১২ জুন ২০১৭, সোমবার, ১১:১৪

চিনির বাজার অস্থির অতি মুনাফায়

বাজারে চিনির কোনো সংকট না থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজিতে। মিল গেটে যে চিনি ৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে সেই চিনিই খুচরা পর্যায়ে এসে হয়ে যাচ্ছে ৮০ টাকা।

প্রশ্ন উঠেছে, মাঝের প্রায় ২০-২২ টাকা কাদের পকেটে যাচ্ছে? যদি যথাযথ বাজার ব্যবস্থাপনা থাকত তাহলে আরো কম মূল্যে ভোক্তারা চিনি কিনতে পারত বলে সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যজানা গেছে।
চিনি প্রক্রিয়াজাতকারী কম্পানি, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চিনি প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ৫৬-৫৮ টাকা কেজিতে মিল থেকে চিনি বিক্রি করছে। সেই চিনি পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৬৪-৬৬ টাকা কেজিতে। অর্থাৎ এখানেই কেজিতে প্রায় ৮ টাকা কমবেশি। এই চিনিই আবার খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা। পাইকারি-খুচরায় ১৪ টাকার মতো দামের পার্থক্য তৈরি হয়েছে। অতিমুনাফার এই প্রবণতাই দেশের চিনির বাজারকে অস্থির করে তুলছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, রমজানের শুরু থেকেই চিনির বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। মাঝে ডলার ইস্যুতে দাম বৃদ্ধির কথা বলা হলেও সেই ইস্যু দূর হওয়ার পরও চিনির দাম কমেনি।
তথ্য মতে, সব সময় পাইকারি বিক্রেতারা খুব কম লাভে পণ্য বিক্রি করে থাকে। কিন্তু চিনির পাইকারি বিক্রেতারা প্রতি কেজি চিনিতে ৮ টাকা লাভ করে যাচ্ছে, সেখানে দেখার কেউ নেই। আবার খুচরা বিক্রেতারা প্রতি কেজিতে প্রায় ১৪ টাকা লাভ করলেও বাজারে এ বিষয়ে কোনো ধরনের মনিটরিং দেখা যায় না। পর্যাপ্ত মনিটরিংয়ের অভাবেই চিনির বাজারে কিছু ব্যবসায়ী অতিরিক্ত মুনাফা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
চিনি প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা যারা চিনি প্রক্রিয়াজাত করি, তাদের কেউই ৫৮ টাকা কেজির বেশিতে চিনি বিক্রি করছি না। আমাদেরও কথা, তা হলে বাজারে চিনির দাম ৮০ টাকা কেন? এটা সরকারের লোকজন মনে হয় খোঁজ নিলেই জানতে পারবে। সেটা বের করা উচিত বলে মনে করছি। কারণ এর দায় আমাদের ওপরও পড়ে, যদিও আমরা সঠিকভাবেই ব্যবসা করে যাচ্ছি। ’
উল্লেখ্য, ট্যারিফ কমিশনের তথ্য মতে, প্রতি রমজানে সারা দেশে চিনির চাহিদা রয়েছে আড়াই থেকে তিন লাখ মেট্রিক টন। তিন লাখ মেট্রিক টন চিনিতে এভাবে যদি ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত লাভ করে তবে সেটা কয়েক শ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। আর এই অতিমুনাফার চাপ এসে পড়ে সাধারণ ক্রেতাদের ওপর।
চিনির দামে কেন এমন সমন্বয়হীনতা জানতে চাইলে ঢাকার মৌলভীবাজারের চিনি বিক্রেতা আনোয়ার অ্যান্ড ব্রাদার্সের পাইকারি বিক্রেতা আনোয়ার হাবিব জানান, ‘আমরা যে দামে চিনি নিয়ে আসি তার সঙ্গে আরো অনেক খরচ রয়েছে। কেজিতে ৮ টাকা লাভ অসম্ভব বিষয়। রমজানের আগে প্রতিটি ট্রাকের ভাড়া বেড়ে যায়। মিলে একটি ট্রাক ঢুকলে সেটা কখন বেরোবে তার কোনো ঠিক থাকে না। সেখানে চার্জ বাড়তে থাকে। সব মিলিয়ে অভিযোগটা সত্যি না। ’
তবে অভিযোগ রয়েছে, মৌলভীবাজারকেন্দ্রিক পাইকারি ব্যবসায়ীদের একটি চক্র রয়েছে যারা মিল থেকে চিনির সরবরাহ আদেশ নিয়ে নেয়। তারপর তারা শুধু এই অর্ডারগুলো বিক্রি করতে থাকে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে। এতে করে বাজারে চিনির দামে বড় একটি পার্থক্য তৈরি হয়।
তবে মৌলভীবাজারের আরেক পাইকারি বিক্রেতা আবুল হাশেম বলেন, ‘সবারই যার যার মতো করে লিংক রয়েছে। সবাই নিজেদের মতো করেই চিনি মিল থেকে আনে। এখানে কেউ অর্ডার নিয়ে বসে থাকে কথাটা ঠিক না। এটা হলে তো বাজারের নিয়ন্ত্রকরা আমাদের ধরে ফেলত। ’
তবে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাবের) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, এই অভিযোগটা সত্য। তবে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না এর একটাই কারণ। কারণ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো অকার্যকর হয়ে রয়েছে। এরা যদি বাজার মনিটরিংয়ে যথেষ্ট মনোযোগী হতো তাহলে এসব ব্যবসায়ী পার পেত না। তারা ধরা পড়ত আর অতিমুনাফাও বন্ধ হতো।
এদিকে ঢাকায় টিসিবি তাদের বিক্রয়কেন্দ্রগুলো এবং ট্রাক সেলের মাধ্যমে ৫৫ টাকায় চিনি বিক্রি করছে। পাশাপাশি চিনি প্রক্রিয়াজাতকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পয়েন্টে ৬০ টাকা কেজিতে চিনি বিক্রি করছে। তার পরও বাজারে চিনির দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। বাংলাদেশ চিনি করপোরেশনের যে চিনি ৭০ টাকা বিক্রি হওয়ার কথা সেটিও বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা কেজিতে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/06/12/507929