১২ জুন ২০১৭, সোমবার, ১১:১৭

মেগা প্রকল্প- অগ্রগতি না থাকলেও বিপুল বরাদ্দ

‘বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়গুলোর কিছু সমস্যার কারণে মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়।’

তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের :ফাস্ট ট্রাকে থাকা মেগাপ্রকল্পগুলোতে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি না থাকলেও আগামি ২০১৭-১৮ সালের বাজেটে দেওয়া হয়েছে বিপুল বরাদ্দ। চলতি অর্থবছরের সংশোধীত বাজেটে এসব প্রকল্পে বরাদ্দ থাকা সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশিরভাগই ব্যয় করতে না পারলেও আগামি বাজেটে ৭টি প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩০ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। এগুলোর মধ্যে পদ্মা সেতু ছাড়া অন্য প্রকল্পে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। আর পদ্মা সেতু বাস্তবায়নেরও যে গতি তাতে প্রকল্পটি শেষ হতে আরও ৫ বছর সময় লেগে যেতে পারে।
ফাস্ট ট্রাকে থাকা মেগা প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনা করে তৈরি করা হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এপ্রিল পর্যন্ত পদ্মা বহুমুখী সেতুর কাজ শেষ হয়েছে ৪১ দশমিক ৫০ ভাগ। ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে এপ্রিল পর্যন্ত ব্যায় হয়েছে মাত্র ১৬৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সেই হিসেবে অগ্রগতি মাত্র শূণ্য দশমিক ১৫ শতাংশ। প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার মেট্রোরেল প্রকল্পে এপ্রিল পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১৬৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। সেই হিসেবে অগ্রগতি মাত্র শূণ্য দশমিক ৭৭ শতাংশ। সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে এপ্রিল পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১৫৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। অগ্রগতি মাত্র ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকার মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রে এপ্রিল পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩৫৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা। সেই হিসেবে অগ্রগতি মাত্র ১ শতাংশ। প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে এপ্রিল পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। ১৮ হাজার কোটি টাকার দোহাজারি-রামু-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পে মার্চ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৫৬৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। সেই হিসেবে এই প্রকল্পে অগ্রগতি মাত্র ৩ দশমিক ১৪ শতাংশ। এগুলোর বাইরে সোনাদীয় গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল ও এলএনজি টার্মিনাল খাতা-কমলেই সীমাবদ্ধ আছে।
অর্থমন্ত্রণালয়ের একজন পদস্ত কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়গুলোর কিছু সমস্যার কারণে মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। আগামী বাজেটে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেওয়া হবে।’
এ জন্য অর্থ বিভাগে আলাদা তদারকি সেল খোলার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আশা করা হচ্ছে, এর ফলে আগামীতে বাস্তবায়নে গতি আসবে।’
তবে মেগা প্রকল্পগুলোর এই বাস্তবায়ন হারে সন্তুষ্ট পরিকল্পনা কমিশন। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম বলেন, ‘সরকারের বিশেষ নজরদারির কারণে চলতি মেগা প্রকল্পগুলো সার্বিক অগ্রগতির হার ভাল। ফলে এডিপি বাস্তবায়নে এর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সেই সঙ্গে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার যে বেড়েছে সেক্ষেত্রেও মেগা প্রকল্পগুলোর অগ্রগতির একটা ভূমিকা রয়েছে।’
অগ্রাধিকার তালিকায় থাকা বৃহদাকার প্রকল্পগুলোর এই যখন বাস্তবায়ন অবস্থা, তখনও মাত্র দেড় বছর সময় হাতে নিয়ে আশাবাদী সরকার। বর্তমান মেয়াদেই নির্বাচনী প্রতিশ্রæতির কয়েকটি মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি দৃশ্যমান করতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এসব প্রকল্পের অনুকূলে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে হাত খুলে। ৭টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে আগামী বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩০ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এসব প্রকল্পে বরাদ্দ রয়েছে ১৫ হাজার ৪৯৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এ হিসাবে আগামী অর্থবছরের বরাদ্দ বাড়ছে প্রায় দ্বিগুণ।
আগামী অর্থবছর একক প্রকল্প হিসেবে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পাচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ প্রকল্পে এবার দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার ১৮৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে প্রকল্পটিতে বরাদ্দ রয়েছে ৩ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের পর্যায়ে চলে আসা প্রকল্পটিতে এবার বরাদ্দ বাড়ছে ৬ হাজার ৭৭৯ কোটি ৪ লাখ টাকা।
নতুন অর্থবছরে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৫ হাজার ৫২৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে সংশোধিত এডিপিতে এ প্রকল্পে বরাদ্দ রয়েছে ৪ হাজার ৬৭৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। এ হিসাবে প্রকল্পটিতে বরাদ্দ বাড়ছে ৮৫০ কোটি ২৬ লাখ টাকা।
মেট্রোরেলের অনুকূলে আগামী অর্থবছরের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৪২৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে চলতি অর্থবছরের আরএডিপিতে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ১৮২ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এ হিসেবে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ বাড়ছে ২ হাজার ২৪৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা।
মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ারড পাওয়ার প্রজেক্টে ২ হাজার ২২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পে বরাদ্দ ৭ হাজার ৬০৯ কোটি ৮১ লাখ টাকা। দোহাজারী হতে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হতে মিয়ানমারের নিকটে ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পে বরাদ্দ ১ হাজার ৫৬১ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এ ছাড়া পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পে বরাদ্দ রয়েছে ৪০০ কোটি টাকা।
‘আগামী অর্থবছরে এসব মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি আরও বেশি হবে। সেভাবেই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) বরাদ্দ দেয়া হয়েছে’- এমন বক্তব্য সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলমের।
মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে তিন বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। এর মধ্যে এক বছর শেষ হতে যাচ্ছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিন লাখ কোটি টাকা প্রয়োজন, যার সংস্থান হবে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে। এদিকে ১০ মেগা প্রকল্পের ৫টিরই এখন পর্যন্ত অর্থসংস্থান হয়নি। এগুলো হলো সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, পদ্মা রেল সংযোগ, দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার-গুনদুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ, কর্নফুলি টানেল নির্মাণ প্রকল্প উল্লেখযোগ্য। দাতারা প্রতিশ্রæতি দিলেও এসব প্রকল্পের অর্থায়ন নিশ্চিত হয়নি এখনও। কিছু প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ, টেন্ডারসহ নানা জটিলতাও রয়েছে।
‘জিডিপির গতি ত্বরান্বিত করতে হলে বড় অবকাঠামো প্রকল্প প্রয়োজন’ উল্লেখ করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. কে এ এস মুরশিদ বলেন, ‘সেদিক থেকে বর্তমান সরকারের উদ্দেশ্য ভালো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অর্থায়ন। এ ছাড়া বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ তো রয়েছেই। আমাদের বাস্তবায়নের সামর্থ্য কম।’
মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতিতে সব পক্ষের ক্ষতি উল্লেখ করেন সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের সব প্রকল্পের কাজেই দেরি হয়। এক বছরের কাজ শেষ করতে চার বছর লাগানো হয়। এতে একদিকে যেমন ব্যয় বাড়ে, তেমনি প্রকল্পের সুফল পেতেও দেরি হয়। এতে অর্থায়নকারী ও সরকার- উভয়েই ক্ষতির মুখে পড়ে।’

https://www.dailyinqilab.com/article/83415/