৬ জুন ২০১৭, মঙ্গলবার, ৭:৩৯

জাতিসত্তার বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান

সুশাসন

|| ইকতেদার আহমেদ ||


বাংলাদেশের সামগ্রিক জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশ বাঙালি। বাঙালি এ জনগোষ্ঠী মুসলিম ও হিন্দুÑ প্রধানত এ দু’টি ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত। তা ছাড়া বাংলাদেশে বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এবং হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত ৪৫টি উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠী রয়েছে। এসব উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠীর অনেকের নিজস্ব ভাষা থাকলেও কয়েকটি ভাষা বাংলা। নিজস্ব ভাষাভাষী উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃগোষ্ঠীগুলোও বাংলা বলতে ও বুঝতে সক্ষম। একটি দেশের সামগ্রিক জনসংখ্যার প্রায় সবাই এক ভাষাভাষী হওয়া এবং সবার একই ভাষা বলা ও বোঝার সক্ষমতার এহেন সমরূপতা পৃথিবীর আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর ইতিহাসে বিরল।
১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে বাঙালি জাতিসত্তার অন্তর্ভুক্ত মুসলিম ও হিন্দু জনগোষ্ঠী এবং অপরাপর জনগোষ্ঠী ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ বা উপসম্প্রদায় হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতিবিষয়ক অনুচ্ছেদ নং ২৩ক সন্নিবেশনের মাধ্যমে বলা হয়, রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অনুচ্ছেদটি সন্নিবেশনের ফলে ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের ভিন্নতা সত্ত্বেও এ দেশে জন্মগতভাবে বসবাসরত সব নাগরিক যেমন বাঙালি, অনুরূপ এ দেশে বসবাসরত সব উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ও যে বাঙালি, তার সুস্পষ্ট স্বীকৃতি মিলেছে।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ সম্পূর্ণরূপে ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে বিভাজিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। উভয় রাষ্ট্র উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জাতি সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। ভারতবর্ষ বিভাজন-পরবর্তী ২৩ বছরের মাথায় ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তার ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি বিভাজিত হয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এই প্রেক্ষাপটে ভারত ধর্মীয় জাতিসত্তার নীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে জাতিগত বা ভাষাগত জাতিসত্তার সপক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করে প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়-পরবর্তী এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই জাতির জন্য সংবিধান রচনা একটি অনন্য প্রশংনীয় উদাহরণ। পৃথিবীর নগণ্যসংখ্যক রাষ্ট্র এ ধরনের কৃতিত্বের অধিকারী। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার যেসব মূলনীতির উল্লেখ রয়েছে, এর একটি হলো অনুচ্ছেদ নম্বর ২৫-এ বর্ণিত আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন। অনুচ্ছেদটিতে বলা হয়েছেÑ জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসঙ্ঘের সনদে বর্ণিত নীতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাÑ এসব নীতি হবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি এবং এসব নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র (ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করবে; (খ) প্রত্যেক জাতি স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অথনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করবে; এবং (গ) সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করবে।
সামরিক ফরমানবলে প্রণীত দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ, ১৯৭৮-এর দ্বারা সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে দফা (২) সন্নিবেশনকরত বলা হয়Ñ রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করতে সচেষ্ট হবে। দফা (২) সন্নিবেশনের ফলে ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদকে উক্ত অনুচ্ছেদের (১) দফারূপে পুনর্সংখ্যায়ত করা হয়। দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ, ১৯৭৮ দ্বারা প্রণীত সংশোধনীটিকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী দ্বারা বৈধতা দেয়া হয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষিত হলে পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণয়নের আবশ্যকতা দেখা দেয় এবং উক্ত সংশোধনী প্রণয়নকালে ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদ ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নকালে যে অবস্থায় ছিল, সে অবস্থায় প্রত্যর্পণ করা হয়।
এ মূলনীতির উপদফা (খ) এ ব্যক্ত হয়েছেÑ রাষ্ট্র প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করবে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়নবিষয়ক অনুচ্ছেদটির মূল দফায় শর্তারোপ করে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসঙ্ঘের সনদে বর্ণিত নীতিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা, প্রভৃতির অনুসরণে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি রচনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যখন যেকোনো জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করার কথা ব্যক্ত হয়, তখন যেকোনো জাতির জাতিগত জাতিসত্তার ভিত্তিতে স্বাধিকারের দাবির বিপক্ষে অবস্থান অনুচ্ছেদটিতে উল্লিখিত এতদসংক্রান্ত অধিকারের সাথে সাংঘর্ষিক।
ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে সৃষ্ট তদানীন্তন পাকিস্তানের পূর্বাংশের জনগণের বাঙালি জাতিসত্তা দেশটির পশ্চিমাংশের জনগণের জাতিসত্তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আবার পাকিস্তান রাষ্ট্রটির পশ্চিমাংশের সব জনগণের জাতিসত্তা সমরূপ নয়। পাকিস্তানের চেয়ে ভারত আরো অনেক বেশি জাতিসত্তা সমন্বয়ে গঠিত একটি রাষ্ট্র। পৃথক জাতিসত্তার দাবিদার পাকিস্তানের অন্তত একটি প্রদেশের জনগণের পক্ষ থেকে প্রায়ই স্বাধিকারের দাবি উত্থাপিত হতে দেখা যায়। ভারতের একাধিক রাজ্যের জনগণের পক্ষ থেকেও দীর্ঘ দিন যাবৎ এ ধরনের দাবি উত্থাপিত হয়ে আসছে। উভয় দেশের সরকার কঠোরভাবে নিজ নিজ দেশে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এ ধরনের স্বাধিকারের দাবিকে অবদমিত করার জন্য বদ্ধপরিকর হলেও একে অপর দেশের স্বাধিকারের দাবির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে আসছে এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রত্যক্ষ সহায়তার প্রয়াস পাচ্ছে।
পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশের বালুচিদের জাতিসত্তার ভিত্তিতে স্বাধিকারের দাবির প্রতি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সমর্থন খুব একটা জোরালো নয়। অপর দিকে ভারতের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির রাজ্যের কাশ্মিরিদের স্বাধীনতার দাবি, পাঞ্জাব রাজ্যের শিখ ধর্মাবলম্বীদের স্বাধীন খালিস্তান রাষ্ট্রের দাবি, আসাম, মিজোরাম ও নাগাল্যান্ডের অহমীয়, মিজো ও নাগাদের পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবির প্রতি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সমর্থন ক্রমান্বয়ে প্রবল হয়ে উঠছে।
প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনে বিশ্বাসী কিন্তু বিভিন্ন জাতিসত্তা সমন্বয়ে গঠিত, পৃথিবীর এমন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দেখা যায় জাতিসত্তার ভিত্তিতে স্বাধিকারের দাবি প্রবল হলে সেটি নির্ধারণের দায়িত্ব গণভোটের মাধ্যমে জনগণের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়। যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত স্কটল্যান্ডের অধিবাসীদের জাতিসত্তা স্কটিশ হলেও যতক্ষণ পর্যন্ত স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত, ততক্ষণ পর্যন্ত স্কটল্যান্ডের অধিবাসীরা জাতি হিসেবে ব্রিটিশ নামে অভিহিত। স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির (এসএনপি) স্বাধিকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্কটল্যান্ডে ২০১৪ সালে গণভোট দেয়া হলে প্রায় ১০ শতাংশ ভোটের ব্যবধানে স্বাধীনতাকামীরা পরাভূত হয়। পরে ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি নির্বাচনে দেখা যায় স্বাধিকারের সপক্ষের দল এসএনপি স্কটল্যান্ডের জন্য নির্ধারিত ৫৯টি আসনের মধ্যে ৫৬টিতেই বিজয়ী হয়েছে। এ বিজয়দৃষ্টে স্কটল্যান্ডের জনগণের মধ্যে যারা স্বাধিকারের পক্ষে তাদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে যে, পুনরায় গণভোট দেয়া হলে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্কটল্যান্ডের অভ্যুদয় ঘটবে। স্বাধিকার প্রশ্নে স্কটল্যান্ডে পুনঃগণভোট অনুষ্ঠিত হবে কী হবে না তা অনেকটা নির্ভর করছে যুক্তরাজ্যের এবারের পার্লামেন্ট নির্বাচনে এসএনপির সাফল্যের ওপর। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের জনগণের মধ্যে স্বাধিকারের দাবির প্রতি যে জনসমর্থন রয়েছে। তার প্রতি শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশে যুক্তরাজ্যের মতো যদি গণভোট দেয়া হয় তাতে জনআকাক্সার ভিত্তিতে ভারতের যেসব রাজ্যে স্বাধিকারের দাবি সোচ্চার, সেসব রাজ্যের জনগণের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। কিন্তু এ বিষয়ে জনআকাক্সা যত প্রবলই হোক না কেন, ভারত গণভোটের পরিবর্তে শক্তি দিয়ে যে তা দমন করবে এটি দেশটির রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত, তাদের আচরণে স্পষ্ট।
যুক্তরাষ্ট্রের ৫৪তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে, নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকটি রাজ্যের পক্ষ থেকে স্বাধিকারের দাবি উত্থাপিত হয়েছে। দেশটির নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় এ ধরনের অনিয়ম ও কারচুপি অব্যাহত থাকলে তা দেশটির বিভিন্ন রাজ্যের জনগণের মধ্যে স্বাধিকারের দাবি যে প্রবলতর করবে তা সচেতন জনমানুষ অনুধাবন করতে সক্ষম। এমতাবস্থায় দেশটির অখণ্ডতা অক্ষুণœ রাখতে হলে সে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলাদেশ জাতিগত জাতিসত্তার নীতিতে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে ভারত ও পাকিস্তানসহ পৃথিবীর যেকোনো অঞ্চলে জাতিগত জাতিসত্তার ভিত্তিতে স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি তথাকার জনগণের ব্যাপক সমর্থন থাকলে বাংলাদেশের এর বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ দেশটির এ বিষয়ে ধারণকৃত সাংবিধানিক চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান,
রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/226017