্রীবেশী চোর থাকায় সর্বস্ব হারিয়ে ঈদে নাড়ির টানে বাড়ি যেতে হচ্ছে অনেক যাত্রীকে। এ ছাড়া বিআইডব্লিউটিএর নৌনিরাপত্তা বিভাগের অব্যস্থাপনায় চরম ভোগান্তিতে যাত্রীরা। তবে দেখেও না দেখার ভান করছেন নৌপুলিশ ছাড়াও টার্মিনালে নিয়োজিত বিভিন্ন শ্রেণীর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।

জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলগামী মানুষের যাতায়াতের অন্যতম পথ নদী। এবার ঈদে ৪১টি রুটে ২০৫টি লঞ্চে যাতায়াত করছে লাখ লাখ ঘরমুখো মানুষ। এজন্য সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ব্যাপক নিরাপত্তায় নৌপুলিশ, ডিএমপি পুলিশ, র্যাব, কোস্টগার্ড, আনসার, বিএনসিসি ও ডিইপিটিসি ক্যাডেট ছাড়াও স্থানীয় ও ঘাট শ্রমিক লীগের প্রায় শতাধিক সদস্য। এ ছাড়া ১৪টি গ্যাংওয়ে দিয়ে ২২টি পন্টুনে যাবেন যাত্রীরা। আবার মাইকিং করেও গন্তব্য স্থানের কথা উল্লেখ করে পন্টুন ও লঞ্চের কথা বলা হচ্ছে।
এ দিকে, সকাল থেকেই বিভিন্ন রুটে লঞ্চ ছেড়ে গেছে। সর্বমোট ১১০টি লঞ্চ ছাড়ার কথা থাকলেও রাত ৮টা পর্যন্ত ১০০টি লঞ্চ ছেড়ে গেছে। তা ছাড়া ৪২টি অপেক্ষমাণ রয়েছে। বিভিন্ন স্পটে বাদিং রয়েছে ৭০টি লঞ্চ। অন্য দিকে, ঝালকাঠি, মাদারীপুর ও সূর্যমণিগামীদের জন্য নতুন টার্মিনালের গ্যাংওয়ে ২ ও ৩ এবং পন্টুন ৪ নির্ধারণ করা হয়েছে। তা ছাড়া যাত্রী সুবিধার্থে টার্মিনালকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১, পটুয়াখালী গলাচিপাবাসীর জন্য ওয়াইজঘাট ২, বরিশাল, ঝালকাঠি ও মাদারীপুরের জন্য নতুন টার্মিনাল ৩, ভোলা ও বরগুনার জন্য পুরাতন টার্মিনাল ৪, চাঁদপুর ও গ্রিনলাইন ডে সার্ভিসের জন্য লালকুঠি ঘাট। তবুও যাত্রীদের পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। আবার কোনো যাত্রী প্রতিবাদ করলে তাকে মারধর ছাড়াও পুলিশি হয়রানি করা হচ্ছে। যেসব স্পটগুলোতে যাত্রী হয়রানি বেশি তা উল্লেখ করা হলো।
কুলি হয়রানি : যাত্রীরা টার্মিনালে ঢোকামাত্র ব্যাগ নিয়ে টানাটানি করে কুলিরা। দাম হাঁকায় ১ হাজার থেকে ১২ শ’ টাকা। কেউ মালামাল দিতে না চাইলে তাকে নানাভাবে অপমান অপদস্থ করা হয়। ঝালকাঠি জেলার নলছিটির যাত্রী যুবলীগ কর্মী সেলিম এ প্রতিবেদককে জানান, নলছিটিতে ঠিকাদারি করেন তিনি। অফিসিয়াল কাজের জন্য ও ঈদ কেনাকাটা করতে ঢাকায় আসা হয়েছে। সদরঘাট টার্মিনালে ঢুকলেই দুই দিক থেকে দুই কালারের শার্ট পরা লোক সাথে থাকা মালামাল টানাটানি করছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই দুই গ্রুপে মারামারি লেগে গেছে। পরে পুলিশ ও ঘাট সরদাররা এলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে শাড়ি রাখা ব্যাগটি আর খুঁজে পাইনি। মোটরসাইকেলসহ রফিকুল ইসলাম নামে বরিশালগামী এক যাত্রী জানান, একটা মোটরসাইকেল ধরতে পাঁচজন কুলি দৌড়ঝাঁপ করছে। ১ হাজার টাকা না দিলে লঞ্চে উঠতে দেবে না। এমন দাবি করলে আশ্চর্য হন তিনি। পরে নানা পরিচয় দেয়ার পরও ৬০০ টাকা দিতে হয়েছে কুলিকে। এ ছাড়াও কুলিদের অতিরিক্ত টাকা দাবি ও আদায়ের শিকার ইমন, সালাম, আরজু,আলামিন, সোহাগসহ প্রায় শতাধিক যাত্রী।
পন্টুনে হকার : টার্মিনাল ঘাট পন্টুনগুলাতে হকারমুক্ত না থাকায় যাত্রীদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। এসব হকার যেসব ফল বিক্রি করছে তা আবার পচা। তাদের ফল কিনে অনেকে নদীতে ফেলে দিয়েছে। এসব হকার থেকে দৈনিক চাঁদা নিচ্ছে বিআইডব্লিউটিএ, নৌপুলিশ ও ডিএমপি পুলিশসহ স্থানীয় শ্রমিক লীগ নামধারী কিছু নেতা বলে হকার সূত্রে জানা গেছে।
লঞ্চে যাত্রীবেশী চোর ও বেডশিট পার্টি : প্রতিদিন প্রায় ১০ থেকে ১২ জনের ব্যাগ নেই। নামাজ পড়তে কিংবা কোনো কিছু কিনতে উপরে গেলে আর মিলে না তার ব্যাগ বা রেখে যাওয়া মূল্যবান জিনিসপত্র। গতকাল ৪টায় বরিশালের যাত্রী রানা এ প্রতিবেদককে জানান, তার ব্রিফকেস নিয়ে গেছে কে বা কারা। এ দিকে লঞ্চের ডেকে বেডশিটের ফাঁদ পেতে যাত্রীদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। সন্ধ্যায় দেখা গেছে কীর্তনখোলা লঞ্চে উঠতে অন্য লঞ্চের রশি বাইছে যাত্রীরা। শাওন নামে এক যাত্রী লঞ্চে উঠতে গিয়ে বাঁ পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছেন। কীর্তনখোলা লঞ্চের ম্যানেজার ফারুক হোসেন নয়া দিগন্তকে জানান, তাদের নতুন ভবনের তিন নম্বর পন্টুন নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু পারাবত ১৫ সকাল থেকেই তিন নম্বর পন্টুনে লঞ্চ বেঁধে রেখেছে। তিনি বলেন, পারাবত লঞ্চের জন্য ৪ নম্বর পল্টুন নির্ধারণ করা হয়েছে। তবুও তাদের খামখেয়লিপনায় চরম ভোগান্তিতে যাত্রীরা। এ ঘটনা সদরঘাট টার্মিনাল বিআইডব্লিউটিএর নৌনিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জয়নাল আবেদীন স্যারকে জানিয়ে কোনো লাভ হয়নি বলে জানান তিনি। তবে পারাবত লঞ্চের কেউ এ বিষয়ে কোনো বলতে রাজি নন।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর শফিকুল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, সদরঘাট টার্মিনালে ২ শ’ নৌ পুলিশ, তিন শ’ ডিএমপি পুলিশ ছাড়াও র্যাবসহ বিভিন্ন সংস্থার লোক ও বিআইডব্লিউটিএর কয়েক শ’ লোক প্রতিদিন ডিউটি করছে। যাতে করে যাত্রীরা নির্বিঘেœ নিরাপদে লঞ্চে উঠতে পারে। তিনি বলেন, পন্টুন দেখভালের জন্য নৌপুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। লঞ্চ ছাড়ার আগ পর্যন্ত নিরাপত্তা তারা দেবেন। নৌপুলিশ এসপি জমশের আলী নয়া দিগন্তকে বলেন, ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের নিরাপত্তায় প্রায় আড়াই শ’ নৌপুলিশ রয়েছে, যাতে করে যাত্রীদের পন্টুন কিংবা লঞ্চে উঠতে কোনো সমস্যা না হয়।
লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি মাহাবুব উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম নয়া দিগন্তকে বলেন, দক্ষিণাঞ্চলগামী ছাড়াও নদীতে বিভিন্ন রুটের যাত্রীরা নির্বিঘেœ ঈদযাত্রা সফল হয় সেদিকে খেয়াল নিতে লঞ্চ মালিকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ দিকে, প্রতিদিনই কোনো না কোনো যাত্রী সুন্দরবন ১০ লঞ্চের স্টাফদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন। গতকাল সাড়ে ৬টার দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মন্ত্রীর পিএসের ভাগনি ভাগনি- জামাইকে মারধর করে লোকমান ও ইউসুফ নামে দুই কেবিন বয়। এ ঘটনায় ওই দুই কেবিন বয়কে আটক করছে ডিএমপি সদরঘাট ফাঁড়ি পুলিশ।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/231027